দেশে নদীভাঙনে উদ্বাস্তু হচ্ছেন লাখো মানুষ
২২ বছরে পদ্মা ও যমুনার ভাঙনে ৫০ হাজার ৯৫৫ হেক্টর জমি বিলীন
প্রকাশ | ০৩ আগস্ট ২০২৪, ০০:০০
আলতাব হোসেন
নদ-নদীভাঙনে প্রতিবছর লক্ষাধিক মানুষ উদ্বাস্তু হচ্ছেন। প্রায় প্রতিবছরই বন্যার রেশ কাটতে না কাটতেই 'মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা'র হিসেবে আসে নদীভাঙন। বর্ষাকালজুড়েই চলছে ভাঙনের তান্ডবলীলা। প্রায় প্রতিদিনই দেশের বিভিন্ন নদীতীরবর্তী জনপদে নদীভাঙনের খবর পাওয়া যাচ্ছে। নদীভাঙন একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ। বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রায় ৩৫ হাজার হেক্টর জমি নদীভাঙনে বিলীন হচ্ছে। এতে নদীতীরে বসবাসকারী মানুষ গৃহ-ভূমিহীন হচ্ছেন। এসব পরিবার নিকটবর্তী বাঁধ, চর কিংবা শহরের বস্তিতে বসবাস করছেন।
বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড, বিশ্বব্যাংক, ইউএসএআইডিসহ বিভিন্ন সংস্থার এক গবেষণায় বলা হয়েছে, নদীভাঙনের কবলে পড়ে প্রতিবছর বাংলাদেশে সহায় সম্বল হারিয়ে উদ্বাস্তু হচ্ছেন লাখ লাখ মানুষ। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের প্রায় ৬০ থেকে ৮০ লাখ মানুষ নদীভাঙনের শিকার হয়েছেন। সেই সঙ্গে দুই হাজার বর্গকিলোমিটারেরও বেশি এলাকা বিলীন হয়েছে নদীতে। বর্তমানে প্রতিবছর নদীভাঙনে গৃহহীন উদ্বাস্তু মানুষের সংখ্যা দুই থেকে আড়াই লাখ হারে বাড়ছে। এতে বছরে ৩০০ থেকে ৫০০ কোটি টাকার সম্পদের ক্ষতি হচ্ছে। তবে সামগ্রিকভাবে অর্থনৈতিক ক্ষতির পরিমাণ এক হাজার কোটি টাকার বেশি।
বাংলাদেশ একটি সক্রিয় বদ্বীপ। এ দেশকে বলা হয় নদীমাতৃক দেশ। বাংলাদেশের মোট আয়তনের প্রায় ৮০ ভাগই নদনদী অববাহিকার অন্তর্ভুক্ত। দেশের অন্যতম নদী পদ্মা, যমুনা, ব্রহ্মপুত্র, কালীগঙ্গা, ধলেশ্বরী, মেঘনা, আড়িয়াল খাঁ, ডাকাতিয়া, কীর্তনখোলা, কর্ণফুলী, সোমেশ্বরী কুশিয়ারা, সুরমা, তিস্তা, ঘাঘট, কংস, মাতামুহরী, সাঙ্গু, যমুনেশ্বরী, চিত্রা, গড়াই, দুধকুমার, মহানন্দা, করতোয়া ছাড়াও নদীবিধৌত বাংলাদেশের ছোট বড় নদনদীর সংখ্যা প্রায় ৩০০টি। এসব নদনদীর তটরেখার দৈর্ঘ্য প্রায় ২৪ হাজার ১৪ কিলোমিটার। এর মধ্যে কমপক্ষে প্রায় ১২ হাজার কিলোমিটার তটরেখা নদীভাঙনপ্রবণ হিসেবে চিহ্নিত।
চলতি বর্ষা মৌসুমে পদ্মা, যমুনা, মেঘনা, তিস্তা ও আড়িয়াল খাঁ নদীভাঙনে কুড়িগ্রাম, বগুড়া, জামালপুর, লালমনিরহাট, সিরাজগঞ্জ, পাবনা, টাঙ্গাইল, শরীয়তপুর ও মাদারীপুরসহ দেশের বিভিন্ন জেলার মানুষ আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন।
এরমধ্যে লালমনিরহাটে তিস্তা নদীতে ভাঙন দেখা দিয়েছে। বন্যার পানি নেমে যাওয়ার সাথে সাথে শুরু হয়েছে ভাঙন। প্রতিদিন বিলীন হচ্ছে ফসলি জমি ও বসতভিটাসহ বিভিন্ন স্থাপনা। আতঙ্কে নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছেন নদী পাড়ের বাসিন্দারা। জিও ব্যাগ ফেলে পানি উন্নয়ন বোডের্র ভাঙন রোধের প্রচেষ্টাও ব্যর্থ হচ্ছে। সদর উপজেলার খুনিয়াগাছ, রাজপুর, কালমাটি, হরিণচড়া; আদিতমারী উপজেলার মহিষখোচা, গোবর্ধন, কালিগঞ্জ উপজেলার ভোটমারী, বৈরাতি, হাতীবান্ধা উপজেলার সিন্দুনা, ডাওয়াবাড়ি; পাটগ্রাম উপজেলার দহগ্রামসহ অন্তত ১৫টি পয়েন্টে ভাঙন তীব্র আকার ধারণ করেছে।
