জীবাশ্ম জ্বালানি (কয়লা, গ্যাস ও প্রাকৃতিক গ্যাস) পোড়ানোর ফলে পরিবেশে বিপুল পরিমাণে গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গত হয়, যা জলবায়ু পরিবর্তনের অন্যতম প্রধান কারণ। যে কারণে বিশ্বের পরিবেশবাদীরা জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমানো, ব্যয়বহুল ও পরিবেশ দূষণকারী পরিকল্পনা থেকে সরে এসে নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে গুরুত্ব দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন। বিশ্লেষকরা বলছেন, পরিবেশবাদীদের দাবি উপেক্ষা করে বিদু্যৎ ও জ্বালানি খাতের সমন্বিত মহাপরিকল্পনায় (মাস্টারপস্ন্যান ২০২৩-আইইপিএমপি) সরকার ২০৫০ সালের মধ্যে সর্বোচ্চ ২৫ শতাংশ নবায়নযোগ্য বিদু্যতের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। এ সময় বৈশ্বিক লক্ষ্য দাঁড়াবে ৮০ শতাংশের বেশি। এছাড়া মহাপরিকল্পনার প্রস্তাবনা অনুযায়ী, জ্বালানি মিশ্রণে দেশকে অনেকাংশে আমদানিনির্ভর করে তুলবে, যা দেশে অর্থনৈতিক সংকট তৈরি করতে পারে। ফলে সব মিলিয়ে আইইপিএমপি সংশোধন করে নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে গুরুত্ব দেওয়ার তাগিদ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
পর্যবেক্ষকরা বলছেন, সমন্বিত মহাপরিকল্পনায় জাপান থেকে হাইড্রোজেন ও অ্যামোনিয়া আমদানির কথা বলা হয়েছে। সৌরশক্তির সবচেয়ে সম্ভাবনাময় খাত রুফটপ সোলারকে (সৌরছাদ) তেমনভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। এছাড়া পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ২০৫০ সাল পর্যন্ত ৩০০ বিলিয়ন ডলার খরচ ধরা হয়েছে। মাস্টারপস্ন্যানে ২০৫০ সাল পর্যন্ত জ্বালানি অবকাঠামো খাতে খরচ ধরা হয়েছে ১৭৯ বিলিয়ন ডলার। বিদু্যৎকেন্দ্র নির্মাণে খরচ ধরা হয়েছে ১১৮ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার।
পরিকল্পনা মতে, ২০৩০ সালে দেশে বিদু্যতের সর্বোচ্চ চাহিদা বেড়ে দাঁড়াবে ২৭ হাজার ৮৭ মেগাওয়াট, বিদু্যৎ উৎপাদনের সক্ষমতা থাকবে ৪১ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট, চাহিদার চেয়ে যা ৫২ দশমিক ৮৪ শতাংশ বেশি। ২০৪১ সালে বিদু্যতের চাহিদা ধরা হয়েছে ৫০ হাজার ৩৬৪ মেগাওয়াট, এর বিপরীতে উৎপাদনের সক্ষমতা রাখতে বলা হয়েছে ৭৪ হাজার ৩০০ মেগাওয়াট, যা চাহিদার চেয়ে ৪৭ শতাংশ বেশি। ২০৫০ সালে দেশে বিদু্যতের সর্বোচ্চ চাহিদা বেড়ে দাঁড়াবে ৭১ হাজার ৫১২ মেগাওয়াট। তখন উৎপাদন-সক্ষমতা হতে পারে ১ লাখ ১১ হাজার মেগাওয়াট, যা চাহিদার চেয়ে ৫৫ শতাংশ বেশি।
পরিবেশবাদীরা অভিযোগ করেছেন, সরকারের এ মহাপরিকল্পনায় শুধু গ্যাস নয়, বরং ক্লিন এনার্জির নামে জলবিদু্যৎ আমদানিসহ সবুজ হাইড্রোজেন ও অ্যামোনিয়া আমদানিকে উৎসাহিত করা হয়েছে।
তড়িৎ প্রকৌশলী ও টেকসই উন্নয়নবিষয়ক গবেষক ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব একটি লেখায় বলেছেন, 'পোশাকশিল্পে বাংলাদেশের প্রধানতম প্রতিদ্বন্দ্বী দেশ ভিয়েতনাম ২০২২-২৩ সালে এক বছরেই ১০ হাজার মেগাওয়াট সৌরবিদু্যৎ উৎপাদনের লক্ষ্য বাস্তবায়ন করে ফেলেছে সফলভাবে। সেখানে নতুন পরিকল্পনায় বাংলাদেশকে মাত্র ৬ হাজার মেগাওয়াটের ল্যান্ডমার্ক অতিক্রম করতে ২০৫০ সাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে- এটা চরম অদূরদর্শী।'
