জাপানি মা নাকানো এরিকোকে তার সঙ্গে থাকা বড় মেয়ে জেসমিন মালিকাকে নিয়ে বছরে দুইবার বাংলাদেশে এসে অন্তত ৫ দিন থাকতে হবে। তাদের এই আসা-যাওয়া ও থাকা-খাওয়ার খরচ বাবা ইমরান শরীফকে বহন করতে হবে।
বাংলাদেশে অবস্থানকালে প্রতিদিন জেসমিন মালিকাকে তার বাবার সঙ্গে সময় কাটানোর সুযোগ দেবেন মা এরিকো। একইভাবে বাংলাদেশে বাবার কাছে থাকা শিশু লাইলা লিনাকে মা এরিকোর সঙ্গে সময় কাটানোর সুযোগ দেবেন বাবা।
এছাড়া জাপানে থাকা দুই মেয়ে (বড় ও কনিষ্ঠ) ও বাংলাদেশে থাকা এক মেয়ে (মেজ)- এই তিন বোনকে সপ্তাহে একদিন ভিডিও কলে গল্প করার সুযোগ দিতে হবে।
হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে উভয়পক্ষের করা দুটি লিভ টু আপিলের অনুমতি দিয়ে বৃহস্পতিবার প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বে সাত বিচারপতির আপিল বেঞ্চ এ আদেশ দেয়।
একইসঙ্গে নাকানো এরিকোর বিরুদ্ধে ইমরান শরীফের করা আদালত অবমাননার অভিযোগ অকার্যকর ঘোষণা করা হয়েছে।
জাপানি মা নাকানো এরিকোর পক্ষে ছিলেন আইনজীবী আজমালুল হোসেন কেসি ও শিশির মনির। বাংলাদেশি বাবা ইমরান শরীফের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী আখতার ইমাম। তাকে সহযোগিতা করেন আইনজীবী রাশনা ইমাম।
পরে শিশির মনির বলেন, 'হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আমাদের দুই পক্ষকেই আপিল করার অনুমতি দিয়েছেন। এখন আমরা আপিল করব। আর এরিকোর বিরুদ্ধে অবমাননার আবেদন অকার্যকর ঘোষণা করা হয়েছে।'
বাংলাদেশি প্রকৌশলী ইমরান জাপানে অবস্থানকালে ২০০৮ সালে জাপানি চিকিৎসক নাকানোকে বিয়ে করেন। টোকিওতে এক যুগের দাম্পত্য জীবনে তারা তিন মেয়ের বাবা-মা হন।
দাম্পত্য কলহের জেরে ২০২১ সালের ১৮ জানুয়ারি বিচ্ছেদের আবেদন করেন নাকানো। এরপর স্কুলবাসে করে বাড়ি ফেরার পথে বাস স্টপেজ থেকে ইমরান বড় দুই মেয়েকে একটি ভাড়া বাসায় নিয়ে যান বলে নাকানোর ভাষ্য।
ওই বছর ২৮ জানুয়ারি সন্তানদের জিম্মা চেয়ে টোকিওর পারিবারিক আদালতে মামলা করেন নাকানো। আর ইমরান ২১ ফেব্রম্নয়ারি বড় ও মেজ মেয়েকে নিয়ে বাংলাদেশে চলে আসেন। ছোট মেয়ে থেকে যায় জাপানে।
মেয়েদের ফিরে পেতে করোনাভাইরাস মহামারির মধ্যে ২০২১ সালের জুলাই মাসে বাংলাদেশে আসেন নাকানো। তিনি হাইকোর্টে রিট আবেদন করলে তাদের সমঝোতায় আসতে বলেন বিচারক।
