কোটা আন্দোলনে সহিংসতা

হাসপাতালে পর্যাপ্ত ওষুধ পাচ্ছেন না আহতরা

প্রকাশ | ৩১ জুলাই ২০২৪, ০০:০০

পাঠান সোহাগ
কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে রাজধানীতে সংঘর্ষ ও সংঘাতে আহত ছয় হাজার ৭০৩ জন ঢাকার ৩১টি সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন। এসব রোগী ১৬-২২ জুলাইয়ের মধ্যে হাসপাতালে এসেছেন। এসব রোগীর অনেকেই হাসপাতালে নিজেদের প্রয়োজনীয় ওষুধ পায়নি। শুধুমাত্র সেলাইন ও কিছু ইনজেকশন পেলেও বাকি ওষুধ বাহির থেকে কিনতে হয়েছে। গত দুই সপ্তাহের বিভিন্ন সময় রাজধানীর বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালে গিয়ে রোগী, রোগীর স্বজন, নার্স ও চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্য পাওয়া গেছে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রোগীর স্বজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঢাকা মেডিকেল পরিদর্শনে গেলে তাদের ১০ হাজার টাকা করে দেন। এছাড়া রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির পক্ষ থেকে কিছু খাদ্যসামগ্রী দেওয়া হয়েছে। এর বাইরে আর কোনো ধরনের সহযোগিতা পাননি তারা। রোগীর স্বজনরা জানান, হাসপাতাল থেকে শুধুমাত্র সেলাইন ও কিছু ইনজেকশন পেলেও বাকি ওষুধ বাহির থেকে কিনতে হয়েছে। লাইফ সাপোর্টে থাকা অবস্থায় কোনো কোনো দিন চার থেকে ছয় হাজার টাকার ওষুধ লেগেছে। এত টাকার ওষুধ কিনতে গিয়ে ধারদেনা করতে হয়েছে। সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, ঢাকা মেডিকেল কলেজের ১০২ নম্বর ওয়ার্ডে ভর্তি আছেন মিরপুরের বাসিন্দা অটোরিকশা চালক শেখ বাদশার ছেলে ২২ বছরের মো. আকাশ। চিটাগাং রোডের সাইনবোর্ড এলাকায় গার্মেন্টস কারখানায় কাজ করতেন। স্ত্রী-সন্তান নিয়ে যাত্রাবাড়ী এলাকায় থাকতেন। ১৯ জুলাই কাজ শেষে বাড়ি ফেরার পথে গুলিবিদ্ধ হন আকাশ। তার বাবা শেখ বাদশা বলেন, '১২ দিন ধরে হাসপাতালে, আমিও কোনো কাজ করতে পারছি না। হাতে কোনো টাকা নেই। গার্মেন্টস কারখানা থেকে কেউ খোঁজও নেয়নি। এই কদিনে অনেক ওষুধ বাহির থেকে কিনতে হয়েছে। এখন আত্মীয়স্বজনই ভরসা।' তিনি বলেন, 'তলপেটের ডান পাশে গুলি আটকে ছিল। হাসপাতালের চিকিৎসকরা সেটা বের করেছেন। এখন পর্যন্ত অবস্থার কোনো উন্নতি হয়নি। প্রতিদিন রক্ত কিনে দিতে হচ্ছে। এত রক্ত কিনে দেওয়া যায়।' ১০১ নম্বর ওয়ার্ডের ১৯ নম্বর শয্যায় চিকিৎসাধীন আছেন রাজধানীর শনির আখড়ার ১৪ বছর বয়সের সুমন মিয়া। গত ২০ জুলাই পুলিশের সঙ্গে গোলাগুলির সময় গুলি লাগে, গুলি তলপেট লেগে পেছন দিয়ে বের হয়ে যায়। গুলি খেয়ে কয়েক ঘণ্টা রাস্তায় পড়ে ছিল সুমন। পরে এলাকার লোকজন হাসপাতালে নিয়ে আসেন। সুমনের মা শেফালি বেগম বলেন, 'ছেলের উপার্জনে সংসার চলত। এখন হাতে কোনো টাকা-পয়সা নেই। প্রধানমন্ত্রীর ১০ হাজার টাকা পেয়েছি। ধারদেনা ও কিছু ওষুধ কিনতে টাকা শেষ। এত অল্প টাকা দিয়ে কতদিন চলে। প্রতিদিনই নতুন নতুন ওষুধ লিখে দেয় ডাক্তার, তা কিনে না আনলে নার্সরা বকাঝকা করেন।' ঢামেকের ১০১ নম্বর ওয়ার্ডে ভর্তি আছেন গুলিবিদ্ধ লিটন। ১৯ জুলাই কোটা সংস্কার আন্দোলনে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার সময় রামপুরা ফ্লাইওভারের মুখে গুলিবিদ্ধ হন। পরে তাকে ঢাকা মেডিকেলে নেওয়া হয়। লিটনের বোন মিতু বলেন, 'পেটে নাভির কাছ দিয়ে গুলি লেগে বেরিয়ে গেছে। ৮ দিন লাইফ সাপোর্টে ছিল। কয়েকদিন আইসিউতেও ছিল। অবস্থার কিছুটা উন্নতি হলে ওয়ার্ডে দেওয়া হয়। আমরা ওষুধ কিনতে কিনতে দিশেহারা। লাইফ সাপোর্টে থাকা অবস্থায় প্রতিদিন পাঁচ হাজার টাকার ওষুধ কিনতে হয়েছে। মাত্র ১০ হাজার টাকা সহায়তা পেয়েছি।' শুধু আকাশ, সুজন কিংবা লিটন নয় তাদের মতো অনেক দরিদ্র পরিবারের সন্তান ঢাকা মেডিকেলের বিভিন্ন ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন। বেশিরভাগ রোগীর অবস্থাই একই। হাসপাতাল থেকে কিছু ওষুধ দেওয়া হলেও বেশিরভাগই বাইরে থেকে কিনতে হচ্ছে। এছাড়া পরীক্ষা-নিরীক্ষাও করতে হচ্ছে বাইরের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক সার্জন ডা. মো. আলাউদ্দিন যায়যায়দিনকে বলেন, 'আহত রোগীর চিকিৎসায় হাসপাতাল থেকে বিনামূল্যে ওষুধ দেওয়া হয়েছে। তবে যেসব ওষুধের সাপস্নাই নেই, সেসব ওষুধ রোগীদের বাহির থেকে কেনা লাগছে।' ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ছাড়াও রাজধানীর জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠান বা পঙ্গু হাসপাতাল, জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট হাসপাতাল, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ঘুরে একই চিত্র দেখা গেছে।