তিনি বলেন, 'পরিকল্পনায় বিদু্যৎ উৎপাদনের মূল জ্বালানি হিসেবে গ্যাসকেই রাখা হয়েছে, ২০৪১ সালে গ্যাস থেকে ৪০ শতাংশ বিদু্যৎ থাকছে। গ্যাসের জোগানের জন্য মূলত আমদানি করা ব্যয়বহুল এলএনজির ওপরই নির্ভর করতে হবে, মহাপরিকল্পনার প্রাক্কলন অনুসারে স্থল ও সমুদ্রে সব ধরনের উন্নয়ন ও অনুসন্ধান শেষে ২০৪১ সালের ৪০০ কোটি ঘনফুট চাহিদার বিপরীতে দেশি গ্যাসের সরবরাহ দাঁড়াবে দিনে ১৭০ কোটি ঘনফুট (বর্তমানে দৈনিক ২১০ কোটি ঘনফুটের কম)। বাকি ২৩০ কোটি ঘনফুট আমদানিনির্ভর। ২০৫০ সালে গ্যাসের দৈনিক চাহিদা দাঁড়াবে ৫৩০ কোটি ঘনফুট, যা মূলত আমদানিনির্ভর।'
বাংলাদেশের বার্ষিক গড় বায়ুপ্রবাহের নিম্নগতি বিবেচনায় নিলে ২০৫০ সালে ২০ হাজার মেগাওয়াট বায়ুবিদু্যৎ প্রাক্কলন উচ্চাভিলাষী, তবে যদি সম্ভবপর হয়, এটা দেশের জন্য অবশ্যই ভালো, যা মাস্টারপস্ন্যানের পজিটিভ দিক বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। তবে এর বিপরীতে দেশের সৌরদীপন ক্ষমতা ইউরোপের দেড় গুণ হওয়া সত্ত্বেও ২০৫০ সালে মাত্র ৬ হাজার মেগাওয়াট সৌরবিদু্যৎ অগ্রহণযোগ্য বলেও মনে করেন তারা।
নতুন মহাপরিকল্পনা বিশ্বব্যাপী অনুমানের চেয়ে দ্বিগুণ বেশি হাইড্রোজেন-অ্যামোনিয়া প্রস্তাব করা হয়েছে। হাইড্রোজেন-বিদু্যৎ প্রযুক্তি পুরনো হলেও অত্যন্ত ব্যয়বহুল। ফলে বাণিজ্যিক বিকাশে এটা শৈশব পার করছে মাত্র। সাশ্রয়ী প্রযুক্তিগত অগ্রগতি অর্জিত হলেও হাইড্রোজেন ও অ্যামোনিয়া জ্বালানি সরবরাহে আন্তর্জাতিক স্ট্যান্ডার্ড মেনে প্রচুর নতুন অবকাঠামো ও সাপোর্ট সিস্টেমের প্রয়োজন হয়। এ ছাড়া অ্যামোনিয়া পোড়ালে নাইট্রাস অক্সাইড তৈরি করে, যা কার্বন ডাই-অক্সাইডের চেয়েও গ্রিনহাউস গ্যাস হিসেবে ২৭৩ গুণ খারাপ। যদিও বিদু্যৎ উৎপাদনের বাইরে সারশিল্পে হাইড্রোজেন ও অ্যামোনিয়া দরকার। কিন্তু আমদানির পাশাপাশি বৈদেশিক ঋণ গ্রহণ করে এত খরচ বহন করা টেকসই পরিকল্পনা নয়। ফলে এই মহাপরিকল্পনা পুনর্বিবেচনা করে নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে অধিক মনোযোগ দেওয়া জরুরি বলে মনে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত এবং কার্বন-ডাই অক্সাইড নিঃসরণ হ্রাস করার অন্যতম উপায় হিসেবে নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতকে সরকার গুরুত্ব দিচ্ছে। এরই মধ্যে বিকল্প জ্বালানির স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদী লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। গঠন করা হয়েছে টেকসই ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ।
বর্তমানে দেশে নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে ১ হাজার ১৯৪ দশমিক ৭০ মেগাওয়াট বিদু্যৎ উৎপাদন করা হচ্ছে, যা মোট বিদু্যৎ সরবরাহের মাত্র ৪ দশমিক ৩ শতাংশ। প্রধানমন্ত্রী ২০৪১ সালের মধ্যে জ্বালানি রূপান্তরের মাধ্যমে ৪০ শতাংশ নবায়নযোগ্য জ্বালানি লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের কথা বলেছেন।