গাইবান্ধায় চোখের পলকেই নদীগর্ভে চলে যাচ্ছে মাথাগোঁজার একমাত্র ঠিকানা। চেয়ে চেয়ে দেখা ছাড়া যেন কোনো উপায় নেই উত্তরের জনপদ গাইবান্ধার নদীপাড়ের বাসিন্দাদের। সুন্দরগঞ্জ, ফুলছড়ি ও সাঘাটা উপজেলার ব্রহ্মপুত্র নদ ও যমুনা নদীর তীরে তীব্র আকার ধারণ করেছে ভাঙন। গত এক সপ্তাহে সাঘাটা উপজেলার মুন্সিরহাট পয়েন্টে অন্তত দুই শতাধিক বাড়ি নদীতে বিলীন হয়েছে। এরই মধ্যে নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে কচুয়া, ভরতখালী, সাঘাটা, মুক্তিনগর, ঘুড়িদহ, হলদিয়া, জুমারবাড়ী ইউনিয়নের পাঁচ শতাধিক ঘরবাড়ি, মসজিদ, শত শত বিঘা আবাদি জমি, গাছপালাসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা। হুমকির মুখে রয়েছে মসজিদ, মাদ্রাসা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বাজার ও বসতবাড়িসহ বহু স্থপনা। ভাঙন ঠেকাতে বিভিন্ন পয়েন্টে বালুভর্তি জিও ব্যাগ ফেলানোর কাজ করছে পানি উন্নয়ন বোর্ড।
যমুনা নদীর পানি সিরাজগঞ্জ অরক্ষিত ও চরাঞ্চলে তীব্র ভাঙন শুরু হয়েছে। ভাঙনে বসতভিটা, মসজিদ, হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও ফসলি জমি বিলীন হয়ে যাচ্ছে। মানুষ নিঃস্ব হয়ে পড়ছে। অনেকে খোলা আকাশের নিচে মানবেতর জীবনযাপন করছে। জিওব্যাগ ও জিওটিউব ফেলে ভাঙনরোধের চেষ্টা করলেও কোনো কাজ হচ্ছে না।
শাহজাদপুর উপজেলার কৈজুরী ইউনিয়নে পাচিল, কৈজুরী, আড়কান্দি, সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার কাওয়াকোলার চর, কাজিপুর উপজেলার খাসরাজবাড়ীতে ব্যাপক ভাঙন দেখা দিয়েছে। ভাঙনে কাঁচা-পাকা বসতবাড়ি, ফসলি জমি, মসজিদ, হাসপাতাল, বিদু্যতের খুঁটি, গাছপালা বিলীন হয়ে যাচ্ছে। পাঁচিল গ্রামের বাসিন্দা জাফর মিয়া বলেন, বড় ভাঙন চলছে। চোখের সামনে চিরচেনা বসতভিটা ও ফসলি জমি বিলীন হয়ে যাচ্ছে। আমরা নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছি। মুহূর্তের মধ্যেই একটি পরিবার ফকির হয়ে যাচ্ছে।
সিরাজগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মাহবুবুর রহমান জানান, পাঁচিলসহ কয়েকটি পয়েন্টে ব্যাপক ভাঙন শুরু হয়েছে। আমরা জিও ব্যাগ ও জিও টিউব ফেলে ভাঙন রোধে চেষ্টা করছি। তিনি আরও জানান, ভাঙনরোধে স্থানীয় সংসদ সদস্য তানভীর শাকিল জয়ের সুপারিশে ১০ হাজার জিওব্যাগ ফেলানো হচ্ছে। এছাড়াও যমুনার যেসব পয়েন্টে ভাঙন অব্যাহত রয়েছে আমরা সাধ্যমতো ভাঙনরোধ করতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।
এদিকে ব্রহ্মপুত্র নদের তীব্র ভাঙনে নিঃস্ব হয়ে পড়েছে ময়মনসিংহের গৌরীপুর উপজেলার শতাধিক পরিবার। ভাঙনে বিলীন হয়ে যাচ্ছে শত শত একর ফসলি জমি, বসতভিটাসহ নানা স্থাপনা। সহায় সম্বল হারিয়ে রাস্তায় দিন যাপন করছেন উপজেলার পশ্চিম ভাটিপাড়া, উজান কাশিয়ার চর ও খোদাবক্সপুর গ্রামের মানুষ।
