বিকল্প চান উদ্যোক্তারা

ইন্টারনেট বস্ন্যাকআউটে দেশের প্রযুক্তি খাতে 'অপূরণীয়' ক্ষতি

প্রকাশ | ৩১ জুলাই ২০২৪, ০০:০০

যাযাদি ডেস্ক
কোটা সংস্কার আন্দোলনের মধ্যে ব্যাপক সহিংসতার ঘটনায় ইন্টারনেট বন্ধে যে বাণিজ্যিক ক্ষতি হয়েছে, সেই অভিজ্ঞতা থেকে দেশের সংকটকালেও নিরবচ্ছিন্ন ইন্টারনেট নিশ্চিতের দাবি জানিয়েছেন তথ্যপ্রযুক্তি খাতের উদ্যোক্তা ও ফ্রিল্যান্সাররা। তাদের ভাষ্য, নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি বা ঘোর বিপদের সময় সোস্যাল মিডিয়াকে নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজন থাকতে পারে। কিন্তু সেটি করতে গিয়ে পুরো ইন্টারনেট ব্যবস্থাই অকার্যকর হলে প্রযুক্তি খাতের 'অপূরণীয়' ক্ষতি হবে। সফটওয়্যার নির্মাতা ও রপ্তানিকারকদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেসের (বেসিস) সভাপতি রাসেল টি আহমেদ বলেন, 'সোস্যাল মিডিয়া বন্ধ রেখেও বিজনেস ইন্টারনেট খোলা রাখার বিষয়ে গাইডলাইন তৈরি ও ডেভেলপ করার সময় এসেছে। আমরা বেসিস থেকে এরকম একটি গাইডলাইন দেব। সেখানে নেটওয়ার্ক টপোলজি, ইন্টারনেট প্রটোকল বিষয়ে আমাদের মতামত থাকবে। এভাবে বিচ্ছিন্ন না হয়েও কীভাবে আমরা কাজ করতে পারি, সেজন্য আমরা একটা প্রস্তাব তৈরি করে কর্তৃপক্ষকে দেব।' কোটা সংস্কার আন্দোলনের পস্ন্যাটফর্ম বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকে 'কমপিস্নট শাটডাউন' কর্মসূচিতে দেশজুড়ে সংঘাত-সহিংসতা ছড়িয়ে পড়লে গত ১৭ জুলাই রাতে মোবাইল ইন্টারনেট সেবা বন্ধ করে দেওয়া হয়। পরদিন রাতে বন্ধ হয়ে যায় ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট পরিষেবাও। তাতে বিপদে পড়েন তথ্যপ্রযুক্তি নির্ভর উদ্যোক্তা, ব্যবসায়ী ও মুক্ত পেশাজীবী বা ফ্রিল্যান্সাররা। ইন্টারনেট বন্ধ থাকায় আর্থিক ক্ষতির পাশাপাশি কাজ হারানোর শঙ্কাও তৈরি হয়েছে। ইন্টারনেট বস্ন্যাকআউটে মোবাইলে আর্থিক লেনদেন, বিদু্যৎ-গ্যাসের প্রিপেইড কার্ড রিচার্জ নিয়ে চরম ভোগান্তিতে পড়েন গ্রাহকরা। কোথাও কোথাও ব্যাংকের এটিএম বুথও বন্ধ হয়ে যায়। ইন্টারনেট না থাকায় স্থবির হয়ে পড়ে ই-কমার্স, পোশাক খাতসহ বিভিন্ন ব্যবসা-বাণিজ্য; বন্ধ থাকে বন্দরের কার্যক্রম। বেসিসের সাবেক সভাপতি একেএম ফাহিম মাশরুর বলেন, 'দেশের অনেক স্টার্টআপে বিদেশি বিনিয়োগ আসত। এখন দেশের যে পরিস্থিতি, সেখানে সেসব বিনিয়োগ আর আসবে কি না, সে ব্যাপারে খুবই সংশয় রয়েছে। ইন্টারনেট না থাকায় দুই জায়গায় বড় ধরনের আশঙ্কার ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে। এক এক্সপোর্ট কমে যাবে। আর প্রক্রিয়াধীন বিনিয়োগগুলো পাওয়া কিংবা নতুন করে বিদেশি বিনিয়োগ নিয়ে আসার বিষয়টি সহজ হবে না।' বিডিজবসের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মাশরুর বলেন, 'ইন্টারনেট বন্ধ থাকায় কত টাকার এক্সপোর্ট করতে পারিনি, সেটা বড় ক্ষতি নয়। বরং ইন্টারনেট বন্ধ থাকায় কী পরিমাণ ব্যবসা হারিয়েছে বাংলাদেশ বা আগামী দিনগুলোতে কী ধরনের ব্যবসা হারানার ঝুঁকি তৈরি হলো, সেটা নিয়ে ভাবতে হবে। ভবিষ্যতের ক্লায়েন্ট যারা হয়তো আগামী ৪-৫ বছর কাজ দিত, তারা না থাকলে সেই কাজটার সুযোগ নষ্ট হলো; আবার নতুন ক্লায়েন্ট পাওয়ার পথও বন্ধ হলো। দেশের আইটি খাতের যে সুনাম তৈরি হয়েছিল, সেটা থাকল না।' দেশের বাইরে থিতু হওয়ার ভাবনা :ইন্টারনেট বন্ধ থাকার সময় সীমিত পরিসরে নিজেদের কার্যক্রম চালিয়ে নিতে অনেক প্রতিষ্ঠান বাধ্য হয়ে কর্মীদের বিদেশে পাঠিয়েছে। ইউরোপ-আমেরিকায় সফটওয়্যার সেবা দিয়ে থাকে- এমন একটি দেশি কোম্পানির এক কর্মকর্তা জানালেন, উদ্ভূত পরিস্থিতিতে তারা কয়েকজন ডেভেলপারকে নেপালে পাঠিয়েছেন। ইন্টারনেট নিয়ে এবারের তিক্ত অভিজ্ঞতার কারণে বাংলাদেশি অনেক ডেভেলপার দেশের বাইরে থিতু হওয়ার কথা ভাবছেন। নিজের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে এক ফ্রিল্যান্সার বলেন, 'কন্ট্রাকচুয়াল লজিস্টিক ও সাপস্নাই চেইন কনসালট্যান্ট হিসেবে একটা বিদেশি কোম্পানিতে কাজ করি। ওই কোম্পানিতে আমার সিদ্ধান্তগুলো বেশ গুরুত্ব বহন করে। ইন্টারনেট বন্ধ হওয়ার কারণে আমি একটা প্রজেক্টের ডেডলাইন মিস করি। আর সময়মতো সিদ্ধান্ত দিতে না পারায় চীন থেকে জার্মানিতে প্রোডাক্ট দিতে হয় এয়ার শিপমেন্টের মাধ্যমে- কোম্পানির জন্য এটি বড় ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।' এই মুক্ত পেশাজীবী বলেন, 'পাঁচদিন পর (ব্রডব্যান্ড) ইন্টারনেট ফিরে পেয়ে নিজেকে আবিষ্কার করি বেশ বিব্রতকর অবস্থায়। কোম্পানির সঙ্গে আলাপের এক পর্যায়ে কন্ট্রাক্ট টার্মিনেট করার সিদ্ধান্তে উপনীত হই। এটা এমন না যে- আমার ইকনোমিক্যালি মারাত্মক ক্ষতি হয়েছে। তবে ইন্ডাস্ট্রিতে একটা বাজে রেপুটেশন তৈরি করেছে। পরিচিত অনেককেই দেখলাম ইমার্জেন্সি দুবাই বা নেপাল যেতে। এটা দেশের উদীয়মান আইটি খাতের জন্য বিশাল একটা বাধা বলে মনে করি।' ইন্টারনেট বিঘ্নিত হওয়ায় উদ্যোক্তারা ভিন্ন পথে হাঁটতে বাধ্য হবেন বলে মনে করেন বেসিসের সাবেক সভাপতি ফাহিম মাশরুর। তিনি বলেন, 'অনেকেই তাদের ব্যবসা চালু রাখতে ঢাকায় কিছু লোক রাখবে। আর বড় অংশ পাঠিয়ে দেবে বিদেশে। এই প্রক্রিয়াটাও সহজ নয়, এতে ব্যবসার খরচ অনেক বেড়ে যাবে। আবার অনেকেই দেশে থেকে বিদেশি ক্লায়েন্টদের কাজ করত- তারা আর দেশে থাকবে না। আরও বেশি ব্রেইন ড্রেইন হবে।' ক্ষতি কতটা পোষানো যাবে? এদিকে, ইন্টারনেট বন্ধ থাকায় যে ক্ষতি