রোববার, ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২৩ ভাদ্র ১৪৩১

বিটিভিতে অগ্নিতান্ডব :২শ' কোটি টাকার ক্ষতি দাবি

কন্ট্রোল রুমের নিয়ন্ত্রণ নিতে চেয়েছিল হামলাকারীরা -মহাপরিচালক
যাযাদি রিপোর্ট
  ২৫ জুলাই ২০২৪, ০০:০০
বিটিভিতে অগ্নিতান্ডব :২শ' কোটি টাকার ক্ষতি দাবি

রাজধানীর রামপুরায় বাংলাদেশ টেলিভিশন (বিটিভি) সদর দপ্তরের চারদিকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে অগ্নিতান্ডবের ক্ষত। কোটা সংস্কার আন্দোলনের মধ্যে ১৮ জুলাই দফায় দফায় হামলা হয়েছে বিটিভির সদর দপ্তরে। দেওয়া হয়েছে আগুন। এতে রাষ্ট্রায়ত্ত টেলিভিশনটির একাধিক গাড়ি, ক্যান্টিনসহ বিভিন্ন অংশ পুড়ে যায়। পুড়ে যায় নিচতলার মিউজিয়াম। যেখানে ইতিহাসের অনেক গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন ছিল। সাজানো-গোছানো কক্ষটি এখন পুরোটাই ধ্বংসস্তূপ। মেঝেতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে ভাঙা কাচ, দেয়াল থেকে খসে পড়েছে ঐতিহাসিক সব ছবি।

সংশ্লিষ্টরা জানান, দিনভর ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর পাশাপাশি এর নিয়ন্ত্রণ কক্ষেরও দখল নেওয়ার চেষ্টা করেছিল হামলাকারীরা। তবে তা নিতে না পারলেও বিটিভির মুজিব কর্নার এবং ঢাকা কেন্দ্রের নিরাপত্তা গেট, অভ্যর্থনা কক্ষসহ অন্তত আটটি স্থানে আগুন দেওয়া হয়।

ঘটনার এক সপ্তাহ কেটে গেছে ইতোমধ্যে। এখনো বিটিভিতে ঢুকলে নাকে আসছে পোড়া গন্ধ। গেটের পাশেই রয়েছে আগুনে পোড়া কয়েকটি যানবাহনের কঙ্কাল। ডানদিকে বিটিভি ঢাকা কেন্দ্রের অভ্যর্থনা কক্ষ, দেখে বোঝার উপায় নেই কক্ষটি কয়েক দিন আগেও ছিল সাজানো-গোছানো। সেখানে কেবলই পোড়া গন্ধ, আর যত্রতত্র ছড়িয়ে আছে ধ্বংসের চিহ্ন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, স্বাধীন বাংলাদেশে পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট ছাড়া আর কখনোই বিটিভি এতটা আক্রান্ত হয়েছে, এমন তথ্য নেই।

কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের 'কমপিস্নট শাটডাউন' কর্মসূচির প্রথম দিন ১৮ জুলাই বেলা ১১টা থেকে দফায় দফায় হামলা করা হলেও বিকাল পৌনে ৩টায় বিটিভিতে আগুন দেওয়া হয়। কিন্তু এলাকাটি আন্দোলনকারী ও স্থানীয়দের নিয়ন্ত্রণে থাকায় ওইদিন রাত ৯টায়ও আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়নি। আগুনের খবর পেলেও ঢুকতে দেওয়া হয়নি ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের। অবশেষে রাত ১০টায় আইনশৃঙ্খলা বিভিন্ন বাহিনীর সদস্যরা বিটিভির নিয়ন্ত্রণ নেয় এবং রাত ১২টায় ফায়ার সার্ভিস এসে আগুন নেভানোর কাজ শুরু করে। তবে এর আগেই আগুনে পুড়ে যায় গুরুত্বপূর্ণ কক্ষ, যন্ত্রপাতি, সম্প্রচারসামগ্রী ও গাড়ি। ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয় বিটিভির একাংশ।

সেদিনের ভয়াবহতার কথা তুলে ধরে বিটিভির মহাপরিচালক (ডিজি) ড. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, 'দুষ্কৃতকারীরা হামলা চালিয়ে ও আগুন দিয়েই ক্ষান্ত হয়নি। তারা কণ্ট্রোল রুমের নিয়ন্ত্রণও নিতে চেয়েছিল। উপায়ন্তর না পেয়ে আমরা সন্ধ্যায় সম্প্রচার বন্ধ করে দিতে বাধ্য হই।'

বিটিভির ভেতরে-বাইরে এখনো সেনাবাহিনী, বিজিবি, পুলিশসহ বিভিন্ন বাহিনীর সদস্যরা নিরাপত্তার দায়িত্বে রয়েছেন। টেলিভিশনের নিরাপত্তার স্বার্থে ভবনের গেটের সামনে কাউকে অবস্থান বা চলাফেরা করতে দেওয়া হচ্ছে না। ধ্বংসযজ্ঞের চিত্র তুলে ধরতে আসা একাধিক সাংবাদিককেও টেলিভিশনের ভেতরে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি। এ বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সঙ্গে সাংবাদিকরা কথা বলতে চাইলেও তিনি কথা বলতে অস্বীকৃতি জানান এবং টেলিভিশন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলতে বলেন।

