ভারী বর্ষণে ডুবল চট্টগ্রাম ভোগান্তিতে নগরবাসী

ঢাকায় ৬ ঘণ্টায় ১৩ মিলিমিটার বৃষ্টি সাতক্ষীরায় বেড়িবাঁধে ফাটল, পস্নাবনের শঙ্কা বান্দরবানে পাহাড়ে ধস, নিম্নাঞ্চল পস্নাবিত দুই শতাধিক পরিবার পানিবন্দি

প্রকাশ | ০২ আগস্ট ২০২৪, ০০:০০

যাযাদি ডেস্ক
বুধবার রাত থেকে থেমে থেমে হওয়া বৃষ্টিতে চট্টগ্রামে সৃষ্ট জলাবদ্ধতায় ভোগান্তিতে পড়েন নগরবাসী। ছবিটি বৃহস্পতিবার তোলা -ফোকাস বাংলা
সক্রিয় মৌসুমি বায়ুর কারণে গত দুইদিন ধরে দেশের বিভিন্ন এলাকায় স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত হচ্ছে। ভারী বর্ষণে ইতোমধ্যে পস্নাবিত হয়েছে দেশের বিভিন্ন এলাকার নিম্নাঞ্চল। এর মধ্যে দুই দিনের বর্ষণে চট্টগ্রাম নগরীর নিম্নাঞ্চল তলিয়ে গেছে। বান্দরবানে ঘটেছে পাহাড় ধসের ঘটনা। এছাড়া টানা বর্ষণে জেলার নিম্নাঞ্চল পস্নাবিত হয়েছে। পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন দুই শতাধিক পরিবার। এদিকে, টানা বর্ষণে সাতক্ষীরায় কপোতাক্ষের বেড়িবাঁধে ফাটল দেখা দিয়েছে। পস্নাবনের শঙ্কায় আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন স্থানীয়রা। অন্যদিকে বৃহস্পতিবার দুপুর ১২টা পর্যন্ত ৬ ঘণ্টায় রাজধানীতে ১৩ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করেছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। বৃহস্পতিবার সকালে আবহাওয়া অধিদপ্তরের পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, এমন বৃষ্টিপাত আরও দুই দিন চলতে পারে। এরপর দিন কয়েকের বিরতিতে আবার বৃষ্টি শুরু হতে পারে। চট্টগ্রাম বু্যরো জানায়, বুধবার রাত থেকে থেমে থেমে হওয়া বৃষ্টিপাত বৃহস্পতিবার ভোরের দিকে ভারী বর্ষণে রূপ নেয়। আর তাতেই চট্টগ্রাম নগরীর নিম্নাঞ্চল তলিয়ে গেছে। এতে কর্মস্থলে যাওয়ার পথে লোকজনকে ভোগান্তিতে পড়তে হয়েছে। জলমগ্ন এলাকায় যানবাহন চলাচলে ব্যাঘাত ঘটছে। এছাড়া বৃষ্টিতে পাহাড়ধসের সতর্কবার্তা থাকলেও পাহাড় ছেড়ে কেউ আশ্রয় কেন্দ্রে যায়নি। বৃহস্পতিবার দুপুর ১২টা পর্যন্ত গত ২৪ ঘণ্টায় ১৪৯ দশমিক ৬ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে চট্টগ্রামে। এর আগে সকাল ৯টা পর্যন্ত আগের ২৪ ঘণ্টায় ১১৪ দশমিক ৬ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত, ভোর ৬টা থেকে সকাল ৯টা পর্যন্ত ৬২ মিলিমিটার এবং ভোর ৬টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত ৩৬ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়। সরেজমিন দেখা গেছে, চট্টগ্রাম নগরের আকবরশাহ, ঝাউতলা, দুই নম্বর গেট, মুরাদপুর, ষোলশহর, রহমান নগর, চকবাজার, ডিসি সড়ক, কে বি আমান আলী সড়ক, বাকলিয়া, বহদ্দারহাট, মেহেদীবাগ, চান্দগাঁও আবাসিক এলাকা, প্রবর্তক মোড়, কাপাসগোলা, কাতালগঞ্জ, আগ্রাবাদ সিডিএ আবাসিক, হালিশহরসহ বিভিন্ন এলাকায় গোড়ালি থেকে হাঁটুসমান পানিতে রাস্তা তলিয়ে গেছে। এর ফলে গাড়ি চলাচলও বাধাগ্রস্ত হয়। ভোগান্তিতে পড়েন পথচারী। নগরীর বহদ্দারহাটের বাসিন্দা জাহেদুল ইসলাম বলেন, 'দুপুরে জরুরি কাজে চকবাজার যাওয়ার জন্য বাসা থেকে