হয়েছে, তা পুষিয়ে নেওয়া অনেক কঠিন হবে বলে মনে করেন বেসিসের সাবেক সভাপতি ও বিডিজবসের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) একেএম ফাহিম মাশরুর। তিনি বলেন, 'তথ্যপ্রযুক্তি খাতে যারা কাজ করে এবং যারা এক্সপোর্ট মার্কেটের সঙ্গে জড়িত, বাংলাদেশে এ ধরনের ৫ থেকে ১০ হাজারের মতো কোম্পানি বা ব্যবসা রয়েছে। কয়েক লাখ ফ্রিল্যান্সার আছে। এদের বেশিরভাগ কাজ অনলাইনে হয়; সবসময় ইন্টারনেটে সংযুক্ত থাকতে হয়। ১ বা ২ ঘণ্টা হলে ক্লায়েন্টদের বোঝানো যায়, কিন্তু পাঁচ দিন ইন্টারনেট না থাকার বিষয়টি বুঝিয়ে বলা কঠিন। আবার ইন্টারনেট যে অবস্থায় ফিরেছে, তাতে এখনো ভালো করে কাজ করতে পারছে না অনেকেই। ছোট ছোট কোম্পানিগুলো ২০-৩০ পার্সেন্ট ক্লায়েন্ট এরই মধ্যে হারিয়ে ফেলেছে। আবার অনেকেরই ভবিষ্যতে কন্ট্রাক্ট হয়তো আর রিনিউ হবে না।' ইন্টারনেট বন্ধের সময় ক্ষতির পরিমাণ জানতে চাইলে বেসিস সভাপতি রাসেল টি আহমেদ বলেন, 'এক্সপোর্ট মার্কেটে সব সময় লাইভ থাকতে হয়। এক সেকেন্ড বন্ধ মানে এক সেকেন্ডের ক্ষতি। এসব কাজে ঘণ্টা হিসেবে মূল্য ধরা হয়। এখন যখন ইন্টারনেট ফেরত এল, আমরা কথা বলে সেটা কাটিয়ে ওঠার জায়গা তৈরির চেষ্টা করব। কিন্তু আশঙ্কার জায়গা হলো- সেসব ক্লায়েন্ট থাকবে কি না বা আমাদের সঙ্গে কতটুকু ব্যবসা কমিয়ে ফেলবে। এর বাইরে রয়েছে স্থানীয় বাজারে আমাদের ব্যবসার পরিধি।' ই-কমার্স খাতে প্রতিদিন লেনদেন হয় ৩৫ কোটি টাকার, তা পুরোপুরি বন্ধ ছিল উলেস্নখ করে বেসিস সভাপতি বলেন, 'আবার ই-কমার্সের একটি বড় জায়গা হলো ফেসবুক পস্ন্যাটফর্মকে ব্যবহার করে অনলাইনভিত্তিক যেসব ব্যবসা গড়ে উঠেছে সেই এফ-কমার্স। ইন্টারনেট চালু থাকলেও যদি এফ-কমার্সও বন্ধ থাকে তার প্রভাব থেকে যাবে।' তথ্যপ্রযুক্তি খাতের জন্য ইন্টারনেটকে 'অক্সিজেন' হিসেবে বর্ণনা করে সফটওয়্যার কোম্পানি ব্রেইন স্টেশন টোয়েন্টিথ্রির সিইও রাইসুল কবির বলেন, 'এটা ছাড়া এ খাতের কোনো কিছু একেবারেই সম্ভব না। এর অভাবে আমাদের এত প্রচন্ড ক্ষতি হয়েছে, যা বলে বোঝানো যাবে না। আমাদের ওপর অনেক কোম্পানির আস্থা ও বিশ্বাসের জায়গাটায় চিড় ধরেছে। ভবিষ্যতে আমাদের কাজ দিতে পারবে কি না সে বিষয়টি তাদের সামনে এসেছে।' রাইসুল কবির বলেন, 'আগামীতে বিদেশি কোনো কোম্পানির সঙ্গে পার্টনারশিপের উদ্যোগ নিতে হবে আমাদের- এ ধরনের পরিস্থিতিতে যাতে তাদের সঙ্গে মিলে কাজ ডেলিভারি করতে পারি। তবে সেক্ষেত্রে ওই কোম্পানির সঙ্গে রেভিনিউ শেয়ার করতে হবে। আর এর প্রভাব পড়বে আমাদের ফরেন কারেন্সি আয়ের ওপর।' বিপিও খাতের ক্ষতির কথা বলতে গিয়ে বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব কন্টাক্ট সেন্টার অ্যান্ড আউটসোর্সিংয়ের (বাক্য) সভাপতি ওয়াহিদ শরীফ বলেন, 'ইন্টারনেট বন্ধের কারণে তথ্যপ্রযুক্তি নির্ভর আমাদের ব্যবসার ক্ষতির পরিমাণটা একটু বেশিই। আমাদের সব সার্ভিসই বন্ধ ছিল। এখন ইন্টারনেট চালু হলেও কতজন ক্লায়েন্ট ধরে রাখতে পারব, সেটা বুঝতে একটু সময় লাগবে। আবার নতুন করে ইমেজ তৈরি করতে, ব্র্যান্ডিং করতে অনেক সময় লাগবে।' ওয়াহিদ শরীফ বলেন, কাজ শুরুর পর প্রধান চ্যালেঞ্জ হলো, আন্তর্জাতিক ক্লায়েন্টেদের বোঝানো যে এরকম পরিস্থিতি আর হবে না; বা হলেও প্রস্তুতি আছে। সেটা তাদের সামনে তুলে ধরতে হবে। এজন্য নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে বসে একটি পূর্ণাঙ্গ গাইডলাইন বা করণীয় নির্ধারণ করতে হবে। তিনি আরও বলেন, 'অনলাইনের ব্যবসা পরিচালিত হয় বিশ্বাসের ওপর, সেই বিশ্বাস প্রশ্নের মুখে পড়লে ব্যবসা চালিয়ে যাওয়া কঠিন। এখন আবার নতুন করে সেই বিশ্বাসের জায়গা তৈরি করতে হবে। দুই মিলিয়ন ডলার প্রতিদিন রপ্তানি হতো, সেটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। লোকাল মার্কেটের ক্ষতির পরিমাণ এখনো নির্ণয় করা সম্ভব হয়নি।' জোর 'ডেডিকেটেড' ইন্টারনেটে ইন্টারনেট বস্ন্যাকআউটের ঘটনায় প্রযুক্তি খাতে সম্প্রতি যে অচলাবস্থা তৈরি হয়, তার পুনরাবৃত্তি ঠেকাতে বিজনেস ইন্টারনেট চালুর দাবি জানিয়েছেন এ খাতের কর্ণধাররা। ইন্টারনেট সেবাদাতাদের সংগঠন ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (আইএসপিএবি) সভাপতি ইমদাদুল হক বলেন, 'করপোরেট সেক্টরের জন্য আলাদা ব্যাকআপ পোল তৈরি করা অসম্ভব কিছু নয়। এটা আমরা আইএসপিএবি সদস্যরাই করতে পারি। আমাদের ওই ধরনের ফ্যাসিলিটিও আছে। আমাদের একটা শিক্ষাও হলো, ভবিষ্যতে আমরা ওভাবে চিন্তা করব।' দেশে নিরবচ্ছিন্ন ইন্টারনেটের জন্য 'বিজনেস ইন্টারনেট' চালু করতে সব ধরনের সহযোগিতার প্রতিশ্রম্নতি দিয়েছেন বেসিস সভাপতি রাসেল টি আহমেদও। রোববার ঢাকার বিনিয়োগ ভবনে প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের দপ্তরে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে এক মতবিনিময় সভাতেও বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়। বিদু্যৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ, বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম টিটু, ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক ছিলেন ওই বৈঠকে। বৈঠকের পর প্রতিমন্ত্রী পলক সাংবাদিকদের বলেন, 'ইন্টারনেট কানেকটিভিটি কোনো কারণে বন্ধ হয়ে গেলেও ব্যবসা পরিচালনার জন্য যাতে নিজস্ব ইন্টারনেট তৈরি করা যায়, সে বিষয়ে অনেকেই পরামর্শ দিয়েছেন, আমরাও সে বিষয়টি নিয়ে ভাবছি। ভবিষ্যতে এ বিষয়ে কর্মপরিকল্পনা করা হবে।' সূত্র বিডিনিউজ