'পানি ও জীবন' ফাউন্ডেশনের সভাপতি পানি বিশেষজ্ঞ ড. সারোয়ার হোসেন জাকির বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশবিষয়ক সংস্থা নাসা এক গবেষণায় জানিয়েছে, প্রায় ৭০ হাজার হেক্টরের বেশি এলাকা পদ্মার ভাঙনে বিলীন হয়ে গেছে। পদ্মাকে পৃথিবীর সবচেয়ে ভাঙনপ্রবণ নদী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। পদ্মাপারের মানুষ সবচেয়ে বেশি ভাঙনের শিকার হয়েছেন। সবচেয়ে বেশি ভেঙেছে মাওয়া, শরীয়তপুর ও চাঁদপুর। জলবায়ুর প্রভাবে নদীভাঙন হযে উঠেছে এক নীরব ঘাতক। গত ২২ বছরে শুধু পদ্মা ও যমুনার ভাঙনে ৫০ হাজার ৯৫৫ হেক্টর জমি বিলীন হয়েছে, যা সেন্টমার্টিন দ্বীপের চেয়েও ৬ গুণ বড়। সেন্টার ফর অ্যানভায়রনমেন্ট অ্যান্ড জিওগ্রাফিক ইনফরমেশন সার্ভিসের (সিইজিআইএস) তথ্য অনুযায়ী, যমুনায় ২৫ হাজার ২৯০ হেক্টর ও পদ্মায় ২৫ হাজার ৬৬৫ হেক্টর জমি বিলীন হয়েছে। সিইজিআইএস বলছে, গত ২২ বছরে এই দুই নদীভাঙনে ৫ লাখেরও বেশি মানুষ উদ্বাস্তুতে পরিণত হয়েছেন।
সিইজিআইএসের উপদেষ্টা ড. মমিনুল হক সরকার বলেন, আমাদের নদীগুলোতে হিমালয় থেকে নেমে আসার সময় বিপুল পরিমাণ পলি নিয়ে আসছে। এতে নতুন চরভূমি তৈরি করছে এবং ভাঙন সৃষ্টি করছে। বিশ্বের আর কোনো দেশে এমন বৈশিষ্ট্য পাওয়া যায় না নদীভাঙনে। তিনি আরও বলেন, নদীভাঙনে উদ্বাস্তু মানুষের জন্য বাংলাদেশের একটি দীর্ঘমেয়াদি কৌশল প্রণয়ন করা প্রয়োজন। উন্নয়ন বিনিয়োগ ও ঝুঁকি হ্রাসের জন্য গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগের মাধ্যমে উদ্বাস্তুদের মূলধারায় ফিরিয়ে আনা সম্ভব।
এ বিষয়ে ন্যাচার কনজারভেশন ম্যানেজমেন্টের নির্বাহী পরিচালক ড. এস এম মনজুরুল হান্নান খান যায়যায়দিনকে বলেন, বাংলাদেশে নদীভাঙন প্রলয়ংকরী দুর্যোগের মতোই বিপজ্জনক। ভাঙনের তীব্রতায় অনেকে ভিটেমাটি-সহায় সম্বল হারিয়ে নিঃস্ব হয়েছেন। নদীভাঙনের কবলে পড়া জেলাগুলো হলো- বরিশাল, পিরোজপুর, পাবনা, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, নীলফামারী, জামালপুর, নেত্রকোনা, সিরাজগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, নোয়াখালী ও লক্ষ্ণীপুর। পদ্মা বিশ্বে আমাজানের পর দ্বিতীয় গতিশীল নদী। বিশেষ করে বর্ষাকালে এটি কোথায় কখন ভাঙন ঘটাবে, তার পূর্বানুমান সম্ভব নয়। যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশবিষয়ক সংস্থা নাসা এক গবেষণায় জানিয়েছে, প্রায় ৭০ হাজার হেক্টরের বেশি এলাকা পদ্মার ভাঙনে বিলীন হয়ে গেছে। পদ্মা-মেঘনা-যমুনা ছাড়াও কুশিয়ারা, ধরলা, তিস্তা, পায়রা, ডাকাতিয়া, করতোয়া, বড়াল, আড়িয়াল খাঁ, কর্ণফুলী, শঙ্খ, সোমেশ্বরী ও কংস নদে সারা বছর ধরেই ভাঙন চলতে থাকে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী পরিচালক (বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র) সরদার উদয় রায়হান যায়যায়দিনকে বলেন, বর্ষায় বা বন্যায় পানি মেনে যাওয়ার সময় নদীভাঙন তীব্র আকার ধারণ করে। নদীভাঙন রোধে সিইজিআইএস-এর সঙ্গে পরিকল্পনা করে আগাম সতর্কতা প্রদান করে কাজ করা হচ্ছে। নদী ও বাঁধ ভাঙনরোধে স্থায়ী বাঁধ নির্মাণের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। আমরা সারাদেশের নদীভাঙন কবলিত এলাকায় সিরাজগঞ্জ শহর রক্ষাবাঁধের (হার্ডপয়েন্ট) মতো বাঁধ নির্মাণ করার উদ্যোগ নিয়েছে পাউবো।