হামলা ও নাশকতার মামলায় গ্রেপ্তার আতঙ্কে আত্মগোপনে রয়েছেন বরিশালের বিএনপি নেতারা। বেশিরভাগ নেতাকর্মীই বর্তমানে বাড়িছাড়া বলা চলে। আর দলীয় কার্যালয়ে সপ্তাহ খানিকের বেশি সময় ধরে ঝুলছে তালা। দলীয় কার্যালয়ের আশপাশেও কোনো নেতাকর্মীর দেখা মেলে না। অথচ এই দলীয় কার্যালয়ে বরিশাল মহানগরসহ উত্তর ও দক্ষিণ জেলা বিএনপি এবং অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের পদচারণা থাকে বছরজুড়ে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিএনপির এক নেতা বলেন, কোটা সংস্কার নিয়ে সাধারণ ছাত্ররা আন্দোলন করেছে। সেখানে যে কেউ সমর্থন দিতেই পারে। আর সমর্থন দিয়ে এখন হামলা ও নাশকতার মামলায় আসামি হয়ে গ্রেপ্তার হচ্ছে বিএনপির নেতাকর্মীরা।
তিনি বলেন, গত ১৯ জুলাই শুক্রবার মধ্যরাত থেকে কারফিউ জারির পর মহানগরসহ গোটা বরিশাল জেলায় ব্যাপক হারে বিএনপি নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। দেখলে চিনি কিন্তু নাম জানি না (অজ্ঞাত) এমন মামলায় কে, কখন, কীভাবে গ্রেপ্তার হবেন কেউ বলতে পারছেন না। ফলে সবাই যে যার অবস্থান থেকে নিরাপদে থাকার চেষ্টা করছেন।
বরিশাল মহানগর বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক আফরোজা খানম নাসরিন এক বিবৃতিতে বলেন, চাকরি ক্ষেত্রে বৈষম্যবিরোধী কোটা সংস্কারের দাবিতে দেশের আপামর শিক্ষার্থীদের যুক্তিসঙ্গত আন্দোলনকে ঘিরে দেশব্যাপী বিএনপিসহ বিরোধী দল ও মতের মানুষদের এখনো নির্বিচারে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। তারই ধারাবাহিকতায় বরিশাল মহানগর বিএনপির সদস্য সচিব জিয়া উদ্দিন শিকদার জিয়াসহ যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল, শ্রমিকদল ও ছাত্রদলের প্রায় ১০২ জন নেতাকর্মীকে সরকারের পেটুয়াবাহিনী অন্যায়ভাবে গ্রেপ্তার করেছে। এ ঘটনায় বরিশাল মহানগর বিএনপির পক্ষ থেকে তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাই।
বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশ সূত্রে জানা যায়, কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে গত ১৫ থেকে ১৮ জুলাই পর্যন্ত বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় ও নথুলস্নাবাদ কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাল এলাকার চৌমাথাসহ নগরের বিভিন্ন এলাকায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে আন্দোলনকারীদের কয়েক দফায় সংঘর্ষ হয়। এতে নথুলস্নাবাদ কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাল পুলিশ বক্স, চৌমাথা পুলিশ বক্স, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় পুলিশ ক্যাম্পে হামলা ও ভাঙচুর হয়। ওই সময় পুলিশের দুটি মোটর সাইকেল ভাঙচুর, একটি অগ্নিসংযোগ, একটি পিকআপ ভ্যান, একটি ট্রাক ও ১০টি সিসি ক্যামেরা ভাঙচুর করা হয়েছে।
এসব ঘটনায় বরিশাল মেট্রোপলিটনের তিনটি থানায় হামলা ও নাশকতার অভিযোগে পুলিশ ৫টি ও এক ছাত্রলীগ নেতা একটি মামলা দায়ের করে। আর এসব মামলায় শ'খানেক নামধারী ও ৩ হাজারের বেশি অজ্ঞাত নামা আসামি করা হয়।
এছাড়া ১৯ জুলাই
বিকালে নগরের চৌমাথা এলাকায় আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নেতাদের মধ্যে সংঘর্ষ, ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনায় আরও একটি মামলা দায়ের করেন এক ছাত্রলীগ নেতা। যেখানে বরিশাল মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক মনিরুজ্জামান ফারুক, সদস্য সচিব জিয়া উদ্দিন শিকদার জিয়াসহ ২৭ জনকে নামধারী ও ৮শ' জনকে অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়।
তবে গত ১৯ জুলাই বিকালে তাদের শান্তিপূর্ণ মিছিলে সন্ত্রাসী আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবকলীগ, শ্রমিকলীগ, ছাত্রলীগ অতর্কিত হামলা চালিয়েছে বলে মহানগর বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক আফরোজা খানম নাসরিন দাবি করেছেন।
তিনি বলেন, ওইসময় তারা বেআইনি আগ্নেয়াস্ত্র, রামদা, চাপাতি, চাইনিজ কুঠারসহ বিভিন্ন অস্ত্র ব্যবহার করে হামলা চালিয়ে বরিশাল মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক মনিরুজ্জামান ফারুক, সদস্য সচিব জিয়া উদ্দিন শিকদার জিয়াসহ আরও ১৫ জন নেতাকর্মী গুরুতর আহত করে। অথচ হামলার শিকার হয়ে বিএনপি নেতারাই আবার পালটা মামলার শিকার হয়েছে।
আত্মগোপনে থেকে বিএনপি নেতাদের দাবি, ছাত্রলীগের দায়ের করা মামলার পাশাপাশি পুলিশের দায়ের করা মামলায় অজ্ঞাত আসামির তালিকাতেও বিএনপি নেতাকর্মীরা গ্রেপ্তার হচ্ছেন। যেটা গায়ের জোড়েই করা হচ্ছে। হামলা-মামলায় তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে বিএনপি নেতারা অবিলম্বে গ্রেপ্তারদের নেতাকর্মীদের মুক্তি প্রদানের জোর আহ্বান জানিয়েছেন।
যদিও পুলিশ বলছে, সিসি ক্যামেরার ফুটেজ ও বিভিন্ন ভিডিও'র সহযোগিতায় নাশকতাকারীদের শনাক্ত করেই গ্রেপ্তার অভিযান চালানো হচ্ছে। এখানে কাউকে যেমন ছাড়ও দেওয়া হচ্ছে না, তেমনি অনর্থক কাউকে গ্রেপ্তারও করা হচ্ছে না। বরং যারা এ মুহূর্তে আত্মগোপনে রয়েছেন বা দৃষ্টির বাইরে থাকার চেষ্টা করছেন, তারা কেন এমনটা করছেন সেটি খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার জিহাদুল কবির বলেছেন, কারা বিশৃঙ্খলাকারীদের পেছন থেকে মদদ দিয়েছেন, কারা ঘটনাস্থলে নিয়ে এসেছেন, আশ্রয় দিয়েছেন, খাবার দিয়েছেন, পানি দিয়েছেন, টাকা দিয়েছেন, ইটের টুকরো-লাঠিসোঁটা দিয়েছেন সবকিছু খতিয়ে দেখা হচ্ছে। বরিশালের ঘটনাগুলোর সঙ্গে জড়িত প্রত্যেককে আইনের আওতায় আনা হবে।
এদিকে বরিশাল মহানগর স্বেচ্ছাসেবক দলের এক নেতা জানান, জেলা ও মহানগর বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ের নেতা যাদের বসবাস বরিশাল শহরে, তারা সবাই আত্মগোপনে এমনকি ওয়ার্ড পর্যায়ের নেতাদের পাশাপাশি কর্মীরাও গ্রেপ্তার আতঙ্কে অন্যত্র আত্মগোপন করেছেন। বিশেষ করে রাতের বেলা বাসায় যেমন কেউ থাকছেন না, তেমনি মোবাইল নম্বরও খোলা রাখছেন না। যোগাযোগের একমাত্র ক্ষেত্র ভিপিএন ব্যবহার করে হোয়াটস্ অ্যাপ।
একই কথা জানিয়েছেন অভিযান চালানো আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। তারা জানান, বিভিন্ন মামলার আসামি ছাত্রদল- বিএনপি নেতাদের বাড়িতে অভিযান চালালে কাউকেই পাওয়া যাচ্ছে না। তাই প্রযুক্তির ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে তাদের। আর প্রযুক্তির জাল থেকে রেহাই পেতে অনেকেই মোবাইল বন্ধ রাখছেন। শুক্রবার রাতে ও শনিবার সকালে মহানগর বিএনপি শীর্ষ কয়েকজন নেতাকে ফোন দিলে তাদের নম্বর বন্ধ পাওয়া যায়।
উলেস্নখ্য, শুক্রবার রাত পর্যন্ত বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশের চার থানা এলাকা থেকে মোট ৯০ জন বিএনপি-জামায়াতের নেতাকে গ্রেপ্তারের তথ্য জানিয়েছে স্টাফ অফিসার প্রণয় রায়। খবর বাংলানিউজ'র