সম্প্রতি ঢাকায় সমাবেশ করে স্কুল শিক্ষার্থীদের জলবায়ু আন্দোলনের পস্নাটফর্ম 'ফ্রাইডেস ফর ফিউচার'-এর তরুণ জলবায়ুকর্মীরা ব্যয়বহুল ও পরিবেশ দূষণকারী পরিকল্পনা সংশোধনে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
ইয়ুথ নেট ফর ক্লাইমেট জাস্টিসের নির্বাহী সমন্বয়ক সোহানুর রহমান বলেন, 'ইন্টিগ্রেটেড এনার্জি অ্যান্ড পাওয়ার মাস্টার পস্ন্যানকে (আইইপিএমপি) অবশ্যই বাংলাদেশের স্বার্থ দেখতে হবে। এবারের পরিকল্পনায় তিনটি নতুন প্রযুক্তি- হাইড্রোজেন, অ্যামোনিয়া আর কার্বন ক্যাপচার অ্যান্ড স্টোরেজ প্রযুক্তিকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে প্রসার হলেও সৌর ও বায়ুর মতো পরীক্ষিত নবায়নযোগ্য প্রযুক্তির অংশ রাখা হয়েছে সামান্য।'
অন্যদিকে তাদের দাবির সঙ্গে সংহতি জানিয়ে সম্প্রতি এক বার্তায় সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম জানান, বর্তমান আইইপিএমপিতে জীবাশ্ম জ্বালানি এবং হাইড্রোজেন, অ্যামোনিয়া ও কার্বন ক্যাপচারের মতো সমাধানকে প্রাধান্য দিয়ে সরকার বাংলাদেশের জ্বালানি রূপান্তরে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছে এবং দেশের অর্থনৈতিক সম্ভাবনা ও পরিবেশগত ভবিষ্যৎকে হুমকিতে ফেলছে।
এই গবেষণা পরিচালকের ভাষ্যে- 'জাতীয় নবায়নযোগ্য শক্তি লক্ষ্যমাত্রার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করতে এবং মুজিব জলবায়ু সমৃদ্ধি পরিকল্পনায় বর্ণিত একটি টেকসই ভবিষ্যতের দিকে আমাদের অগ্রযাত্রাকে ত্বরান্বিত করতে আইইপিএমপি সংশোধন করা অপরিহার্য।'
বিদু্যৎ বিভাগ সূত্রে জানা যায়, সরকারের নীতি হলো ধীরে ধীরে জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরতা কমিয়ে নবায়নযোগ্য জ্বালানির দিকে যাওয়া এবং সৌর, বায়ু ও জলবিদু্যৎসহ মোট বিদু্যতের ১০ শতাংশ ২০২৫ সাল নাগাদ নবায়নযোগ্য উৎস থেকে উৎপাদনের লক্ষ্যে কাজ করা। বর্তমানে উৎপাদিত নবায়নযোগ্য জ্বালানিভিত্তিক বিদু্যতের মধ্যে সোলারভিত্তিক ৯৬০ দশমিক ৭০ মেগাওয়াট, হাইড্রো ২৩০ মেগাওয়াট, বায়ুভিত্তিক ২ দশমিক ৯ মেগাওয়াট, বায়োগ্যাসভিত্তিক শূন্য দশমিক ৬৯ মেগাওয়াট। বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন লাইসেন্স প্রবিধানমালা ২০০৬ অনুযায়ী ৫ মেগাওয়াট ক্ষমতা পর্যন্ত নবায়নযোগ্য জ্বালানিভিত্তিক বিদু্যৎ উৎপাদনের জন্য লাইসেন্স ওয়েভারের সুযোগ রাখা হয়েছে।
পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের সচিব ডক্টর ফারহিনা আহমেদ জানিয়েছেন, 'বাস্তবতা বিবেচনায় জনস্বাস্থ্য ও মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়ে গুরুত্বারোপ করছে বাংলাদেশ। বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির জন্য দায়ী গ্রিনহাউজ গ্যাস নির্গমন হ্রাসের লক্ষ্যে আপডেট হওয়া এনডিসির লক্ষ্য ২০৩০ সালের মধ্যে গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন ৬ দশমিক ৭৩ শতাংশ কমিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক সহায়তায় ২০৩০ সালের মধ্যে এই হ্রাসের পরিমাণ আরও ১৫ দশমিক ১২ শতাংশ হতে পারে।'#