জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নানা ধরনের প্রতিকূলতা সত্ত্বেও দেশের সবুজ শিল্পায়নে অগ্রগতি চলমান রয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় গত চার বছরে নতুন করে ৩৯৩টি পোশাক কারখানা রপ্তানিমুখী উৎপাদনে যুক্ত হয়েছে। এ ছাড়া গত সাড়ে ১৪ বছরে নতুন বাজারে পোশাক রপ্তানি বেড়েছে প্রায় ১০গুণ। বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান সম্প্রতি উত্তরায় বিজিএমইএ কমপেস্নক্সে তার বিদায়ী অনুষ্ঠানে এ তথ্য জানান।
পোশাক রপ্তানিকারকদের সংগঠনটির নেতা হিসেবে নিজের দায়িত্বের তিন বছরে বিভিন্ন অগ্রগতির বর্ণনা দিয়ে বিদায়ী অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, 'নানা কারণে অনেক পোশাক কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে এটা সত্য। কিন্তু আমরা বিজিএমইএর দায়িত্ব নেওয়ার পর দিন থেকে অর্থাৎ ১৩ এপ্রিল ২০২১ থেকে এ পর্যন্ত (মার্চ ২০২৪) ৩৯৩টি নতুন কারখানা বিজিএমইএর সদস্য পদ গ্রহণ করেছে। শত প্রতিকূলতার মধ্যে এটি নিঃসন্দেহে একটি বড় প্রেরণা।'
বিজিএমইএর তথ্য অনুযায়ী করোনাভাইরাস মহামারির আগে অর্থাৎ ২০১৮-১৯ অর্থবছরে সামগ্রিক রপ্তানি আয় ছিল ৪০ দশমিক ৫৪ বিলিয়ন ডলার, যেখানে তৈরি পোশাক রপ্তানির পরিমাণ ছিল ৩৪ দশমিক ১৩ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ পোশাক রপ্তানির শেয়ার ছিল ৮৪ দশমিক ২১ শতাংশ। সে বছরটিতে প্রবৃদ্ধি ছিল ১১ দশমিক ৪৯ শতাংশ। অর্থাৎ আগের বছরের তুলনায় ৩ দশমিক ৫২ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি বেড়েছিল।
২০১৯-২০ অর্থবছরে কোভিড-১৯ এর ধাক্কায় পোশাক রপ্তানি নেমে আসে ২৭ দশমিক ৯৫ বিলিয়ন ডলারে। ২০২০-২১ অর্থবছরে পোশাক রপ্তানি ২৭ দশমিক ৯৫ বিলিয়ন ডলার থেকে ৩ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার বেড়ে ৩১ দশমিক ৪৫ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছায়, যা প্রায় ১২ দশমিক ৫৫ শতাংশ বেশি।
২০২২-২৩ অর্থবছরে পোশাক রপ্তানি ১০ দশমিক ২৭ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ৪৬ দশমিক ৯৯ বিলিয়ন ডলার, যেখানে মোট রপ্তানিতে পোশাকের শেয়ার পৌঁছেছে ৮৪ দশমিক ৫৮ শতাংশ। আর সবশেষ গত অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে এই শেয়ার ৮৫ দশমিক ৪২ শতাংশে পৌঁছেছে এবং এ সময়টিতে অর্জিত প্রবৃদ্ধি ৫ দশমিক ৫৩ শতাংশ।
২০২৪ ক্যালেন্ডার বছরের জানুয়ারি-মার্চ সময়ে পোশাক রপ্তানি ছিল ১৩ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলার, যা এ সময় বাংলাদেশের মোট রপ্তানি আয়ের ৮৬ দশমিক ২৪ শতাংশ। এর আগে যে কোনো বছরের একই মাসের তুলনায় সর্বোচ্চ রপ্তানি এটি। এর মধ্যে জানুয়ারিতে রপ্তানি হয়েছে ৪ দশমিক ৯৭ বিলিয়ন ডলার, যা একক মাস হিসেবে এযাবৎ সর্বোচ্চ রপ্তানি আয়ের মাস।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এই ধারাবাহিকতা বজায় রাখা গেলে ২০২৪ সালের শেষ নাগাদ তৈরি পোশাক রপ্তানি ৫০ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করতে পারে।
