রোববার, ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২৪ ভাদ্র ১৪৩১
কোটা সংস্কার আন্দোলন

বিমান-পর্যটন খাতে ১২ হাজার কোটি টাকার বেশি ক্ষতি!

পর্যটন নগরী কক্সবাজারে পর্যটক শূন্যতায় সৈকতসহ বিনোদনকেন্দ্রগুলো খাঁ খাঁ করছে
আলতাব হোসেন
  ২৫ জুলাই ২০২৪, ০০:০০
বিমান-পর্যটন খাতে ১২ হাজার কোটি টাকার বেশি ক্ষতি!

কোটা সংস্কার আন্দোলনের কারণে দেশব্যাপী কারফিউ, টানা তিন দিন সাধারণ ছুটি ও ইন্টারনেট বন্ধে দেশের অর্থনীতিতে বড় ক্ষত তৈরি করেছে। এর আঁচ লেগেছে বিমান ও পর্যটন শিল্পে। সহিংসতা ও কারফিউর প্রভাবে বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়েছে বিমান ও পর্যটন শিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একাধিক খাত। মাত্র ছয় দিনে বিমানের ক্ষতি হয়েছে প্রায় সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে পর্যটন ও ট্রাভেল এজেন্টদের ক্ষতি ৮ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। প্রাথমিক হিসাবে প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে। পূর্ণাঙ্গ হিসাবে এই দুই খাতের ক্ষতি আরও বাড়তে পাড়ে। কর্মহীন হয়ে পড়েছেন প্রায় ১০ লাখ মানুষ। অস্তিত্ব সংকটের সম্মুখীন এই দুই খাতসহ সংশ্লিষ্টরা।

বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের পরিচালক (সেলস) কামাল উদ্দিন মাহমুদ জানান, ইন্টারনেটসেবা না থাকায় বিমানে পণ্য ও যাত্রী পরিবহণসেবা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কার্গো বিমানে পণ্য পরিবহণ কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় না হওয়ায় এই খাতে দিনে অন্তত ৮০০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। একই কারণে দেশের প্রায় ৪ হাজার ট্রাভেল এজেন্সি বন্ধ হয়ে যায়। এতে বিমানের টিকিটও বিক্রি বন্ধ হয়ে যায়। টিকিট খাতেই ক্ষতি হয় দিনে প্রায় ১০০ কোটি টাকা। ফলে এই খাতে দৈনিক ক্ষতির পরিমাণ ছিল ৯০০ কোটি টাকা। এতে ছয় দিনে বিমানের ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়ায় অন্তত ৫ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। বিমান ছাড়াও দেশের অন্যান্য এয়ারলাইন্সগুলোর ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। ক্ষতির পরিমাণ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যেতে পারে।

যথা সময়ে বিমানবন্দরে যাত্রীরা পৌঁছাতে না পারায় বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক রুটের প্রায় ৩৮টি ফ্লাইট বিলম্বে ছাড়তে হয়েছে। এতে ফ্লাইট বাতিল বা বিলম্বের কারণে যাত্রীরা দুর্ভোগে পড়েন। বিশেষ করে অভিবাসী শ্রমিকরা ঢাকা বিমানবন্দরে ভোগান্তিতে পড়েন। এতে আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়ে বিমান পরিবহণ খাত। এ যেন এক হ-য-ব-র-ল অবস্থা তৈরি হয়। আন্দোলনের কারণে ঢাকার বনানী ও রামপুরা থেকে বিমানবন্দর যাওয়ার প্রধান দুটি সড়ক সকাল ১০টার পর থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত বন্ধ ছিল। এর মধ্যে নর্দান ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীরা উত্তরা, এআইইউবির শিক্ষার্থীরা কুড়িল বিশ্বরোড, নর্থসাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা নদ্দা এবং বাড্ডায় ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীরা সড়ক অবরোধ করেন। এতে সময়মতো বিমানবন্দরে যেতে পারেননি অনেক যাত্রী। ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সে ১৫ থেকে ২০ শতাংশ যাত্রী ফ্লাইট ধরতে পারেননি। ফ্লাইট বিলম্ব হলেও বাতিল হয়নি। আর এয়ার অ্যাস্ট্রার ১০ থেকে ১৫ শতাংশ যাত্রী ফ্লাইটে আসতে পারেননি।