কিন্তু ওই দম্পতি সমঝোতায় না আসায় কয়েক মাস ধরে শুনানির পর ওই বছরের ২১ নভেম্বর হাইকোর্ট দুই সন্তানকে বাবার হেফাজতে রাখার সিদ্ধান্ত দেয়। পাশাপাশি মা যাতে সন্তানদের সঙ্গে দেখা করতে পারেন, তা নিশ্চিত করতে বাবাকে খরচ দিতে বলা হয়।
ওই রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে আবেদন করেছিলেন মা নাকানো। পরে আপিল বিভাগ ওই বছর ১৫ ডিসেম্বর এক আদেশে শিশু দুটিকে মায়ের জিম্মায় রাখার নির্দেশ দিলেও বাবা তা না মানায় বিচারকরা উষ্মা প্রকাশ করেন।
পরে আদালত শিশু দুটিকে বাবার হেফাজত থেকে এনে তাদের সঙ্গে কথা বলে এবং মায়ের হেফাজতে দেওয়ার আদেশ দেয়।
এরপর আপিল বিভাগ সিদ্ধান্ত দেয়, দুই মেয়ে কার জিম্মায় থাকবে তার নিষ্পত্তি পারিবারিক আদালতে হবে এবং তার আগ পর্যন্ত দুই শিশু মায়ের কাছেই থাকবে। ২০২২ সালের ১৩ ফেব্রম্নয়ারি ওই রায় দেওয়ার পর আপিল বিভাগ থেকে মামলাটি পারিবারিক আদালতে যায়।
পরের বছর ২৯ জানুয়ারি ইমরান শরীফের করা মামলা খারিজ করে দিয়ে দুই শিশুকে মা নাকানোর জিম্মায় রাখার সিদ্ধান্ত দেন ঢাকার দ্বিতীয় অতিরিক্ত সহকারী জজ ও পারিবারিক আদালতের বিচারক দুরদানা রহমান।
ওই রায় চ্যালেঞ্জ করে ঢাকার জেলা জজ আদালতে আপিল করেন ইমরান। ১৬ জুলাই তা খারিজ হয়ে গেলে তিনি যান হাইকোর্টে।
চলতি বছর ১৩ ফেব্রম্নয়ারি হাইকোর্ট সিদ্ধান্ত দেয়, বড় মেয়ে জেসমিন মালিকা ও ছোট মেয়ে সোনিয়া থাকবে তাদের মা নাকানোর কাছে। আর মেজ মেয়ে লাইলা লিনা থাকবে বাবা ইমরানের কাছে। তবে বাবা ও মা দু'জনই চাইলে তাদের সব সন্তানের সঙ্গে দেখা করার সুযোগ পাবেন।
রায়টি প্রকাশ হওয়ার পর বাবা ও মা আপিল বিভাগে পৃথক আপিল আবেদন করেন। ইমরান তাদের বড় মেয়েকে তার কাছে চেয়ে এবং নাকানো মেজ মেয়েকে চেয়ে লিভ টু আপিল আবেদন করেন।
এর মধ্যে ইমরানের করা একটি নিষেধাজ্ঞার আবেদনও ছিল। যেখানে বলা হয়, মেয়েকে যেন দেশের বাইরে না নেওয়া হয়।
ওই আবেদনের ওপর ৯ এপ্রিল আপিল বিভাগের চেম্বার জজ আদালত শুনানির জন্য গত ১৫ এপ্রিল ঠিক করে স্থিতাবস্থার আদেশ দেন। কিন্তু এর মধ্যে বড় মেয়েকে নিয়ে নাকানো জাপানে চলে যান।
ওইদিন ইমরানের আইনজীবী রাশনা ইমাম বলেছিলেন, সন্তানদের দেশের বাইরে যেতে আদালতের স্থিতাবস্থা ছিল। তারপরও বড় সন্তানকে নিয়ে নাকানো চলে গেছেন। এ কারণে আদালত অবমাননার আবেদন করা হয়েছে।
দুটি লিভ টু আপিল ও একটি অবমাননার আবেদনের শুনানি একসঙ্গে হয়।