রাজধানীর লাখো মানুষের পথ চলার কষ্ট লাঘব করা মেট্রোরেলের কার্যক্রম বীমার আওতায় ছিল না; ফলে কোটা সংস্কার আন্দোলনের মধ্যে হামলা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগের ক্ষতির জন্য মিলবে না কোনো ক্ষতিপূরণ।
আইন অনুযায়ী সরকারি প্রতিষ্ঠানের বীমা করে থাকে সাধারণ বীমা করপোরেশন। কিন্তু মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ সাধারণ বীমা করপোরেশনে বীমা করেনি বলে জানিয়েছেন বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের (আইডিআরএ) মুখপাত্র ও পরিচালক জাহাঙ্গীর শাহ।
সাধারণ বীমা করপোরেশনের কর্মকর্তারা বলছেন, পদ্মা সেতু, কর্ণফুলী টানেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ সরকারি স্থাপনা বীমার আওয়তায় আনা হলেও মেট্রোরেলের ক্ষেত্রে তা হয়নি।
জানতে চাইলে করপোরেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. হারুন-অর-রশিদ বলেন, ' মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ প্রজেক্ট চলাকালে বীমা করেছিল। কিন্তু মেট্রোরেল অপারেশনকে বীমার আওতায় আনেনি। যেহেতু অপারেশনকে বীমার আওতায় আনা হয়নি, তাই কোনো রকম ক্ষতিপূরণ পাবে না। বীমা করা থাকলে ক্ষতিপূরণ পাওয়া যেত।'
তিনি আরও বলেন, 'বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ) ও সাধারণ বীমা করপোরেশন (এসবিসি) সব সময় সরকারি স্থাপনা এবং ঝুঁকি যেখানে আছে, সেখানে বীমা করার জন্য তাগিদ করে। কিন্তু আমাদের দেশে অনেক জায়গায় ঝুঁকি থাকার পরেও বীমা করে না। বিদেশে সব রকম স্থাপনা বীমার আওতায় আনা হয়।'
২০১৯ সালের বীমা আইন বলছে, সরকারি সম্পত্তি অথবা সরকারি সম্পত্তি সংশ্লিষ্ট কোনো ঝুঁকি বা দায় সম্পর্কিত সকল প্রকার নন লাইফ বীমা ব্যবসায় ১০০ শতাংশ করবে সাধারণ বীমা করপোরেশন। এরপর এ ব্যবসা থেকে ৫০ শতাংশ নিজের কাছে রেখে বাকি ৫০ শতাংশ সব বেসরকারি নন লাইফ বীমা কোম্পানির মধ্যে সমহারে বণ্টন করবে।
এ আইনে আরও বলা হয়েছে, সরকারের সরাসরি নিয়ন্ত্রণ কিংবা সংরক্ষণ রক্ষণাবেক্ষণের দায় সরকারের। এছাড়া সরকারি বা স্থানীয় কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রণে থাকা কোনো কোম্পানি, খামার, প্রতিষ্ঠান, সংগঠন বা অন্য কোনো স্থাপনার বীমা সাধারণ বীমা করপোরেশন করবে। তবে সরকারি সম্পত্তি বীমার আওয়তায় আনার বাধ্যবাধকতা রেখে কোনো সুনির্দিষ্ট আইন এখনো নেই।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, সরকারি-বেসরকারি যে কোনো প্রতিষ্ঠান, যেখানে ঝুঁকি রয়েছে, সেখানে অবশ্যই বীমার সুরক্ষা থাকা উচিত।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান মো. মিজানুর রহমান বলেন, মেট্রোরেলের মতো একটি স্থাপনায় ঝুঁকি থাকবেই। সে কারণে মেট্রোরেলকে অবশ্যই বীমার আওতায় আনা উচিত ছিল। তিনি আরও বলেন, 'মেট্রোরেল যদি আজ বীমার আওতায় থাকত, তাইলে ক্ষতিপূরণ পাওয়া যেত।'
শিক্ষার্থীদের ডাকা 'কমপিস্নট শাটডাউন' কর্মসূচির মধ্যে গত ১৮ জুলাই মেট্রো লাইনের নিচে মিরপুর-১০ গোলচত্বরে ফুটব্রিজে পুলিশ বক্সে আগুন দেওয়া হয়। সেই আগুনের মধ্য দিয়েই একটি ট্রেন ছুটে যায়। পরে চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়।
পরদিন সন্ধ্যায় মিরপুর-১০ ও কাজীপাড়া স্টেশনে ব্যাপক ভাঙচুর চালায় একদল মানুষ। তারা টিকেট ভেন্ডিং মেশিন, মূল স্টেশনে যাত্রী প্রবেশের পাঞ্চ মেশিনসহ সব কিছু ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয়। ওইদিন পলস্নবী ও ১১ নম্বর স্টেশনেও হামলা হয়।
বেশি ক্ষতিগ্রস্ত কাজীপাড়া ও মিরপুর-১০ স্টেশন মেরামতে এক বছর সময় লেগে যাবে বলে গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন মেট্রোরেল পরিচালনাকারী সংস্থা ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এমএএন ছিদ্দিক। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ক্ষতিগ্রস্ত অনেক যন্ত্রপাতিই মেরামতযোগ্য অবস্থায় নেই। এগুলো নতুন করে আমদানি করতে হবে।
মেট্রোরেলের ক্ষতি নিরূপণে অতিরিক্ত সচিব মো. জাকারিয়াকে প্রধান করে আট সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। তারা এখনও পূর্ণাঙ্গ হিসাব শেষ করেননি। তবে প্রাথমিক হিসাবে ক্ষতির অংক ৫০০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে বলে কর্মকর্তাদের ধারণা।
বীমা করা থাকলে এই অর্থের দায় বহন করত বীমা কোম্পানি। কিন্তু মেট্রোলের ক্ষেত্রে তা হবে না।
বেসরকারি খাতের বীমা কোম্পানি চার্টার্ড লাইফের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) এসএম জিয়াউল হক বলেন, ' যেখানে জনসম্পৃক্ততা থাকে, সেখানে ঝুঁকি থাকে। আর যেখানে ঝুঁকি থাকে, সেখানে অবশ্যই কর্তৃপক্ষকে বীমা করতে হবে। কিন্তু আমাদের দেশে এসব ঠিক মতো করা হয় না। মেট্রোরেলের মতো সরকারি স্থাপনা বীমার আওতায় আনা উচিত ছিল।'
পদ্মা সেতু, বঙ্গবন্ধু টানেলের বীমা করা থাকলে মেট্রোরেলের কেন করা হয়নি, তা জানতে চাওয়া হয়েছিল ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেডের (ডিএমটিসিএল) ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) এমএন ছিদ্দিকের কাছে।
উত্তরে তিনি বলেন, 'এ বিষয়ে আমরা সামনে কথা বলব। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে আমরা আপনাদের জানাব। অন্যান্য দেশের মেট্রোরেলে বীমা করা থাকে কিনা সেটা আগে একটু খোঁজ নিন।'
আর ডিএমটিসিএল এর সচিব মোহাম্মদ আবদুর রউফ বলেন, 'যেহেতু অপারেশন বীমার আওতায় নেই, তাই অর্থ পাওয়া যাবে কি না আমি বলতে পারছি না। তবে এ বিষয় নিয়ে আমরা পর্যালোচনা করব। মেট্রোরেলের পুরো কার্যক্রম আগামী বছর কমলাপুর রেল স্টেশন পর্যন্ত করা হবে। পুরো কাজ শেষ হওয়ার পর বীমার আওতায় আনা হবে।'