সড়কে গিয়ে দেখি গোড়ালি পর্যন্ত পানি জমে আছে। আর খাল-নালা পরিষ্কার না করায় বৃষ্টির পানি নামতে পারছে না।' নগরের মুরাদপুর এলাকার আরেক বাসিন্দা মেহেরাব হোসেন যায়যায়দিনকে বলেন, 'বৃষ্টি হলে আমাদের এলাকায় পানি উঠে যায়। পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা উন্নত না হওয়ায় জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করেও কোনো যানবাহন না পেয়ে হেঁটেই গন্তব্যে যাচ্ছি।' জানা যায়, চট্টগ্রাম নগরের জলাবদ্ধতা নিরসনে চারটি বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে সরকার। ২০১৪ সাল থেকে বিভিন্ন সময়ে শুরু হওয়া এসব প্রকল্পে সরকারের ব্যয় হচ্ছে ১০ হাজার ৮০৩ কোটি টাকা। চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (চউক), চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন (চসিক) ও পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) এসব প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। কিন্তু বড় বড় প্রকল্প হাতে নেওয়া হলে নগরবাসীর জলাবদ্ধতার ভোগান্তি দূর হয়নি। উল্টো দিন দিন সমস্যা প্রকট হয়েছে। চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত স্থায়ী কমিটির সভাপতি কাউন্সিলর মোবারক আলী বলেন, 'ভারি বৃষ্টি হওয়ায় খাল-নালা দিয়ে পানি দ্রম্নত প্রবাহিত হতে পারছে না। এর ফলে অনেক এলাকা তলিয়ে গেছে। সিটি কর্পোরেশনের একাধিক টিম এলাকাগুলোতে গিয়ে কাজ করছে। তারা যেখানে পানি আটকা পড়ছে, সেখানে বাধা অপসারণ করে প্রবাহ স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করছে।' পতেঙ্গা আবহা অফিসের সহকারী আবহাওয়াবিদ আলী আকবর খান বলেন, 'উত্তর বঙ্গোপসাগর ও তৎসংলগ্ন বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকায় বায়ু চাপের তারতম্যের আধিক্য বিরাজ করছে। এর প্রভাবে উত্তর বঙ্গোপসাগর এলাকায় গভীর সঞ্চালনশীল মেঘমালা তৈরি অব্যাহত রয়েছে। এর কারণেই মাঝারি থেকে ভারী বৃষ্টি হচ্ছে চট্টগ্রামে। আরও দুই একদিন এমন বৃষ্টি অব্যাহত থাকার সম্ভাবনা রয়েছে।' ভারী বর্ষণের কারণে চট্টগ্রাম নগরী ও জেলায় পাহাড়ধসের আশঙ্কা রয়েছে বলে জানানো হয়েছে প্রশাসনের পক্ষ থেকে। নগরের লালখান বাজার টাংকির পাহাড়ের পাদদেশে গড়ে ওঠা বাসা ছেড়ে কিছু বাসিন্দা লালখান বাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় আশ্রয়কেন্দ্রে গেলেও অধিকাংশ বাসিন্দা পাহাড় ছেড়ে আশ্রয় কেন্দ্রে যায়নি। বান্দরবান প্রতিনিধি জানান, দুই দিনের টানা বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে জেলার নাইক্ষ্যংছড়ির মিয়ানমারের সীমান্তবর্তী এলাকা ঘুমধুম ও তুমব্রম্ন বাজারসহ ৫ গ্রাম পস্নাবিত হয়েছে। তুমব্রম্ন খালে ভেসে গিয়ে নিখোঁজ রয়েছেন মো. ইমরান নামে পঞ্চম শ্রেণির একজন শিক্ষার্থী। ঘুমধুমের প্রধান সড়ক তলিয়ে যাওয়া ও বেশ কিছু এলাকায় সড়ক ভেঙে যাওয়ায় সীমান্ত সড়কের এ অংশে সব ধরনের যান চলাচলে কিঘ্ন ঘটছে। বর্ষণ অব্যাহত থাকায় বৃদ্ধি পেয়েছে লামার মাতামুহুরী নদী ও আলীকদমের চৈক্ষ্যং খালের পানি। রেফার