সরকারি চাকরির নিয়োগে কোটা সংস্কারের দাবিতে চলমান আন্দোলনের প্রভাব পড়ে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে। আন্তর্জাতিক রুটের সন্ধ্যা ৭টার ফ্লাইট রাত ১২টায় নির্দিষ্ট গন্তব্যে উড়ে যায়। শাহজালাল বিমানবন্দর সূত্র জানিয়েছে শিক্ষার্থীদের কোটা আন্দোলন, সংঘর্ষ ও দেশজুড়ে কারফিউ জারির প্রভাবে দেশের অভ্যন্তরে উড়োজাহাজে যাত্রীর চাপ বৃদ্ধি পায়। এ সুযোগে উড়োজাহাজ সংস্থাগুলো টিকিটের বাড়তি দাম নিয়েছে বলেও অভিযোগ তুলেছেন যাত্রীরা।

কোটা সংস্কার দাবিতে আন্দোলন ঘিরে সহিংসতা ও কারফিউর প্রভাব পড়েছে ট্রাভেল এজেন্টসগুলোতে। এতে এসব প্রতিষ্ঠান অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে। অ্যাসোসিয়েশন অব ট্রাভেল এজেন্টস অব বাংলাদেশ (এটিএবি) সভাপতি আব্দুস সালাম আরেফ জানান, ১৮ জুলাই থেকে সব ধরনের ফ্লাইটের টিকিট বিক্রি, তারিখ পরিবর্তন ও হোটেল বুকিং বন্ধ থাকায় এটিএবির লোকসান প্রায় ১০০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। অস্তিত্ব সংকটের সম্মুখীন দেশের প্রায় চার হাজার ট্রাভেল এজেন্ট।

বিমানযাত্রীরা বলেন, দেশের ভেতরে বিভিন্ন গন্তব্যে তাদের কাছ থেকে টিকিটের দাম ১২ থেকে ১৫ হাজার টাকা পর্যন্ত রাখা হয়েছে। তবে উড়োজাহাজ সংস্থাগুলো বলছে, নির্ধারিত ফ্লাইটের অধিকাংশ টিকিট সাধারণত আগাম বিক্রি হয়ে যায়। শেষের দিকে যেসব টিকিট থাকে, তার দাম বেশি হয়। উড়োজাহাজ সংস্থার কর্মকর্তারা বলছেন, সোমবার থেকে যাত্রীর চাপ কমে এসেছে। এখন উল্টো যাত্রীসংকট দেখা দিয়েছে। সোমবার প্রায় অর্ধেক আসন ফাঁকা রেখে ফ্লাইট পরিচালনা করতে হয়েছে। বেসরকারি উড়োজাহাজ সংস্থা ইউএসবাংলা কর্তৃপক্ষ জানান, দেশের মধ্যে বিভিন্ন গন্তব্যে যেতে ব্যবহৃত উড়োজাহাজের টিকিটের ১০ থেকে ১১টি স্তর আছে। এসব স্তরভেদে টিকিটের দাম ৫ হাজার ২০০ থেকে ১১ হাজার ৫০০ টাকা পর্যন্ত। তাই শেষ সময়ে টিকিট নিশ্চিত করলে সর্বোচ্চ দামে কিনতে হয়।

এ বিষয়ে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের মহাব্যবস্থাপক (জনসংযোগ) বোসরা ইসলাম জানান, ক্ষতির পরিমাণ কোথায় গিয়ে ঠেকবে, তা এখনো নিরূপণ করা হয়নি। তবে বিমান ও পর্যটন খাতে ক্ষতির যেসব তথ্য ওঠে আসছে তা আঁতকে ওঠার মতো।

জানা যায়, বিশ্বব্যাপী টিকিট বুকিং, বিতরণ ব্যবস্থা সবকিছুই সম্পূর্ণভাবে অনলাইন যোগাযোগের ওপর নির্ভরশীল উলেস্নখ করে তিনি বলেন, ইন্টারনেট বন্ধ থাকায় আমরা কোনো এয়ারলাইন্সের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারিনি। চলমান সংকটে বিদেশগামী যাত্রীরাও দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। যে যাত্রীরা ইতোমধ্যে টিকিট কিনেছেন এবং ইসু্য করেছেন তারা তাদের গন্তব্যে যেতে পারবেন কি না, তা নিয়ে অনিশ্চয়তার মধ্যে রয়েছেন। ইন্টারনেট বন্ধের কারণে সৃষ্ট সংকটের কারণে দেশেও ফিরতে পারছেন না যাত্রীরা। ইন্টারনেট না থাকায় টিকিট বিক্রি ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে।

