পস্নাস্টিক ও পলিথিন ব্যবহারের দিক থেকে বাংলাদেশ বিশ্বের শীর্ষ দশম স্থানে উঠেছে। ২০০৫ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে এর ব্যবহার তিন গুণের বেশি বেড়েছে। ঢাকায় একবার ব্যবহারের পর এগুলোর ৮০ শতাংশ মাটিতে ফেলা হচ্ছে। দেশে প্রতিদিন ৩ হাজার টন পস্নাস্টিক বর্জ্য উৎপাদিত হয়। ব্যবহার শেষে ফেলে দেওয়া পস্নাস্টিক এক হাজার বছরেও মাটির সঙ্গে মিশে না। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকের গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী পদ্মা নদীর মাধ্যমে প্রায় ৩০০ ধরনের পস্নাস্টিক পণ্য বঙ্গোপসাগরে পতিত হয়। পদ্মা, মেঘনা ও যমুনা নদী হয়ে বছরে প্রায় ৭৩ হাজার টন পস্নাস্টিক বর্জ্য বঙ্গোপসাগরে গিয়ে জমা হয়।
শহর ও গ্রামীণ জীবনে পস্নাস্টিকের ব্যবহার বাড়ছে। দামে সস্তা ও সহজে বহনযোগ্য হওয়ায় এ পণ্যের জনপ্রিয়তা তুঙ্গে। বাজারের ব্যাগ থেকে শুরু করে ওষুধের বোতল, প্রসাধন সামগ্রীর মোড়ক, পানির বোতল, গৃহস্থালিসহ নানা কাজে এবং বাণিজ্যিকভাবে পস্নাস্টিক ব্যবহার হচ্ছে। পস্নাস্টিক বর্জ্য সহজে পচে না এবং বছরের পর বছরেও মাটির সঙ্গে মিশে না। ফলে তা পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের জন্য মারাত্মক বিপর্যয় হিসেবে দেখা দিয়েছে।
পরিবেশ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, দেশে প্রতিদিন প্রায় ৩৭ হাজার টন পস্নাস্টিক পণ্য এবং এক কোটি ৪৮ লাখ পলিথিন ব্যাগ ব্যবহার হয়। ব্যবহারের পর এসব পস্নাস্টিক বর্জ্য অলিগলি, নর্দমা, ড্রেন হয়ে পড়ছে জলাভূমিতে। পরে জলাভূমির মাছের মাধ্যমে দূষিত পস্নাস্টিকের ক্ষুদ্র কণা মানবদেহে প্রবেশ করছে। জাতিসংঘের তথ্যমতে, বিশ্বে প্রতিবছর ৫০ হাজার কোটি পস্নাস্টিক ব্যাগ, ৪৮ হাজার কোটি পানীয় বোতল উৎপন্ন হয় এবং প্রতি মিনিটে ১০ লাখ পস্নাস্টিক বোতল বিক্রি হয়। এসব পস্নাস্টিকের শেষ গন্তব্য হয় সাগর।
ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, শুধু ঢাকাতেই মাথাপিছু পস্নাস্টিকের ব্যবহার ২২.২৫ কেজি এবং ঢাকায় প্রতিদিনের পস্নাস্টিক বর্জ্যের পরিমাণ ৬৪৬ টন, যা সমগ্র বাংলাদেশের বর্জের ১০ শতাংশ। রাজধানীর চারপাশের চারটি (বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু ও শীতলক্ষ্যা) নদীতে প্রায় ৩০ হাজার টন পস্নাস্টিক বর্জ্য পাওয়া যাচ্ছে, যার অর্ধেকই পাওয়া গেছে বুড়িগঙ্গায়। কক্সবাজারে পর্যটন মৌসুমে প্রতিদিন ১৩০ টন আর্বজনা হয়, যার ৩০ শতাংশ পস্নাস্টিক, যার আবার ৭৮ শতাংশই একবার ব্যবহারযোগ্য পস্নাস্টিক। বঙ্গোপসাগরে মাছের পেটে এবং লবণের মধ্যে ক্ষুদ্র পস্নাস্টিকের অস্তিত্ব পাওয়া যাচ্ছে। পস্নাস্টিক বর্জ্যের দূষণে মানুষের লিঙ্গ পরিবর্তন হয়ে যাওয়া থেকে শুরু করে প্রজননশীলতা কমে যাচ্ছে। নষ্ট হচ্ছে