'আমি দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ। সজীব সবসময় আমাকে ছোট্ট সন্তানের মতো আগলে রাখত। সবার খরচ জোগাত। তার বাবারও অবসরে যাওয়ার সময় হয়ে এসেছে। এখন কে আমাকে আগলে রাখবে। কী দোষ ছিল আমার ডাক্তার ছেলের?'-ছাপ্পান্ন বছর বয়সি ঝর্ণা বেগম এমন প্রশ্ন করছেন আর বারবার মূর্ছা যাচ্ছেন। তাকে সান্ত্বনা জানানোর ভাষা কারও নেই।
জানা যায়, কোটাবিরোধী আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের কমপিস্নট শাটডাউন চলাকালে ছোটভাইকে বাসায় আনতে গিয়ে ঢাকার আজমপুরে গুলিতে নিহত হন ডা. সজীব সরকার। উপার্জনক্ষম ছেলেকে হারিয়ে বিলাপ করা ছাড়া আর কিছুই করার নেই পরিবারের সদস্যদের।
নিহত সজীব নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলার মির্জানগর ইউনিয়নের মেঝেরকান্দি গ্রামের মো. হালিম সরকারের ছেলে। তিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সিনিয়র লেকচারার হিসেবে কর্মরত ছিলেন। তিনভাই এক বোনের মধ্যে সবার বড় ছিলেন ডা. সজীব।
নিহত ডা. সজীব সরকারের মা ঝর্না বেগমের সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। তিনি প্রশ্ন করেন- 'ও বাবা কী দোষ ছিল আমার ডাক্তার ছেলের?' বলেই ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকেন।
তিনি বলেন, '১৮ জুলাই আমার ছোট ছেলেকে আনতে বেলা ১১টায় বাসা থেকে বের হয় বড় ছেলে সজীব। বিকাল সাড়ে ৪টা থেকে ৫টার দিকে আমাকে ফোন করে বলে 'মা আমি আজমপুর পৌঁছে গেছি আর কয়েক মিনিটের মধ্যে আব্দুলস্নাহর মাদ্রাসায় পৌঁছে যাব তুমি কোনো চিন্তা করো না। আমি আব্দুলস্নাহকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নিয়ে চলে আসব। আমি রাত ১টা পর্যন্ত ছেলের অপেক্ষায় বসেছিলাম। ছেলে আমার ফিরে এসেছে ঠিক, তবে জীবিত নয় লাশ হয়ে। বলতে পারেন- কী দোষ ছিল আমার ছেলের?'
'আমাদের যা ছিল সব ছেলেকে ডাক্তার বানাতে ব্যয় করেছি। সব হারিয়ে বলতে গেলে আমরা এখন নিঃস্ব। আপনারা কি বলতে পারেন আমার ছেলে হত্যার বিচার কিভাবে পাব?' বলতে বলতে মুর্ছা যান তিনি।
ডা. সজীব সরকারের একমাত্র বোন সুমাইয়া সরকার বলেন, 'উত্তরার থানার আজমপুর এলাকার আশরাফুল উলুম মাদ্রাসায় পড়ুয়া ছোটভাই আব্দুলস্নাহকে আনতে নরসিংদীর বাসা থেকে বের হন সজীব। আজমপুর এলাকায় যখন সে বাস থেকে নামে, তখন আন্দোলনকারী আর পুলিশের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া চলছিল। বিকাল সাড়ে ৫টা থেকে ৬টার মধ্যে সে মাদ্রাসার উদ্দেশ্যে রাস্তার পাশ ধরে হাঁটতে থাকে। এ সময় গুলিতে নিহত হন আমার বড়ভাই। সন্ধ্যা ৭টায় ভাইয়ের বন্ধুর মাধ্যমে খবর পেয়ে উত্তরা আধুনিক হাসপাতালে ছুটে যাই। সেখানে গিয়ে জানতে পারি বিকালে আজমপুরের রাস্তা থেকে কয়েকজন লোক গুলিবিদ্ধ ভাইকে হাসপাতালে নিয়ে আসে। আমার ভাই আজ আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। এ অবস্থায় আমাদের এতো বড় সংসার কি করে চলবে?'
নিহতের ভাই আব্দুলস্নাহ বলেন, 'এর আগের সপ্তাহে ভাই মাদ্রাসায় এসেছিল। ওই সময় তার সঙ্গে সর্বশেষ দেখা হয়। তিনি যাওয়ার সময় বলে গিয়েছিলেন আগামী ১৮ তারিখ বৃহস্পতিবার মাদ্রাসা ছুটি হলে তোমাকে এসে নিয়ে যাব। এইদিন এসেছিলেন ঠিকই কিন্তু আমার কাছে পর্যন্ত পৌঁছতে পারেননি?। এর আগে লাশ হয়ে গেলেন। সেদিন বিকালে তিন বার ভাইকে ফোন দিয়ে না পেয়ে ব্যাগ নিয়ে তার অপেক্ষায় বসে থাকি। রাত নয়টায় খবর পেয়ে হাসপাতালে এসে ভাইয়ের লাশ দেখতে পাই। রাতেই উত্তরার একটি মসজিদে গোসল করাতে গিয়ে দেখি ভাইয়ের বুকের সামনে দিয়ে গুলির বড় গর্ত হয়ে পেছন দিক দিয়ে বের হয়েছে। কাপড় তুলতেই দুই দিক দিয়ে টপটপ করে রক্ত পড়ছে। দু-তিনটা রাইফেলের ক্ষত নীল জমাটবদ্ধ রক্ত।'
'আমার ভাইয়ের উপার্জনের টাকা দিয়ে ভাই-বোনের পড়াশোনাসহ অসুস্থ মায়ের খরচ চলত। ভাই আমাদের ছেড়ে চলে গেল। এখন আমাদের কি করে চলবে?'- প্রশ্ন আব্দুলস্নাহর।
ডা. সজীব সরকার নিহত হওয়ার ১২ দিনের অধিক সময় পার হলেও এখনও থামেনি স্বজনদের কান্না। উপার্জনের একমাত্র অবলম্বন সজীবের মৃতু্যতে এখন অথই সাগরে ভাসছে পুরো পরিবার।
নিহতের বাবা মো. হালিম সরকার (৫৮) বলেন, 'ওরা কেন আমার ছেলেটাকে কেড়ে নিল? আমার ছেলে তো কারও ক্ষতি করেনি। আমি এখন কার কাছে বিচার চাইব? আমার সজীবকে তোমরা এনে দাও।'
সজীবের কবরের পাশে দাঁড়িয়ে বিলাপ করতে করতে হালিম সরকার বলেন, 'ছেলেকে খুব কষ্ট করে ঢাকার উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে পঞ্চম থেকে এইচএসসি পর্যন্ত পড়াশোনা করাই। পরে টঙ্গীর বেসরকারি তাইরুন্নেছা মেমোরিয়াল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তাকে ভর্তি করাই। গত ২০২০ সাল থেকে এমবিবিএস পাস করে চিকিৎসক হন। তাকে চিকিৎসক বানাতে গিয়ে দিতে হয়েছে সর্বত্র, ঋণে হতে হয়েছে জর্জরিত। ইদানীং সে আমার এই ঋণগ্রস্ত পরিবারের হাল ধরেন। তার উপার্জনে আমার অসুস্থ স্ত্রীর চিকিৎসা ও ভাই-বোনের পড়াশোনাসহ কিছু কিছু করে ঋণ পরিশোধ করত। তাকে ঘিরে আমরা কতই না স্বপ্ন বুনেছিলাম। আমার ছেলের মৃতু্যতে আমার যে কত বড় ক্ষতি হয়েছে তা বলে বোঝাতে পারব না।'
'ছেলে আমার ছায়া ছিল, এখন আমার সব শেষ। আমি আওয়ামী লীগের একজন নগন্য কর্মী হিসেবে ও মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সন্তান হিসেবে রাষ্ট্রের কাছে এটাই কি আমার প্রাপ্য ছিল।'-প্রশ্ন রেখে তিনি বলেন, 'আমি শত কান্নাকাটি করলেও ছেলেকে আর ফিরে পাব না। আমরা চাই সঠিক তদন্ত সাপেক্ষে আমার ছেলে হত্যার বিচার। তাহলেই তার আত্মা ও আমরা শান্তি পাব।'