কোটা আন্দোলন

সহিংসতায় নিহতদের দুইজন কেরানীগঞ্জের

দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ ও কেরানীগঞ্জ মডেল থানায় দুটি মামলা হ গ্রেপ্তার ৩২, আতঙ্কে বিএনপি-জামায়াত

প্রকাশ | ০২ আগস্ট ২০২৪, ০০:০০

মাসুম পারভেজ, কেরানীগঞ্জ (ঢাকা)
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এবারের কোটা সংস্কার আন্দোলনের সূত্রপাত হলেও ঢাকার অদূরে কেরানীগঞ্জে ছিল না কোনো উত্তাপ। সেখানে ছাত্রলীগ ও আন্দোলনকারীদের কাউকেই গত ১৮ জুলাই, বৃহস্পতিবারের পর কোনো কর্মসূচিতে দেখা যায়নি। তবে কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে রাজধানীর লক্ষ্ণীবাজার, রায়সাহেব বাজার ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্নস্থানে বিক্ষোভ ও সংঘর্ষ হয়েছে। ১৯ জুলাই শিক্ষার্থীদের কর্মসূচি চলাকালে লক্ষ্ণীবাজার ও মোহাম্মদপুরে সহিংসতায় দুইজন নিহত হন। তাদের বাড়ি কেরানীগঞ্জে। এদিকে ১৮ জুলাই, কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের ডাকা কমপিস্নট শাটডাউনে উপজেলার কদমতলি, জিনজিরা ও জনী টাওয়ার এলাকায় ঐদিন ছাত্রদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষের ঘটনায় বিশেষ ক্ষমতা আইনে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানায় ৮৮ ও কেরানীগঞ্জ মডেল থানায় ৫২ জনসহ আরও অজ্ঞাতনামা আসামি করে দু'টি মামলা হয়। নাশকতা মামলায় জামায়াত-বিএনপি ও আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের আসামি করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন কেরানীগঞ্জ মডেল থানার ওসি মো. মোস্তফা কামাল ও দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানার ওসি মামুন-অর রশিদ। অন্যদিকে চলমান একাধিক মামলায় গ্রেপ্তার আতঙ্কে বিএনপি ও জামায়াতের নেতাকর্মীরা বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। এতে তাদের পরিবারের সদস্য ও স্বজনরা চরম উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় সময় পার করছেন। এমনটি জানিয়েছেন কেরানীগঞ্জ দক্ষিণ ও মডেল থানা বিএনপি-জামায়াতের নেতাকর্মীরা। এ বিষয়ে ঢাকা জেলা যুবদলের সাংগঠনিক সম্পাদক মোকাররম হোসেন সাজ্জাদ বলেন, 'মিথ্যা মামলায় কেরানীগঞ্জ দক্ষিণ ও মডেল থানা পুলিশ বিএনপি নেতাকর্মীদের বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার করছে। তারা অন্যায়ভাবে জুলুম অব্যাহত রেখেছে। দেশজুড়ে শিক্ষার্থীদের ন্যায্য দাবি কোটা সংস্কারের আন্দোলনের সঙ্গে জামায়াত-শিবির জড়িত না থাকলেও তাদের দাবির প্রতি পূর্ণ সমর্থন রয়েছে। দেশে এতগুলো মেধাবী শিক্ষার্থী ও সাধারণ নিরীহ জনগণকে হত্যা করে সরকার এখন বিরোধী দলের ওপর দায় চাপিয়ে নিজেদের অপরাধ আড়াল করতে চাইছে এবং আমাদের বিরুদ্ধে হয়রানিমূলক মামলা দিয়ে ঘরছাড়া করেছে।' কেরানীগঞ্জ সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (এসপি) শাহাবুদ্দিন কবির জানান, 'এ পর্যন্ত উপজেলার দক্ষিণ ও কেরানীগঞ্জ মডেল থানা ১৪০ জনের নাম উলেস্নখ করে অজ্ঞাতনামা আসামি করে দু'টি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় এখন