কোটা সংস্কার দাবিতে আন্দোলন ঘিরে সহিংসতা ও কারফিউর প্রভাব পড়েছে পর্যটন শিল্পে। সংঘাতময় পরিস্থিতির কারণে পর্যটনশূন্য হয়ে পড়েছে পর্যটন নগরী কক্সবাজার। পর্যটক শূন্যতায় কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতসহ বিনোদনকেন্দ্রগুলো খাঁ খাঁ করছে। কক্সবাজারের ছোট-বড় ৩ শতাধিক আবাসিক হোটেলে সুনসান নীরবতা বিরাজ করছে। হোটেল রেস্তরাঁগুলোরও একই অবস্থা। কোটা আন্দোলনের আগে কক্সবাজার ও পার্বত্য তিন জেলায় বেড়াতে গিয়ে আটকা পড়েন কয়েক হাজার পর্যটক।

সহিংসতা ও কারফিউর প্রভাব পড়ে পাহাড়ের পর্যটন শিল্পে। রাঙ্গামাটির সাজেক ভ্যালিসহ তিন পার্বত্য জেলার ছোট-বড় পর্যটন কেন্দ্রগুলোর সবই এখন পর্যটকশূন্য। সড়ক যোগাযোগ বন্ধ থাকায় এলাকাগুলোয় আটকে পড়া পর্যটকরাও এরই মধ্যে গন্তব্যে ফিরে গেছেন। এক সপ্তাহ ধরে চলমান এ পরিস্থিতিতে পর্যটক-খরায় পড়েছেন উদ্যোক্তারা।

পাহাড়ের পর্যটন শিল্পের ওপর দেশের চলমান পরিস্থিতির প্রভাব রয়েছে বলে মনে করেন রাঙ্গামাটির কটেজ মালিকরা। তারা বলছেন, পরিস্থিতি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরলে পাহাড়ের পর্যটন খাত ঘুরে দাঁড়াতে পারবে। রাঙ্গামাটির পাশাপাশি অন্য দুই পার্বত্য জেলার পর্যটন খাতের অবস্থাও একই বলে জানিয়েছেন সেখানকার উদ্যোক্তারা। সাজেক কটেজ মালিক সমিতির সহকারী সাধারণ সম্পাদক মতিজয় ত্রিপুরা জানান, সাজেকে ব্যবসার পরিস্থিতি ভালো নয়। সাজেক ভ্যালি পর্যটকশূন্য। এ এলাকার ব্যবসায়ীরা দোকানপাট বন্ধ রেখে বাড়িতে চলে গেছেন। রিসোর্ট ও কটেজগুলোতেও দু-একজন ছাড়া কর্মীর উপস্থিতি নেই। মোবাইল নেটওয়ার্কও ঠিকমতো পাওয়া যাচ্ছে না। একই চিত্র রাঙ্গামাটির অন্য হোটেল মোটেল ও রিসোর্টগুলোয়ও।

সিলেট ও সুনামগঞ্জে মে মাস থেকে তিন দফা বন্যা হয়। বন্যার রেশ কাটার আগেই কোটা সংস্কার আন্দোলনে দেশজুড়ে অচলাবস্থা চলে। গত তিন মাস সিলেটে দেখা মেলেনি পর্যটকের। এ ভরা মৌসুমে সিলেট বিভাগে পর্যটন খাতে ক্ষতি হয়েছে ৫০০ কোটি টাকার ওপরে। পর্যটনশিল্প ঘিরে সিলেটে গড়ে উঠেছে কয়েকশ' হোটেল, মোটেল, রিসোর্ট ও গেস্টহাউস। এ খাতে বিনিয়োগ কয়েক হাজার কোটি টাকা।

বাংলাদেশ পর্যটন শিল্প ফোরামের মহাসচিব সাইদুল ইসলাম মারুফ বলেন, কোটা সংস্কার দাবিতে আন্দোলন ঘিরে সহিংসতা ও কারফিউর প্রভাবে সারাদেশে হোটেল, মোটেল, পর্যটন স্পটগুলোতে প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকার বেশি ক্ষতি হয়েছে।

পর্যটন খাত বিশ্লেষক মতিউর রহমান মাইকেল জানান, কোটা আন্দোলনের ক্ষতির পরিমাণ কোথায় গিয়ে ঠেকবে, তা এখনো নিরূপণ হয়নি। হাজারো খাতের মধ্যে শুধু রপ্তানিমুখী তৈরি বিমান ও পর্যটন খাতে ক্ষতির পরিমাণ ১২ হাজার টাকা। এ ছাড়া পোশাক, পরিবহণ, স্টিল, সিরামিক, সিমেন্ট ও ই-কমার্স খাতেই গত ছয় দিনে প্রায় ১৮ হাজার ৪০০ কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতি হয়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। এই সময়ে সরকারের রাজস্ব ক্ষতি হয়েছে প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকা।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে