কারও পায়ে গুলি, কারও পেটে গুলি। কারও ভেঙে গেছে হাড়, কেউ দেখছে না চোখে। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের বিভিন্ন ওয়ার্ডের চিত্র এটি। কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আহতরা যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছে শিক্ষার্থী, মেসের কর্মচারী, ডেকচি ধোয়া, মোটর মেকানিক, রাজমিস্ত্রি ও মাদ্রাসার শিক্ষক। সবারই শারীরিক যন্ত্রণার পাশাপাশি রয়েছে মানসিক উদ্বেগ ও চিকিৎসা ব্যয়ের চিন্তা। চমেক হাসপাতালে শুধু আহতদের কান্নায় নয়, মর্গেও দেখা যায় নিহত স্বজনদের আহাজারি।
চট্টগ্রামে কোটা সংস্কার আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ হয়ে চমেক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন ইয়াস শরীফ খান (১৭)। তার বাঁ পায়ে গুলি লেগেছে এবং সুস্থ হতে আরও কিছুদিন সময় লাগবে। গত ১৬ জুলাই ইসলামিয়া ডিগ্রি কলেজে একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি হন ইয়াস। কিন্তু বাবাকে ফাঁকি দিয়ে দুই দিন পর চলে যান আন্দোলনে।
ইয়াস শরীফ খান বলেন, 'গত ১৮ জুলাই বহদ্দারহাট এলাকায় সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হই। পায়ে গুলি লাগার সঙ্গে সঙ্গে জ্ঞান হারাই। জ্ঞান ফেরার পর দেখি আমি পা নাড়াতে পারছি না।'
ইয়াস শরীফ খানের বাবা এজাজ খান জানান, 'ইয়াসের বাঁ পায়ে গুলি লেগেছে। চমেক হাসপাতালের অর্থোপেডিক বিভাগে অস্ত্রোপচার হয়েছে তার। কিন্তু সুস্থ হতে আরও কিছুদিন সময় লাগবে। ফুটবল খেলার কথা বলে চলে যায় আন্দোলনে। আমি জানলে তাকে কোনোভাবেই যেতে দিতাম না। স্ত্রীকে হারানোর শোক কাটতে না কাটতেই ছেলের এই দুর্ঘটনায় আমাকে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে তুলেছে।'
১৪ বছর বয়সি সুজন। কাজ করেন মেসে। তার বাঁ পায়ে গুলি লেগেছে। এই কিশোরের মা নুরুন্নাহার ছেলেকে রক্তাক্ত অবস্থায় হাসপাতালে দেখে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন।
নুরুন্নাহার বলেন, 'ছেলে গুলি খেয়েছে শুনে হাসপাতালে ছুটে আসি। দেখি রক্তে ভেসে যাচ্ছে। এখন কবে ছেলেকে সুস্থ করতে পারব, তা জানি না।'
১৮ বছরের আকাশ কাজ করেন নগরের মুরাদপুর এলাকার একটি গ্যারেজে। ১১ দিন ধরে চমেক হাসপাতালের ক্যাজুয়ালটি বিভাগে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন
আকাশ। তার বাবা এনাম গ্যারেজ মিস্ত্রি। বাবাকে সহায়তার আশায় মুরাদপুরে একটি গ্যারেজে কাজ শিখছিলেন আকাশ।
মো. এনাম বলেন, 'আকাশের অপারেশনের জন্য ৩০-৩৫ হাজার টাকা খরচ হয়ে গেছে। আত্মীয়-স্বজনের কাছ থেকে ঋণ নিয়েছি। সঙ্গে আছে ওষুধের দাম। ছেলে কখন সুস্থ হয়ে উঠবে- জানি না।'
চমেক হাসপাতালের ক্যাজুয়ালটি ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন মো. ওসমান (৩৪) মাগরিবের নামাজ পড়ে বের হয়ে দুই পক্ষের সংঘর্ষের মধ্যে পড়ে যান। পেটে গুলি লাগে তার। পেটে গুলিবিদ্ধ হওয়া ডেকচি ধোয়ার কাজ করা আরমানও (১৭) একই ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন রয়েছেন।
রাজমিস্ত্রি রুবেল (২২) শ্রমিকদের মজুরি দিতে যাওয়ার পথে গুলিবিদ্ধ হন। পকেটে থাকা ৩৬ হাজার টাকা ও মুঠোফোন হারিয়েছেন তিনি। চিকিৎসা ব্যয় ও হারানো টাকার চিন্তায় দিশেহারা রুবেলের মা হাজেরা বেগম।
এ ছাড়া গত ১৬ ও ১৮ জুলাই মুরাদপুর ও বহদ্দারহাটে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষের সময় আহত হয়ে চিকিৎসাধীন রয়েছেন আবুল বাশার (২৬), জয়নাল হক (২০) ও নাজমুল হোসেন (২৪)। দুই দিনের সংঘর্ষে এখন পর্যন্ত ৭ জন মারা গেছেন।
নিহতরা হলেন- কক্সবাজারের পেকুয়া উপজেলার ওয়াসিম আকরাম (২২), একই জেলার মহেশখালী উপজেলার তানভীর আহমেদ (২২), বরিশালের ফয়সাল আহমেদ (২০), আসবাবশ্রমিক মো. ফারুক (৩২), সন্দ্বীপের হারামিয়া ইউনিয়নের শিকদার বাড়ির সায়মন (১৪) এবং পটুয়াখালীর মির্জাগঞ্জ উপজেলার হৃদয় চন্দ্র তরুয়া।
কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে সৃষ্ট সহিংসতায় আহত আবদুল মজিদ (২০) নামে এক পরিবহণ শ্রমিক গত শুক্রবার ভোরে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের আইসিইউতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। এর আগে ১৮ জুলাই চাঁদপুরে আহত হওয়ার পর উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল।
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের তথ্য অনুযায়ী ১৬ ও ১৮ জুলাই চট্টগ্রামে দুদিনের সংঘর্ষে প্রায় আড়াইশ জন আহত ব্যক্তি চিকিৎসা নিয়েছেন সরকারি এ হাসপাতালে। এদের মধ্যে গুলিবিদ্ধ ছিলেন অন্তত ৪০ জন। ১৮ জুলাই এক দিনেই চমেক হাসপাতালে ভর্তি করা হয় ৭৬ জনকে। এর মধ্যে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় ভর্তি করা হয় ৩০ জনকে। আহতদের মধ্যে ৮ জন পুলিশ, ১০ পথচারী ছাড়া বাকিরা ছিলেন শিক্ষার্থী।
চমেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ তসলিম উদ্দীন খান বলেন, সংঘর্ষের ঘটনায় পাঁচজনকে নিহত অবস্থায় হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়, যার চারজন ছিলেন গুলিবিদ্ধ। পরে গুলিবিদ্ধ এক শিক্ষার্থীকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় নেওয়া হলে সেখানে তার মৃতু্য হয়। এখন চিকিৎসাধীন আছেন ১৬ জন। আহতদের সুস্থ করে তুলতে চিকিৎসকরা চেষ্টা চালাচ্ছেন।