বিজিএমইএ সূত্র জানায়, গত অর্থবছরের ৯ মাসে নতুন বাজারে পোশাক রপ্তানি ১০ দশমিক ৮৩ শতাংশ বেড়েছে। বিশেষ করে তুরস্কে ৬৩ দশমিক ৩৫ শতাংশ, সৌদি আরবে ৪৭ দশমিক ১৯ শতাংশ, চীনে ৪৪ দশমিক ৭৬ শতাংশ, সংযুক্ত আরব আমিরাতে ৩৬ দশমিক ৫৪ শতাংশ, রাশিয়ায় ২৫ দশমিক ৬৫ শতাংশ, অস্ট্রেলিয়ায় ২১ দশমিক ২৯ শতাংশ, দক্ষিণ কোরিয়ায় ১৭ দশমিক ১৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি এসেছে।
এই সঙ্গে নন-কটন পোশাকের সম্ভাবনা বেড়েছে। ২০২০-২১ অর্থবছরের মোট পোশাক রপ্তানির প্রায় ৭৪ শতাংশ ছিল কটনের তৈরি, যা ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৭০ শতাংশে নেমে এসেছে। অর্থাৎ নন-কটন খাতে বিনিয়োগ ও রপ্তানি বাড়ছে। সঠিক ও সময়োপযোগী পদক্ষেপ নিতে পারলে নন-কটন খাতে সম্ভাবনার নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবে।
জানা যায়, তৈরি পোশাকের বাইরে ঐতিহ্যবাহী বস্ত্র মসলিন, জামদানি, সিল্ক, খাদি ব্যবহার করে রপ্তানি পণ্য তৈরির বিষয়ে বেশকিছু সফল কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে বিজিএমইএ। এসব পোশাক ইতোমধ্যে জার্মানি ও অস্ট্রেলিয়ায় প্রদর্শন করা হয়েছে সংগঠনের পক্ষ থেকে। এসব পণ্য ও কাঁচামালের জোগান দেশের স্থানীয় পর্যায়ে রয়েছে, যা ব্যবহার করতে পারলে আমাদের অর্থনীতিতে নতুন সম্ভাবনার দুয়ার উন্মোচিত হতে পারে বলে বিশেষজ্ঞদের ধারণা।
তারা মনে করেন, ২০২৬ সালের পর এলডিসি গ্রাজুয়েশন সম্পন্ন হলে স্থানীয় উৎপাদন ডাবল ট্রান্সফরমেশনের মধ্য দিয়ে যেতে হবে। জিএসপি পস্নাস সুবিধা পেতে ফেব্রিক্স এবং সেলাই দুটোই স্থানীয় পর্যায়ে হতে হবে। সেজন্য দেশে বস্ত্রকল খাতে প্রচুর বিনিয়োগ এখনই করতে হবে।
বিজিএমইএর তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে লিড সনদপ্রাপ্ত গ্রিন কারখানার সংখ্যা বেড়ে ২১৪টিতে দাঁড়িয়েছে। ২০২০ সাল পর্যন্ত গ্রিন কারখানার সংখ্যা ছিল ১২৮টি, গত সাড়ে চার বছরে নতুন ৯০টি কারখানা যোগ হয়েছে, যার মধ্যে ৪৫টি পস্নাটিনাম, ৩৮টি গোল্ড, একটি সিলভার ও ছয়টি সাধারণ সার্টিফায়েড মানের।
শুধু ২০২৪ সালে এখন পর্যন্ত মোট ১২টি পোশাক কারখানা লিড সনদ পেয়েছে, যার মধ্যে আটটি ছিল পস্নাটিনাম, আর চারটি গোল্ড সনদপ্রাপ্ত। এর মধ্যে একটি বিশ্বের প্রথম স্থান অর্জন করেছে। বিশ্বে 'শীর্ষ দুটি কারখানাই' বাংলাদেশের। বিশ্বের সর্বোচ্চ স্কোর এর ২৩টি লিড সার্টিফায়েড স্থাপনার মধ্যে ২১টিই বাংলাদেশে অবস্থিত। আর বিশ্বের শীর্ষ ১০ পরিবেশবান্ধব কারখানার নয়টিই বাংলাদেশে অবস্থিত।