পাড়া এলাকায় নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় তলিয়ে গেছে প্রধান সড়ক। ফলে বন্ধ হয়ে গেছে লামা- আলীকদম ও চকরিয়া সড়কে যান চলাচল। অন্যদিকে বৃহস্পতিবার সকালে বান্দরবান-থানচি সড়কের জীবননগর এলাকায় পাহাড়ের বিশাল একটি অংশ সড়কের ওপর ধসে পড়ে। এতে বান্দরবানের সঙ্গে থানচির যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। তবে সড়কে যান চলাচল স্বাভাবিক রাখতে কাজ করছে ফায়ার সার্ভিস ও সেনাবাহিনীর সদস্যরা। এছাড়াও পস্নাবিত হয়েছে নিম্নাঞ্চলের বেশ কয়েকটি গ্রাম, তলিয়ে গেছে অভ্যন্তরীণ সড়ক। পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটেছে বিভিন্ন এলাকায়। তবে কোথাও কোনো হতাহতের খবর পাওয়া যায়নি। বান্দরবান ফায়ার সার্ভিসের সহকারী পরিচালক পূর্ণচন্দ মুৎসুদ্দি জানান, 'পাহাড় ধস হওয়ায় সেনাবাহিনীর সহায়তায় তারা কাজ করছেন। মাটি অপসারণ করা হলে যোগাযোগ স্বাভাবিক হবে। এদিকে পাহাড় ধসে প্রাণহানি ঠেকাতে পাহাড়ের পাদদেশে বসবাসকারীদের সরে যেতে প্রশাসনের পক্ষ থেকে মাইকিং করা হচ্ছে। বান্দরবানের জেলা প্রশাসক শাহ্‌ মোজাহিদ উদ্দিন বলেন, এখন পর্যন্ত বড় ধরনের কোনো ক্ষয়ক্ষতির খবর আমরা পাইনি।' বান্দরবান আবহাওয়া অধিদপ্তরের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সনাতন কুমার মন্ডল বলেন, 'মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে বঙ্গোপসাগরে সঞ্চালনশীল মেঘমালা সৃষ্টি অব্যাহত থাকার কারণে দেশের বিভিন্ন জেলায় বৃষ্টিপাত হচ্ছে। যা আরও কয়েকদিন হতে পারে। এ ছাড়া গত ২৪ ঘণ্টায় ১০৪ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে।' নাইক্ষ?্যংছ?ড়ি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. জাকা?রিয়া বলেন, 'ইতোম?ধ্যে পস্না?বিত এলাকা পরিদর্শন ক?রে?ছি। জেলা প্রশাসন সার্বক্ষ?ণিক তা?দের খোঁজখবর রাখ?ছে। আমি জেলা ত্রাণ শাখায় কথা বলে?ছি। তা?দের (পানিবন্দি) যতটুকু সম্ভব সহযোগিতা ক?রে যা?চ্ছি।' সাতক্ষীরা প্রতিনিধি জানান, টানা বৃষ্টি ও জোয়ারের কারণে নদীতে পানি বাড়ায় সাতক্ষীরার শ্যামনগরের গাবুরায় কপোতাক্ষ নদের বেড়িবাঁধে ফাটল দেখা দিয়েছে। এতে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন স্থানীয়রা। গাবুরার বাসিন্দা ওয়ায়েস কুরুনী জানান, বৃহস্পতিবার সকালে দ্বীপ ইউনিয়ন গাবুরার ৪নং ওয়ার্ডের ৩নং গাবুরা নামক স্থানে ১০০ ফুটের মতো জায়গাজুড়ে বেড়িবাঁধে ফাটল দেখা দিয়েছে। তাৎক্ষণিক বিষয়টি কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে। দ্রম্নত পদক্ষেপ না নিলে বাঁধ ভেঙে বিস্তীর্ণ এলাকা পস্নাবিত হওয়ার শঙ্কা রয়েছে। গাবুরা ইউপি চেয়ারম্যান মাসুদুল আলম বলেন, 'বাঁধ ফাটলের বিষয়টি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি। তারা দ্রম্নত সংস্কারের আশ্বাস দিয়েছে।' শ্যামনগরে পানি উন্নয়ন বোর্ডের ১৫নং পোল্ডারে দায়িত্বরত উপসহকারী প্রকৌশলী সাজ্জাদ হোসেন বলেন, 'আমরা জানতে পেরে দ্রম্নত জিও টিউব দিয়ে বাঁধের ফাটল রোধের পরিকল্পনা নিয়েছি। আজই কাজ শুরু হবে।'