উচ্ছেদ অভিযান চালিয়েও দখলমুক্ত করা যাচ্ছে না ঢাকার কেরানীগঞ্জ এলাকার ফুটপাত। কেরানীগঞ্জের কদমতলিতে একদিকে ফুটপাত দখল করে গড়ে ওঠা অবৈধ স্ট্যান্ড ও স্থাপনা উচ্ছেদ করা হচ্ছে। অন্যদিকে আবার সেগুলো দখল হয়ে যাচ্ছে। উচ্ছেদ অভিযানের নামে দিনের পর দিন এভাবেই চলছে ভাঙা-গড়ার খেলা।
জানা যায়, কেরানীগঞ্জ উপজেলার ব্যস্ততম কদমতলি এলাকার সড়কের দুই পাশে ফুটপাত দখল করে ব্যবসা করছেন হকাররা। কদমতলি দিয়ে নবাবগঞ্জ-দোহার, ফরিদপুর, মাদারীপুরসহ দক্ষিণাঞ্চলের লাখো মানুষের পদচারণা। দিন-রাত সবসময়ই মানুষে ভরপুর থাকে ফুটপাত ও রাস্তাঘাট। কেরানীগঞ্জ দক্ষিণ ও মডেল থানার প্রচেষ্টায়ও অবৈধ দখলমুক্ত হচ্ছে না এই এলাকার ফুটপাত। সম্প্রতি পুলিশও নিয়মিত অভিযান চালিয়ে তাদের সরিয়ে দেয়। কিন্তু পুলিশ যাওয়ার পরপরই আবার দখল হয়ে যাচ্ছে ফুটপাত।
ভ্রাম্যমাণ ব্যবসায়ী ও গাড়িচালকরা জানিয়েছেন, পুলিশ দেখলেই তারা গলির ভেতর চলে যান। কিন্তু উচ্ছেদের পরদিনই ব্যবসায়ীরা নিজ নিজ জায়গায় অস্থায়ী দোকান বসিয়ে ফের ব্যবসা শুরু করেন। বর্তমানে সড়কের দুই পাশ আগের সেই অবস্থাতেই ফিরে গেছে। পথচারীরা ফুটপাত ব্যবহার করতে পারছেন না।
স্থানীয়দের অভিযোগ, ক্ষমতাসীন দল, প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বেশকিছু দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তার সদিচ্ছা না থাকায় এসব ফুটপাত দখলমুক্ত করা যাচ্ছে না।
উপজেলার লায়ন শপিংমল সড়ক এলাকার হকার সুমন হাওলাদার (৪২) বলেন, 'পুলিশ-ম্যাজিস্ট্রেট আসার খবর পাইলেই ফুটপাত থাইকা মালামাল বস্তায় তুইলা দৌঁড়াইয়ে ইবনে সিনা গলির ভিতরে চলে যাই। প্রশাসন পুলিশ চলে গেলে আবারও মালামাল নিয়ে ফুটপাতে আইসা ভ্যানগাড়িতে করে বেচাকেনা করি। এ রকম কইরে দিনেরাতে দুই তিনবার মালামাল নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করতে হয়। পুলিশ আইসে মালামাল রাস্তায় নাইলে ফেইলাও দেয়। ফুটপাতে ঠিকমতো বসতে না পারায় বেচাকেনা করতে পারছি না।'
উচ্ছেদের পরও কেন আবার সড়কে এসে বসেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'কই যামু। ঢাকায় থাকতে অইলে কিছু একটা কইরা তো খাইতে অইব। উচ্ছেদ অইলে আবারও বহনের লেইগা কিছু বেশি ট্যাকা দিতে অয়।' কাকে এই টাকা দিতে হয় জানতে চাইলে তিনি কোনো মন্তব্য করেননি।
কদমতলি সারা কমিউনিটি সেন্টার সড়কে মৌসুমি ফল ব্যবসায়ী ফিরোজ রশীদ বলেন, পুলিশের অত্যাচারে আম, কাঁঠাল ও আনারস বেচাবিক্রি করতে পারছি না। বেচাবিক্রির মধ্যে পুলিশ আসলে পালাতে হয়। তখন ক্রেতারাও বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়ে। বাজারে সবকিছু দাম বৃদ্ধি, কীভাবে চলব যদি ব্যবসা করতে না পারি। ছেলেমেয়েদের স্কুলে কীভাবে পড়াব আর সংসার কীভাবে চলবে।
