বুধবার, ০৬ নভেম্বর ২০২৪, ২১ কার্তিক ১৪৩১
ভূগর্ভের পানির অধিক ব্যবহারে ভূমিধস- মাটি দেবে যেতে পারে

পানির দুষ্প্রাপ্যতায় বেড়ে যাচ্ছে কৃষকের সেচ খরচ

আলতাব হোসেন
  ২৬ জুলাই ২০২৪, ০০:০০
-

পানির দুষ্প্রাপ্যতায় বেড়ে যাচ্ছে কৃষকের সেচখরচ। দেশের সবচেয়ে বড় সেচ প্রকল্প গঙ্গা-কপোতাক্ষের (জিকে প্রকল্প) আওতাধীন সেচ কাজে প্রতি একরে ২০ হাজার টাকা খরচ বৃদ্ধি পেয়েছে কৃষকের। এক কেজি ধান উৎপাদনে ব্যয় হয় প্রায় দেড় হাজার লিটার পানি। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে প্রায় বছরই মৌসুমে বৃষ্টির পানি পাওয়া যায় না। খরায় চৌ-চির হয় ফসলের ক্ষেত। ভূগর্ভের পানির অধিক ব্যবহারে ভূমিধস ও মাটি দেবে যেতে পারে। বিএডিসি'র ক্ষুদ্র সেচ প্রকল্পের হিসাবে আগামী ১০ বছরে ব্যয় তিনগুণ বাড়বে। বর্তমানে কৃষি উৎপাদনের ৬২ শতাংশ ব্যয় হচ্ছে সেচে। এক দশক আগেও প্রতি হেক্টর জমি চাষে সেচের খরচ ছিল চার থেকে পাঁচ হাজার টাকা। কিন্তু গত কয়েকটি মৌসুমে তা ১২ থেকে ১৭ হাজার টাকা ছাড়িয়ে গেছে। এ ছাড়া পানির স্তর এক ফুট নিচে নামলে কৃষিতে বছরে অতিরিক্ত ব্যয় করতে হয় ৯০ কোটি টাকা। এক ফুট নিচে নামলে পানি উপরে ওঠাতে বেশি শক্তিশালী হর্স পাওয়ার পাম্প দিয়ে পানি তুলতে হয়। এতে অতিরিক্ত জ্বালানি তেল বা বিদু্যৎ ব্যবহার হয়। বর্তমানে দেশের বেশির ভাগ এলাকায় সাব-মার্সেবল পাম্প বসিয়ে ফসলের ক্ষেতে সেচ দিতে হচ্ছে। এতে সেচখরচ বৃদ্ধি পাচ্ছে। খাবার পানি, রান্না, গোসল, সেচসহ সব কাজে ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নিভর্রশীল বাংলাদেশ। সুপেয় ও চাষাবাদের পানির চাহিদার প্রায় ৮০ শতাংশই ব্যবহার হয় ভূগর্ভস্থ স্তর থেকে। ১৯৬৮ সালে যখন বাংলাদেশে ডিপ টিউবওয়েল বসানো শুরু হয়, তখন সর্বোচ্চ ৫০ ফুট নিচে টিউবওয়েল বসিয়েই পানি পাওয়া যেত। এখন ১৬০ ফুট বসিয়েও পর্যাপ্ত পানি পাওয়া যাচ্ছে না। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পানিসম্পদ প্রকৌশল বিভাগের এক গবেষণায় বলা হয়েছে, প্রতি বছর ভূগর্ভের পানির স্তর দুই থেকে পাঁচ মিটার করে নিচে নামছে। এতে পানিতে আর্সেনিকের পরিমাণ যেমন বাড়ছে, আশঙ্কা দেখা দিয়েছে ভূমিধস ও মাটি দেবে যাওয়াসহ নানা দুর্ঘটনার। বিএডিসির গ্রাউন্ড ওয়াটার জোনিং ম্যাপে দেখা যায়, দেশের মধ্যভাগ ও উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে বিস্তৃত ৪৮ জেলার ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ৫ থেকে ১০ ফুট পর্যন্ত নিচে নেমে গেছে। উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলোয় ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় সেচ ও খাবার পানি সংকটের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। বছরের পর বছর গভীর নলকূপ বসিয়ে বোরো মৌসুমে অপরিকল্পিতভাবে পানি উত্তোলনের ফলে রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও নওগাঁ জেলার সাত উপজেলায় ভূগর্ভস্থ পানির স্তর আশঙ্কাজনকভাবে নিচে নেমে যাচ্ছে। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের (বিএআরসি) এক গবেষণায় দেখা গেছে, বিশ্বে সেচের খরচে শীর্ষে এখন বাংলাদেশ। গত কয়েক বছরে বরেন্দ্র অঞ্চলের তিন জেলায় প্রায় সাত হাজার ডিপ টিউবওয়েল বসানো হয়েছে। কোনো নীতিমালা না মেনেই এসব ডিপ টিউবওয়েল বসানো হয়। এর ফলে পানির স্তর প্রায় ৩৭ ফুট নিচে নেমে গেছে। ময়মনসিংহ, গাজীপুর, নরসিংদী ও ঢাকার আশপাশের এলাকায় পানির স্তর নেমে গেছে প্রায় ২৫ ফুট। এসব এলাকায় পানির স্তর দ্রম্নত নেমে যাওয়ার কারণ হচ্ছে শিল্প-কারখানায় পানির যথেচ্ছ ব্যবহার। এরমধ্যে দেশের প্রায় তিন কোটি মানুষ সুপেয় পানি পাচ্ছেন না। কৃষিবিদ শহীদুল আলম বলেন, দেশের কৃষক নদী-নালা, পুকুর ও খাল-বিলের (ভূ-উপরস্থ) পানি ব্যবহার করে আগে ফসলে সেচ দিত। এ পদ্ধতিতে সেচের আওতাধীন জমির পরিমাণ ছিল ২১ শতাংশ। এখন ভূ-উপরি স্তরের পানি না পাওয়ায় ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার বেড়েছে। গত বছরের হিসাবে ৭৯ শতাংশ জমি মাটির নিচের পানিতে চাষ হয়। এর মধ্যে গভীর নলকূপ দিয়ে ১৫ শতাংশ জমিতে সেচ দেওয়া হয়। প্রায় ৬৪ শতাংশ জমিতে সেচ দেওয়া হয় অগভীর নলকূপ দিয়ে। ভূ-উপরিভাগ ও ভূ-গর্ভস্থ পানির সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। জলবায়ুর প্রেক্ষাপটে পানি সমস্যা বাড়বে। এ জন্য আগাম প্রস্তুতি নিতে হবে। পানির অধিকারে নারী, শিশু, প্রতিবন্ধী ও কৃষি উৎপাদনকে প্রাধান্য দিতে হবে। ভূগর্ভের পানি মজুত রাখতে উপরিভাগের পানির ব্যবহারে সচেতনতা বাড়াতে হবে। পানির সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত না করলে পানি নিয়ে বড় বিপদ খুব সন্নিকটে। বৃষ্টির পানি ধরে রাখতে হবে। পানি গবেষক ড. সেলিম খান বলেন, বিগত শতকের সত্তরের দশকের আগে দেশের মানুষের কাছে সুপেয় পানির প্রধান উৎস ছিল পুকুর, নদী, খাল আর জমিয়ে রাখা বৃষ্টির পানি। সত্তরের দশকের শুরুতে কৃষি কাজের জন্য ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার শুরু হয়। আশির দশকে তা ব্যাপকতা পায়। নদীগুলোতে অপরিকল্পিত বাঁধ, জলবায়ুর প্রভাবে প্রতি বছর পর্যাপ্ত বৃষ্টি ও বন্যা না হওয়া এবং দুয়েক বছর পর পর তীব্র খরা হওয়ার কারণে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নেমে সংকট প্রকট হচ্ছে। পানি অধিদপ্তরের পানি প্রকৌশলী কামরুজ্জামান এলাহী বলেন, গত কয়েক বছরে দেশের ৪১ জেলার ১৯২ উপজেলায় দেখা দিয়েছে সেচের পানি সংকট। দেশের অধিকাংশ এলাকায়ই শুরু হয়েছে মরুকরণ প্রক্রিয়া। মহুরি সেচ প্রকল্প, জিকে প্রকল্প, বরেন্দ্র সেচ প্রকল্প এবং মেঘনা-ধনাগোদা সেচ প্রকল্প বন্ধ হওয়ার পথে। রংপুর, রাজশাহী, খুলনা অঞ্চলেও সেচের পানির তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। রংপুর, দিনাজপুর, বগুড়া, পাবনা ও রাজশাহীতে পানির স্তর গড়ে ২০ থেকে ২৫ মিটার পর্যন্ত নেমে গেছে। ময়মনসিংহ, গাজীপুর, নরসিংদী ও ঢাকার আশপাশের এলাকায় পানির স্তর নেমে গেছে প্রায় ২৫ ফুট। সবচেয়ে বেশি নেমেছে রাজশাহী ও নওগাঁ জেলায়। বিশ্বে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ২০২০ সালেই বিশ্বের প্রায় ৫০০ মিলিয়ন মানুষ পানির স্বল্পতার শিকার হয়েছে। ২০৫০ সাল নাগাদ পানির অভাবে জলবায়ুর পরিবর্তনের প্রভাবে দক্ষিণ এশিয়ায় ধান ও ভুট্টার ফলন দশ শতাংশ কমে যাবে। পানির অভাবে এই অঞ্চলের মানুষের খাদ্য নিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ফেলবে। ভিয়েতনাম ও পাকিস্তানে ইতোমধ্যে শস্যের উৎপাদন ৩০ শতাংশ কমে গেছে। 'পানি ও জীবন' ফান্ডেশনের সভাপতি পানি বিশেষজ্ঞ ড. আনোয়ার হোসেন বলেন, পানির অপর নাম জীবন। খাবার পানি, রান্না, গোসল, সেচসহ সব কাজে ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরশীল বাংলাদেশ। সুপেয় ও চাষাবাদের পানির চাহিদার প্রায় ৮০ শতাংশই ব্যবহার হয় ভূগর্ভস্থ স্তর থেকে। অথচ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বাংলাদেশের মানুষ সুপেয় পানির তীব্র সংকটে পড়েছেন। বাংলাদেশে আমন চাষ সম্পূর্ণ বৃষ্টির ওপর নির্ভরশীল। এখন কোনো কোনো বছর ভরা বর্ষায়ও বৃষ্টির দেখা মিলে না। ফেটে চৌচির হয় ফসলের মাঠ। দেশে আমন মৌসুমে ডিজেল চালিত ১৭ লাখ শ্যালো টিউবওয়েল মাটির নিচ থেকে পানি তুলে। এগুলো ২০ থেকে ২৪ ফুট মাটির নিচ থেকেও পানি তুলতে পারত। কিন্তু বর্তমানে অনেক এলাকায় মাটির ৩০ ফুট নিচেও পানি পাওয়া যাচ্ছে না। পানির এ দুষ্প্রাপ্যতায় বেড়ে যাচ্ছে কৃষকের সেচখরচ। কৃষিবিদ আব্দুস সালাম বলেন, দেশ মূলত মধ্যভাগ ও উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে বিস্তৃত ৩১ জেলার ভূগর্ভস্থ পানির স্তর প্রতি বছরই একটি নির্দিষ্ট মাত্রায় নিচের দিকে নেমে যাচ্ছে। পানির স্তর এক ফুট নিচে চলে গেলে কৃষকের বছরে প্রায় ১০০ কোটি টাকা অতিরিক্ত খরচ হয়। এক ফুট বেশি দেবে গেলে বেশি হর্স পাওয়ারের সেচ পাম্প দরকার হয়। এতে জ্বালানি তেল বা বিদু্যৎ বেশি প্রয়োজন হয়। ১৯৬৮ সালে যখন বাংলাদেশে ডিপ টিউবওয়েল বসানো হয়, তখন সর্বোচ্চ ৫০ ফুট নিচে বসানো হতো। এখন ১৫০ ফুট নিচে বসানো হলেও পানি মিলছে না। এ বিষয়ে কৃষিবিদ সাইফুল আলম বলেন, বোরো মৌসুমে এক কেজি ধান উৎপাদনে দেড় হাজার লিটার পানির প্রয়োজন হয়। এ পানির জোগান আসে ভূগর্ভস্থ উৎস থেকে। সেচকাজে ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার বেড়ে যাওয়ায় নিচে নেমে যাচ্ছে পানির স্তর। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে শুধু বোরো উৎপাদনে সেচবাবদ নয় হাজার ৮৭ কোটি টাকার জ্বালানি ব্যয় হচ্ছে। এতে বাড়ছে কৃষকের উৎপাদন ব্যয়। দেশের কৃষককে সেচের পেছনে মোট উৎপাদন ব্যয়ের ৬৫ শতাংশ অর্থ খরচ করতে হচ্ছে। ধান উৎপাদনে এ খরচ বিশ্বে সর্বোচ্চ।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে