বাড়ছে বজ্রপাতপ্রবণ এলাকার পরিধি

তাপমাত্রা বাড়ায় বজ্রপাত বাড়ছে বিশ্বের এক-চতুর্থাংশ মৃতু্য হয় দেশে প্রতি বছর গড়ে ২৫০ জন মারা যান খোলা স্থানে বজ্রপাতের ঘটনা বেশি

প্রকাশ | ২১ জুলাই ২০২৪, ০০:০০ | আপডেট: ২৭ জুলাই ২০২৪, ১২:৩৪

বীরেন মুখার্জী
দেশে বজ্রপাতের ঘটনা প্রতিবছর বাড়ছে। অতীতে দেশের যেসব অঞ্চলে খুব একটা বজ্রপাতের ঘটনা ঘটেনি, কয়েক বছরের ব্যবধানে সেসব অঞ্চলেও বেড়েছে বজ্রপাত। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ায় গ্রীষ্মমন্ডলীয় দেশে বজ্রপাত বাড়ছে। আবহাওয়ার 'বৈপরীত্যের' কারণে গত দুই বছরে দেশে বজ্রপাত পরিস্থিতির বেশ অবনতি ঘটেছে। পাশাপাশি বাড়ছে বজ্রপাতপ্রবণ এলাকার পরিধি। এখন পাহাড়ি অঞ্চলেও বজ্রপাতের ঘটনা আগের চেয়ে বেশি। বজ্রপাতে প্রাণহানির সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় পাশাপাশি বাড়ছে আহতের সংখ্যাও। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় এবং বেসরকারি সংগঠন সেভ দ্য সোসাইটি অ্যান্ড থান্ডারস্টর্ম অ্যাওয়ারনেস ফোরামের (এসএসটিএফের) তথ্য অনুযায়ী, বজ্রপাতে বিশ্বের এক-চতুর্থাংশ মৃতু্যই ঘটে বাংলাদেশে। ফলে স্বাভাবিকভাবে চলতি বছরেও বজ্রপাতে ব্যাপক প্রাণহানির আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। দেশের হাওড় ও উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল সাধারণত বজ্রপাতপ্রবণ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত। সম্প্রতি অন্যান্য জেলায়ও বাড়ছে বজ্রপাত। দুর্যোগ ও জলবায়ু বিশেষজ্ঞদের মতে, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে তাপমাত্রা বাড়ছে। এর প্রভাবে বেশির ভাগ দুর্যোগই বৃদ্ধি পাচ্ছে। সেটা স্থানভেদে ১২-২৫ শতাংশ পর্যন্ত বাড়তে পারে। এসব দুর্যোগের মধ্যে বজ্রসহ বৃষ্টিপাতের ঘটনা সবচেয়ে বেশি। আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, দেশে প্রতিবছর বজ্রপাতে গড়ে ২৫০ জনের মৃতু্য হয়। আর দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, দেশে ১৯৯০ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত বজ্রপাতে মৃতু্য হয়েছে পাঁচ হাজার ৬০০ জনের। গত সাত বছরে বজ্রপাতে মৃতু্যর হার বেড়েছে। ২০২৩ সালে ৫৬ জেলায় বজ্রপাতে ৩১৮ জনের মৃতু্য হয়। আহত হন অর্ধশতাধিক। ২০২২ সালেও প্রায় ৩০০ জনের মৃতু্য হয়। এ ছাড়া ২০১১ সালে ১৭৯ জন, ২০১২ সালে ২০১, ২০১৩ সালে ১৮৫, ২০১৪ সালে ১৭০, ২০১৫ সালে ২২৬, ২০১৬ সালে ৩৯১, ২০১৭ সালে ৩০৭, ২০১৮ সালে ৩৫৯, ২০১৯ সালে ১৯৮, ২০২০ সালে ২৫৫ এবং ২০২১ সালে ৩১৪ জনের মৃতু্যর রেকর্ড রয়েছে। চলতি বছরের ছয় মাসে বজ্রপাতে মৃতু্য একশ'র কাছাকাছি। এর মধ্যে ২ মে এক দিনে দেশের পাঁচ জেলায় ১১ জন মারা যান। তথ্য অনুযায়ী, দেশের ১৬ জেলায় বজ্রপাত ও মৃতু্যর ঘটনা বেশি। এই তালিকায় আছে- সিলেট, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা, সিরাজগঞ্জ, ময়মনসিংহ, দিনাজপুর, পাবনা, নওগাঁ, বগুড়া, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী, জামালপুর, গাইবান্ধা ও টাঙ্গাইল। আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, গত দুই বছরে দেশের দক্ষিণাঞ্চলসহ উপকূলীয় ও পাহাড়ি অঞ্চলে বজ্রপাতে মৃতু্যর সংখ্যা বেড়েছে। এর মধ্যে রয়েছে- যশোর, বরিশাল, পটুয়াখালী, কক্সবাজার, শরীয়তপুর, রাঙামাটি, সাতক্ষীরা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, নরসিংদী, কুমিলস্না, খুলনা, কুষ্টিয়া, চট্টগ্রাম ও খাগড়াছড়ি। গবেষকরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ও অভিঘাতে এমন পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটেছে। সরে গেছে বৃষ্টিপাতের মৌসুম। এসব অঞ্চলে বছরের দীর্ঘ সময় ধরে বিরাজ করছে অসহনীয় দাবদাহ। চলতি বছরও দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা দীর্ঘদিন ধরে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের চুয়াডাঙ্গা ও যশোরে বিরাজ করেছে। বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বর্ষার আগে অর্থাৎ মার্চ থেকে মে মাস পর্যন্ত দেশের আবহাওয়া সবচেয়ে বেশি উত্তপ্ত থাকে। অতিরিক্ত তাপমাত্রার কারণে এ সময় অনেক জলীয় বাষ্প তৈরি হয়। এ জলীয় বাষ্পই বজ্রপাতের প্রধান শক্তি হিসেবে কাজ করে। জলীয় বাষ্প যত বেশি হবে, তত বেশি বজ্র মেঘের সৃষ্টি হবে এবং ঘন ঘন বজ্রপাত দেখা যাবে। এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিজাস্টার সায়েন্স অ্যান্ড ক্লাইমেট রেজিলিয়েন্স বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক ড. মো. জিলস্নুর রহমান সম্প্রতি একটি সংবাদমাধ্যমে বলেন, 'যুক্তরাষ্ট্রের গবেষণায় দেখা গেছে, ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে ১২ শতাংশ বজ্রপাত বাড়ছে। এটা সব স্থানে একই রকম। ২০১০-২৪ সাল পর্যন্ত ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা বেড়েছে।' তিনি আরও বলেন, 'আগে দেশের দক্ষিণাঞ্চল ও পাহাড়ি অঞ্চলের তাপমাত্রা এখনকার মতো ছিল না। এখন তাপমাত্রা বেড়েছে। ফলে বজ্রপাতও বেড়েছে। যেসব জায়গায় বজ্রপাত আগে থেকেই বেশি, সেসব জায়গায় এখন আরও বেশি হবে। আর যেসব অঞ্চলে কম ছিল, সেখানে বাড়বে। এই তাপমাত্রা চলমান থাকলে বছরে ৫০ শতাংশ বেশি বজ্রবৃষ্টি হবে।' আমেরিকান মেট্রলজিক্যাল সোসাইটির জার্নালে প্রকাশিত 'লাইটিং ফ্যাটালিটিস ইন বাংলাদেশে ফ্রম ১৯৯০ থ্রু ২০১৬' শীর্ষক গবেষণা প্রবন্ধ বলছে, বাংলাদেশে সকাল ও দুপুরের বজ্রপাতে সর্বোচ্চ সংখ্যক ব্যক্তি মারা গেছেন। সকাল ১০টা থেকে দুপুর পর্যন্ত তাপমাত্রা বাড়তে থাকে। যেসব কারণে বজ্রপাত হয়, সেসব কারণ এ সময় বেশি বিদ্যমান থাকে। গবেষণায় আরও বলা হয়েছে, গত ২৬ বছরে বজ্রাঘাতে মারা যাওয়া তিন হাজার ৮৬ জনের ৯৩ শতাংশ গ্রামের বাসিন্দা। তারা মূলত কৃষিকাজে যুক্ত। ২০১১ সালের আগে প্রতি ১০ লাখ জনসংখ্যার মধ্যে বছরে গড়ে দশমিক ৯ জন বজ্রপাতে মারা গেছেন। ২০১১-১৬ সাল পর্যন্ত এই হার বেড়ে দাঁড়ায় ১ দশমিক ৮ জনে। দেশে বজ্রপাতকে ২০১৬ সালে জাতীয় দুর্যোগ ঘোষণা করা হয়। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর বলছে, দুর্যোগ ঘোষণার পর বজ্রপাতপ্রবণ এলাকাগুলো চিহ্নিত করে বজ্রপাতে প্রাণহানি কমাতে হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে নেওয়া হয় বিভিন্ন প্রকল্প। কিন্তু কিছুতেই প্রাণহানি কমানো যায়নি। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের পরিচালক (পরিবীক্ষণ ও তথ্য ব্যবস্থাপনা অনুবিভাগ) নিতাই চন্দ্র দে সরকার সম্প্রতি গণমাধ্যমে বলেন, 'গত দুই বছর ধরে আবহাওয়া বৈপরীত্য দেখা যাচ্ছে। এল-নিনোর প্রভাব দেখা যাচ্ছে। শীতের সময় শীতও বেশি দেখা যায়নি। এল-নিনোর পর লা-লিনোর প্রভাব আসবে। আশঙ্কা করা হচ্ছে, এ বছর বজ্রপাতের সংখ্যা আরও বাড়বে।' তিনি জানান, দেশে বজ্রপাতে মৃতু্যর সংখ্যা জানা গেলেও বজ্রপাতের সংখ্যা জানা যায় না। প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতা রয়েছে। তবে এরই মধ্যে ১৫ জেলায় ৩৬০টি লাইটনিং অ্যারেস্টার বসানো হয়েছে। যার মাধ্যমে কখন, কোন জায়গায় বজ্রপাত হয়েছে, তা জানা যায়। আমরা আরও একটি প্রকল্প হাতে নিচ্ছি, যেখানে ৬০০ মেশিন বসানোর পরিকল্পনা রয়েছে। পরিবীক্ষণ ও তথ্য ব্যবস্থাপনা অনুবিভাগের এই পরিচালক বলেন, 'দেশে কম-বেশি প্রায় ৫০ জেলায় বজ্রপাত দেখা যায়। যেসব জেলায় কম বজ্রপাত হতো, সেসব জায়গায় এখন বেশি হচ্ছে। সবসময় এক জায়গাই বেশি হচ্ছে- এমনটি নয়। আগে ফরিদপুরে বেশি হতো, এখন সেখানে কম হচ্ছে। পাহাড়ে বিক্ষিপ্তভাবে বজ্রপাত হতো, এখন সেখানে বেশি দেখা যাচ্ছে। এর কারণ হতে পারে সেখানে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে।' বাংলাদেশ মেডিকেল রিসার্চ কাউন্সিলে প্রকাশিত গবেষণার তথ্যমতে, দেশে গত ২৫ বছরে তাপমাত্রা ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়েছে। তাপমাত্রা বৃদ্ধি বজ্রপাত বৃদ্ধির অন্যতম কারণ। জলোচ্ছ্বাস, আকস্মিক বন্যা ও হারিকেনের পর আবহাওয়া-সংক্রান্ত কারণে সবচেয়ে বেশি মৃতু্য হচ্ছে বজ্রাঘাতে। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বজ্রপাতে যারা আহত হন, তারা বিভিন্ন স্বাস্থ্যগত ঝুঁকির মধ্যে পড়েন। হৃদরোগ, ফুসফুস ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া, স্নায়বিক সমস্যা, পুড়ে যাওয়া, চোখের ক্ষতি ও পেশির ক্ষতি হতে পারে। পেশির ক্ষতি হলে ইউরিনের সমস্যার কারণে কিডনিতে দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়তে পারে। প্রজনন স্বাস্থ্য ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। ভয়ের কারণে ট্রমাক্রান্ত হতে পারেন। সরকার বজ্রপাতকে দুর্যোগ ঘোষণা করলেও স্বাস্থ্যগত দুর্যোগ ঘোষণা করা হয়নি। এটা প্রয়োজন। বজ্রপাত প্রতিরোধে আরও কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার পাশাপাশি জনসচেনতাও গড়ে তোলা জরুরি।