এদিকে সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, ঢাকার বাবুবাজার সেতু পার হয়ে কেরানীগঞ্জের কদমতলি মূল সড়ক সিএনজি, অটোরিকশা, ব্যাটারিচালিত ভ্যান, পিকআপ ও বাসট্যান্ডের দখলে। ফুটপাতজুড়েই গিজগিজ করছে বিভিন্ন ধরনের ভ্রাম্যমাণ দোকান। পথচারীদের হাঁটার জায়গা দখল করে নানা ধরনের পসরা সাজিয়ে বসেছেন ব্যবসায়ীরা। ফুটপাত দিয়ে হাঁটার মতো কোনো পরিস্থিতি নেই। তাই পথচারীরা বাধ্য হয়ে চলাচলের জন্য ব্যবহার করছেন মূল সড়ক। ফলে যানবাহন চলাচলে বিঘ্ন ঘটছে, সৃষ্টি হচ্ছে যানজট। সেই সঙ্গে প্রতিনিয়ত পথচারীরা দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক হকার জানান, এসব ফুটপাতে ব্যবসা করতে হলে প্রত্যেক হকারকেই ১০ হাজার থেকে লাখ টাকা পর্যন্ত এককালীন দিতে হয়। এরপর দৈনিক ১০০-৫০০ টাকা পর্যন্ত চাঁদা দিতে হয়। চাঁদা না দিলে ফুটপাতে ব্যবসাও করা যায় না; যার একটি বড় অংশ পায় স্থানীয় পুলিশ প্রশাসন।
বাবুবাজার সেতুর একাধিক পথচারী বলেন, কদমতলি এলাকার ফুটপাত দখল থাকায় সড়ক দিয়ে চলাচল করতে হয়; যা পথচারীদের জন্য খুবই বিপজ্জনক। বেশির ভাগ সময় সড়কে প্রচন্ড যানবাহনের চাপ থাকে। তাই সড়ক দিয়েও চলাচল করা যায় না। ফুটপাত দিয়ে হাঁটার সময় বহু মানুষের ধাক্কা খেতে হয়। বিশেষ করে নারী পথচারীদের বিড়ম্বনার শিকার হতে হয়।
ফুটপাত দখল করে থাকা এক দোকানি সালাম মিয়া বলেন, 'টাকা দিয়ে দোকান বসাইছি, আবার প্রতিদিন চাঁদাও দিতে হয়।'
পিকআপ ড্রাইভার আব্দুল ছালাম বলেন, উপজেলার ট্রাক রাখার কোনো জায়গা না থাকায় তারা বাধ্য হয়ে সড়কটি ব্যবহার করছেন। সরকার ট্রাকস্ট্যান্ড তৈরি করে দিলেই তারা আর সড়কে ট্রাক রাখবেন না বলে জানান তিনি। এ বিষয়ে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানা অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মামুন-অর রশিদ বলেন, 'পথচারীদের চলাচলের জন্য ফুটপাত দখলমুক্ত রাখতে থানা পুলিশ সব সময়ই তৎপর। শিগগিরই আমরা আবার ফুটপাত অভিযানে যাব এবং সব সময় মনিটরিং করা হবে; যাতে আবার ফুটপাত দখল না হয়।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আবু রিয়াদ জানান, 'কেরানীগঞ্জের সবচেয়ে ব্যস্ততম সড়ক কদমতলি যানজট থেকে মুক্ত করতে আমাদের অভিযান চলমান রয়েছে। আমরা বিভিন্ন সড়কে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করেছি। এ কারণে একটু সময় লাগছে। আমাদের উচ্ছেদের পর পুনরায় কেউ বসলে মালামাল নিয়ে আসা হবে। অবৈধ স্ট্যান্ডের বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়া হবে। যেহেতু, আমাদের অভিযান চলমান থাকবে, তাই পুনরায় দখলের চেষ্টা করা বৃথা হবে। আরও কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হবে।