রামপুরা এলাকার টিভি রোডের বাসিন্দা মো. ফখরুল ইসলাম নামে এক প্রত্যক্ষদর্শী সাংবাদিকদের বলেন, 'সেদিন বিকাল পৌনে ৩টায় বিটিভিতে আক্রমণ শুরু হয়। এ সময় ক্যান্টিনের সামনের একটি গাড়িতে আগুন ও ক্যান্টিন ভাঙচুর করে লোকজন। এ সময় শিক্ষার্থীরা কোটা আন্দোলনের পক্ষে এবং বিভিন্ন স্থানে গুলিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নিহতের প্রতিবাদে নানা ধরনের স্স্নোগান দিতে থাকেন। এরপর দলে দলে আরও শিক্ষার্থী আসতে থাকেন, স্থানীয় মানুষও তাদের সঙ্গে যোগ দেন। এক পর্যায়ে ভয়ে-আতঙ্কে দৌড়ে আমি বাসায় চলে যাই।'

প্রশাসনের ভূমিকা নিয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'আন্দোলনকারীর সংখ্যা বেশি থাকায় সেদিন পুলিশ অনেকটাই কোণঠাসা ছিল। পুলিশ রাবার বুলেট, টিয়ার শেল ছুড়লেও এক পর্যায়ে পিছু হটে। তখন শিক্ষার্থীসহ অন্য মানুষ পুরো এলাকা দখলে নেন। এরপর সারাদিন রামপুরা এলাকায় কোনো পুলিশ বা অন্য কোনো বাহিনীর সদস্যরা ঢুকতে পারেনি।'

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরেক স্থানীয় বাসিন্দা বলেন, 'সেদিন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা ও গুলি হয়েছে এমন খবর শুনে ইস্ট-ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সড়কে বের হয়ে আসার চেষ্টা করেন। পরে তাদের নিয়ন্ত্রণ করার সময় পুলিশের রাবার বুলেটে কয়েকজন আহত হন। এরপরই স্থানীয়রা ও অন্য ছাত্ররা রামপুরার দিকে দৌড়ে আসেন। উপস্থিত পুলিশ সদস্যরা তাদের ছত্রভঙ্গ করতে গুলে চালান। আহত হন কয়েকজন। এক পর্যায়ে পুরো এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়।'

বাংলাদেশ টেলিভিশনে কর্মরত নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক কর্মী জানান, টেলিভিশনের ভেতরে-বাইরে সর্বত্র এখনো ধ্বংসযজ্ঞ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। ঘটনার দিন ভেতরে আটকে পড়া অধিকাংশ কর্মীর মধ্যে এখনো আতঙ্ক বিরাজ করছে।

টেলিভিশনের একজন সিনিয়র রিপোর্টার বলেন, 'ওইদিন বিটিভির অবস্থা ছিল খুবই ভয়াবহ। ভেতরে যারা আটকে পড়েছিলেন তারা খুবই আতঙ্কে ছিলেন। বিকালের দিকে অনেকের অফিস শেষ হলেও তারা রাত ১০টায়ও অফিস থেকে বের হতে পারেননি। কেউ বের হতে চাইলেই চারদিক থেকে ইট-পাটকেল ছোড়া হচ্ছিল।

তিনি বলেন, 'আন্দোলনকারীরা আমাদের একাধিক ক্যামেরা ভাঙচুর করেছে। তারা আমাদের রিসিপশন, ক্যান্টিন ভেঙে পুড়িয়ে দিয়েছে। এরপর ১২তলা বিল্ডিংয়ে ঢুকে অনেক আর্কাইভ নষ্ট করে ফেলেছে। এমনকি স্টুডিওর ভেতরেও প্রবেশ করে তারা একাধিক ক্যামেরা ভাঙচুর করেছে। সব মিলিয়ে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।'

সম্প্রচার সম্পর্কে বিটিভির ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, 'আপাতত বিশেষ নিউজগুলোর জন্য একটা টিম করা হয়েছে। তাদের দিয়েই নিউজ চালানো হচ্ছে। এ ছাড়া একটি-দুটি গাড়ি রাখা হয়েছে, যেগুলো দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ কিছু থাকলে কাভার করা হচ্ছে। আর বাকি সব অন্য টেলিভিশন চ্যানেল থেকে রেকর্ড করে চালানো হচ্ছে।'

ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণে একাধিক তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। বিটিভির পক্ষ থেকে একটি, অন্যটি তথ্য মন্ত্রণালয় থেকে করা হয়েছে। তারা ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ করছে। যে কারণে মূল ক্ষয়ক্ষতিটা আপাতত বলা যাচ্ছে না।'

প্রতিষ্ঠানটির এক নারীকর্মী বলেন, আমাদের বলা হয়েছে অন্য টেলিভিশন থেকে আপাতত খবরগুলো সংগ্রহ করতে। বিটিভির একটি সুবিধা হলো তারা মেয়েদের খুব বেশি রিস্কের মধ্যে ফেলতে চায় না। বিটিভির একেবারে কাছে যাদের বাসা, তাদের দিয়েই কাজ করানো হচ্ছে।