হরমোনের ভারসাম্য। এমনকি ক্যান্সার হচ্ছে। শুধু পস্নাস্টিক বর্জ্যের কারণে প্রতিবছর প্রায় ১০০ মিলিয়ন সামুদ্রিক স্তন্যপায়ী প্রাণী মারা যাচ্ছে। এতে ভারসাম্য হারাচ্ছে সামুদ্রিক পরিবেশ, যা প্রাণিকুল ছাড়াও মানবস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকিস্বরূপ। ২০২১ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের এক গবেষণা অনুযায়ী প্রতি কেজি লবণে গড়ে প্রায় ২ হাজার ৬৭৬টি মাইক্রোপস্নাস্টিক পাওয়া যায়। বাংলাদেশে পস্নাস্টিক দূষণকারীদের তালিকায় শীর্ষে রয়েছে কোমল পানীয় প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো।
পস্নাস্টিক পণ্য সুন্দর ও নমনীয় রাখতে থ্যালেট নামে কেমিক্যাল পদার্থ ব্যবহার করা হয়। এই ক্ষতিকর থ্যালেট পস্নাস্টিক সামগ্রী থেকে খাদ্যে বা পানিতে মিশে যায়। থ্যালেট সিনথেটিক ইস্টোজেন হিসেবেও কাজ করে। থ্যালেটের কারণে প্রাণির শরীরে হরমোনের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে প্রজননশীলতা কমে যায়। এভাবে বিপন্ন প্রজাতির মাছ বা সামুদ্রিক প্রাণির বিলুপ্তি ঘটছে। এই প্রবণতা বৃদ্ধি পেলে ২০৫০ সালের মধ্যে ৯৫ শতাংশ প্রাণী বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে। যার মধ্যে মাছ, শামুক, তিমি, ডলফিন, কুমির ইত্যাদি রয়েছে।
এ বিষয়ে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক বিশেষজ্ঞ ডক্টর অধ্যাপক কামরুল ইমলাম বলেন, পস্নাস্টিক দূষণ রোধে দশ বছরমেয়াদি কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়েছে। সিঙ্গেল ইউজ পস্নাস্টিক বন্ধে তিন বছরমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। নিষিদ্ধকৃত পলিথিন শপিং ব্যাগের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের অংশ হিসেবে জানুয়ারি ২০১৯ তারিখ থেকে এপ্রিল ২০২৩ তারিখ পর্যন্ত মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে ৩ হাজার ৬৯২টি মামলা দায়ের, ৫ কোটি ৪৭ লাখ টাকা জরিমানা আদায়, ১ হাজার ৭৬৩ টন পলিথিন জব্দ এবং ১৬৯ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদন্ড প্রদান করা হয়েছে। দেশে উৎপাদিত পস্নাস্টিক বর্জের ৬০ শতাংশ যাচ্ছে নদীতে। এতে মাছ ও বিভিন্ন প্রাণির শরীরে ঢুকে, সেগুলো মানুষের জীবনচক্র ও শরীরে চলে আসছে।
বৈশ্বিক মোট পস্নাস্টিক দূষণের ২.৪৭ শতাংশ বাংলাদেশে হয়ে থাকে উলেস্নখ করে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ডক্টর ইফতেখারুজ্জামান বলেন, 'পলিথিনের ব্যবহার নিষিদ্ধ করে আইন করা হলেও, কার্যকর প্রয়োগের অভাবে পস্নাস্টিক থেকে পরিবেশ দূষণ শুধু অব্যাহতই নয় বরং উদ্বেগজনকভাবে বৃদ্ধিই পেয়েছে। পস্নাস্টিক বর্জ্যসহ ব্যাপকভাবে বর্জ্য ফেলার কারণে বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু, শীতলক্ষ্যা ও কর্ণফুলী নদী বাংলাদেশের অন্যতম দূষিত নদীতে পরিণত হয়েছে।
পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন- পবা'র সাধারণ সম্পাদক প্রকৌশলী মো. আবদুস সোবহান বলেন, রাজধানীসহ সারা দেশে নিষিদ্ধ পলিথিন তৈরীর প্রায় এক হাজার দুই শত কারখানা রয়েছে। এগুলোর বেশির ভাগই পুরান ঢাকা কেন্দ্রিক। পুরান ঢাকার অলি-গলিতে রয়েছে প্রায় তিন শত কারখানা। কেরানীগঞ্জ, জিঞ্জিরা, কামরাঙ্গীরচর, মিরপুর, কারওয়ান বাজার, তেজগাঁও, টঙ্গীতে ছোট-বড় বেশ কিছু কারখানা রয়েছে। যাত্রাবাড়ী থেকে নারায়ণগঞ্জের ফতুলস্না পর্যন্ত বুড়িগঙ্গার পাড়ঘেঁষে গড়ে উঠেছে শতাধিক কারখানা। ঢাকা ও এর আশপাশের এলাকা ছাড়াও চট্টগ্রামসহ জেলা শহরগুলোতে গড়ে উঠেছে শত শত পলিথিন কারখানা। 'জরুরি রপ্তানি কাজে নিয়োজিত' লেখা যানবাহনে করে ঢাকাসহ বিভিন্ন এলাকায় পাঠানো হচ্ছে নিষিদ্ধ পলিথিন।
তিনি আরও বলেন, ঢাকা শহরে একটি পরিবার প্রতিদিন গড়ে পাঁচটি পলিথিন ব্যাগ ব্যবহার করে। সে হিসেবে শুধু ঢাকা শহরে প্রতিদিন আড়াই কোটির বেশি পলিথিন ব্যাগ একবার ব্যবহার করে ফেলে দেওয়া হয়। এগুলো দ্বারা ড্রেন, নালা-নর্দমা, খাল, ডোবা ইত্যাদি ভরাট হয়ে পানির প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে এবং সামান্য বৃষ্টিতেই জলাবদ্ধতার প্রকোপ বাড়িয়ে দিচ্ছে। এছাড়াও দেশে প্রতিদিন ৩৫ লাখের বেশি টিসু্য ব্যাগ উৎপাদন ও বাজারজাত হচ্ছে। এসব ব্যাগ পলিথিনের হলেও কাপড়ের ব্যাগ হিসেবে চালিয়ে দেওয়া হচ্ছে। শপিং মল, ডিপার্টমেন্টাল স্টোর, কাপড়ের দোকান, জুতার দোকান, ফ্যাশন হাউজ, বিভিন্ন কোম্পানিসহ সারাদেশের বাণিজ্যিক বিতানগুলো টিসু্য ব্যাগ ব্যবহার করছে। নিষিদ্ধ পলিথিন ও টিসু্য ব্যাগ উৎপাদন ও বাজারজাতকরণের ফলে কাগজ, পাট ও কাপড়ের ব্যাগের উৎপাদন ও ব্যবহার নেই বললেই চলে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, বাংলাদেশ ২০০২ সালে পলিথিন ব্যবহার, উৎপাদন, ক্রয়-বিক্রয়, আমদানি-রপ্তানি নিষিদ্ধ করে পরিপত্র জারি করে এবং বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইনে সংশোধনী এনে পলিথিন ব্যবহার, উৎপাদন, ক্রয়-বিক্রয়, আমদানি-রপ্তানি নিষিদ্ধ করে এবং শাস্তির বিধান সংযোজন করে। পলিথিনের ক্ষতিকর দিকগুলো বিবেচনা করে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়, পরিবেশ সংরক্ষণ আইন-১৯৯৫-এর ৬ক ধারার অধীনে প্রজ্ঞাপন জারির মাধ্যমে ২০০২ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ঢাকা শহরে এবং ২০০২ সালের ১ মার্চ থেকে সারাদেশে পলিথিন ব্যাগ উৎপাদন, আমদানি, বাজারজাতকরণ, বিক্রয়, মজুত, বিতরণ এবং ব্যবহার সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। পাটের ব্যাগ ব্যবহার চালু করার কথা থাকলেও এখনো তা বাজারজাত করা যায়নি।