পর্যন্ত গ্রেপ্তারকৃতদের তালিকায় রয়েছেন কেরানীগঞ্জের কলাতিয়া ইউনিয়ন জামায়াতের আমির (সভাপতি) নাজমুল হক, সাধারণ সম্পাদক আফ্রাহিম বাবুল, হজরতপুর ইউনিয়ন জামায়াতের আমির হাবিবুলস্নাহ মিয়া, সাধারণ সম্পাদক মোয়াজ্জেম হোসেন, রোহিতপুর ইউনিয়ন জামায়াতের আমির মো. কাওসার, তারানগর ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি আশ্রাফ ফারুকী, ঢাকা জেলা ছাত্রশিবিরের বিজ্ঞান ও শিক্ষা বিষয়ক সম্পাদক আ. কাদের জিলানী, ঢাকা জেলা শিবিরের এইচআরডি সম্পাদক নাজমুল হোসেন, জেলা বিএনপি নেতা আমিনুল ইসলাম, বাস্তা ইউনিয়ন যুবলীগের সাবেক সহ-সভাপতি মো. শামীমসহ ৩২ জন। ঘটনার সঙ্গে জড়িত বাকিদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। ছাড় দেওয়া হবে না কাউকে।' এদিকে ১৯ জুলাই পুরান ঢাকার লক্ষ্ণীবাজার এলাকায় আন্দোলনকারীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষে মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়ে নাদিমুল হাসান এলেন নামে একজন নিহত হন। তিনি দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের শুভাঢ্যা শান্তপাড়া গ্রামের শাহ আলমের ছেলে। অন্যদিকে ঢাকার মোহাম্মদপুরে রিয়াজ হোসেন নামে আরেকজন নিহত হন। তিনি কেরানীগঞ্জ মডেল থানার তারানগর ইউনিয়নের ছোট ভাওয়াল গ্রামের বাসিন্দা আসাব উদ্দিনের ছেলে। নিহত নাদিমের মা কিসমত আরা জানান, 'শেখ বোরহানউদ্দিন কলেজ থেকে তিন বছর আগে নাদিম উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে কিছুদিন বেকার ছিল। সম্প্র্রতি কদমতলি এলাকার লায়ন মার্কেটের একটি পোশাক দোকানে বিক্রেতা হিসেবে চাকরি নেয়। কোটা সংস্কার আন্দোলনের পক্ষে কথা বলত আমার ছেলে। ১৯ জুলাই, শুক্রবার জুমার নামাজের কথা বলে বাসা থেকে বের হয়ে আর বাসায় ফেরেনি। বিকালে ওর মোবাইলে ফোন দিলে অপরিচিত একজন জানায়, আমার কলিজার টুকরা নাকি গুলিবিদ্ধ হয়েছে। তখন নাদিমকে স্যার সলিমুলস্নাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আনা হয়।' কিসমত আরা অভিযোগ করে বলেন, 'হাসপাতাল-পুলিশ তাড়াহুড়ো করে লাশ নিয়ে দাফন করতে বলেন। পরে লাশ এনে বাড়ির পাশে দাফন করি। আমি খোঁজখবর নিয়ে জানতে পেরেছি পুলিশের গুলিতে আমার ছেলের মৃতু্য হয়েছে। আমি ছেলে হত্যার বিচার চাই।' তবে এ ব্যাপারে পরিবারের পক্ষ থেকে আইনি কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি বলে জানান নাদিমের মা। অন্যদিকে নিহত রিয়াজের বোন আফরোজা আক্তার জানান, 'বাবা ও দুই ভাই কৃষিকাজ করে কোনো রকম আমাদের সংসার চলত। সবার ছোট রিয়াজকে নিয়ে আমাদের অনেক স্বপ্ন ছিল। ওর ইচ্ছা ছিল পড়াশোনা শেষ করে সরকারি চাকরি করবে। ও বলত, এই আন্দোলন না করলে মেধাবীদের অনেকেই চাকরি পাবে না।' রিয়াজের মা শেফালী বেগম জানান, 'আমার কলিজার টুকরা সন্তান ইস্পাহানি কলেজে অর্নাস প্রথমবর্ষের শিক্ষার্থী ছিল। বাবার সঙ্গে কৃষিকাজের পাশাপাশি লেখাপড়া চালিয়ে যাচ্ছিল রিয়াজ। বাড়তি উপার্জনের আশায় কিছুদিন ধরে একটি কুরিয়ার সার্ভিসে ডেলিভারিম্যানের চাকরি নেয়। ইচ্ছে ছিল সরকারি চাকরিজীবী হওয়ার।'