কমপক্ষে ২০০ কোটি টাকার ক্ষতি

এদিকে বাংলাদেশ টেলিভিশনে হামলা ও অগ্নিকান্ডের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ জানতে তদন্ত কমিটি গঠনের কথা জানিয়ে প্রতিষ্ঠানটির মহাপরিচালক (ডিজি) ড. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, 'ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ এখনো নিরূপণ করা যায়নি। তবে আমরা ধারণা করছি কমপক্ষে ২০০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। হামলাকারীরা বিটিভির কেন্দ্রে আগুন দিয়েছে, ক্যামেরাসহ অনেক কিছুই পুড়িয়ে দিয়েছে। অনেক যন্ত্রপাতি লুটপাটও করেছে। নির্দিষ্ট করে ক্ষতির পরিমাণ বের করতে হলে আমাকে তালিকা করতে হবে।'

তিনি বলেন, 'আন্দোলনকারীরা আমাদের ১৭টি গাড়ি পুড়িয়েছে, ৯টি গাড়ি ভাঙচুর করেছে, দুটি সম্প্রচার ভ্যান পুড়িয়ে দিয়েছে। ঢাকা কেন্দ্রের দ্বিতীয়তলায় ২৫টি কক্ষ এবং তৃতীয় তলার ১৬টি কক্ষে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করেছে। সব মিলিয়ে ভয়াবহ একটা হামলা ও অগ্নিকান্ড বিটিভিতে হয়েছে, যেই পরিস্থিতি আমাদের পক্ষে তুলে ধরাও কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।'

তিনি জানান, প্রথম হামলার পরপরই আমরা নিরাপত্তা বাহিনী এবং আমাদের বিভিন্ন দপ্তর-সংস্থাকে অবহিত করেছি। ফায়ার সার্ভিসকে জানিয়েছি। কিন্তু তারা আসতে পারেনি। দুপুরের পর থেকে আমাদের কিছু কর্মী প্রাণের ভয়ে স্টেশন ত্যাগ করেন। আবার কিছু কর্মী আমার সঙ্গে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার প্রাণপণ চেষ্টা করেন। যখন সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছিল, পরিস্থিতি আমরা আর সামাল দিতে পারছিলাম না। তখন আমাদের কর্মীদের নিয়ে সিদ্ধান্ত নেই শাটডাউন করার। কারণ ৬টার দিকে যখন হামলকারীরা আসে, তারা 'বিটিভি এখনও চলছে কেন?' চিৎকার করে বলছিল। আমরা বুঝতে পারছিলাম, তারা কন্ট্রোল রুমের দিকে যেতে পারে।

তিনি বলেন, 'আমাদের কর্মীরা তখন পুরো বিটিভির লাইট নিভিয়ে দেয়, কন্ট্রোল রুম তালা দিয়ে দরজার সামনে আবর্জনার স্তূপ রেখে দেয়। রাত সাড়ে ৮টার দিকে দুজন ম্যাজিস্ট্রেট ও বিজিবি সদস্যরা আসেন। তারা আমাকে বলেন, তারা আমাদের নিরাপদে বের করে নিয়ে যেতে এসেছেন। তখন আমরা বিটিভি থেকে বেরিয়ে যাই।'

বিটিভির কর্মীরা স্টেশন ত্যাগ করার পরও হামলাকারীরা ফের ভেতরে প্রবেশ করে ভাঙচুর করে। তাদের আবার আগুন দিতে দেখেছেন বিটিভির একাধিক কর্মী। রাস্তা থেকে সেই দৃশ্য দেখেছেন তারা।

আগুনের পরদিনই আমরা সম্প্রচার পুনরুদ্ধার করেছি উলেস্নখ করে মহাপরিচালক আরও বলেন, 'এখনো আমরা নতুন অনুষ্ঠান বানাতে পারছি না, তবে পুরনো অনুষ্ঠানগুলো দিয়েই আমরা সম্প্রচার কার্যক্রম পরিচালনা করছি।'

আইনি ব্যবস্থা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'আমাদের তদন্ত কমিটিকে ১০ কর্মদিবসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে। তারা এ সময়ের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে পারবে কি না সন্দেহ আছে। আমরা তদন্ত প্রতিবেদন পাওয়ার পরই এ বিষয়ে পরবর্তী করণীয় নির্ধারণ করব।'

বিটিভির সহ-সম্পাদক মোহাম্মদ আজিম আনোয়ার বলেন, 'সেদিন বেলা ২টায় দ্বিতীয় দফায় হামলাকারী যারা এসেছিলেন, তাদের মধ্যে অনেক মধ্যবয়স্ক লোক ছিলেন। হামলাকারীদের মধ্যে শিশুরাও ছিল, দেখে মনে হয়েছে তারা পথশিশু। একটি ছোট মেয়েকেও দেখেছি হামলাকারীদের সঙ্গে। হামলাকারী সবাই ছাত্র ছিল না। নানা বয়সের লোক ছিল।'

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে