কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা উপজেলার রামচন্দ্রপুর গ্রামের রাসেল আলী এসএসসি পরীক্ষার পর ২০১৩ সালে ঢাকায় তার বড় ভাইয়ের কাছে চলে যান। এর কয়েক বছর পরে ভারতে গিয়ে একটি হাসপাতালে চাকরি নেন। এলাকাবাসী জানেন, রাসেল ভারতের কোনো একটি হাসপাতালের বড় অফিসার। আগে বাসে করে বাড়ি এলেও গত কয়েক বছর ধরে আসছেন দামি প্রাইভেট গাড়িতে চড়ে। গত ঈদেও বাড়ি এসেছেন। গরিবদের মাঝে শাড়ি, লুঙ্গিসহ নগদ টাকা বিতরণ করেছেন। ঢাকায় বাড়ি আছে বলে এলাকায় গুঞ্জন রয়েছে। সম্প্রতি তিনি ভারতে পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হয়েছেন। আর এ খবরে এলাকাবাসী হতবাক।
রাসেল আলী ভারতীয় পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হওয়ার পরও এ বিষয়ে মুখ খোলেননি রাসেলের মা আলেকা বেগম।
গ্রামের মনোয়ার বেগম বলেন, 'রাসেল আলী ভদ্র ছেলে। বহু বছর ধরে গ্রামের বাইরে থাকে। আগে ঢাকায় থাকতো, এখন ভারতে থাকে। ভারতের হাসপাতালে চাকরি করে। রাসেল এলাকায় এলে ভালো কাজ করত, গরিবদের মাঝে দান খয়রাত করত। আমরা তাকে ভালো মানুষ হিসেবে জানতাম। সে কখনো এলাকায় খারাপ কাজ করেনি। কিন্তু সে কিডনি চক্রের সঙ্গে যুক্ত সেটা কয়েকদিন আগে জানতে পেরেছি। তাকে ভারতের পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে।'
আবু হানিফ নামের আরেকজন প্রতিবেশী বলেন, 'রাসেল আলী ভারতের হাসপাতালে চাকরি করত বলে শুনেছি। গত ঈদে রাসেল দামি প্রাইভেট কার নিয়ে বাড়িতে এসেছিল। আগে লোকাল বাসে আসত। এলাকায় তেমন কোনো সম্পদ নেই। শুনেছি, ঢাকায় নাকি বাড়ি-গাড়ি আছে। আগে সাধারণভাবে চলাচল করত। এখন তো ভিআইপি হয়ে গেছে। মনে হয় বড় অফিসার। সে পরিচয় দিত ভারতের হাসপাতালের বড় কর্মকর্তা। কয়েক বছর ধরে তার চলাফেরা ভিআইপিদের মতো। তাকে নিয়ে তদন্ত করা উচিত। তদন্ত করলে হয়তো অবৈধভাবে গড়া সম্পদের খোঁজ পাওয়া যেতেও তো পারে। কারণ সে কিডনি পাচার চক্রের লোক। তাকে ভারতের পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে। এলাকায় তার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ নেই। সে এলাকায় কোনো খারাপ কাজ করেনি। ভদ্র ও ভালো মানুষের মতো চলাফেরা করত।'
ধরমপুর ইউনিয়নের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য জিয়াউর রহমান বলেন, 'কিডনি পাচারের অভিযোগে রাসেলকে ভারতের পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে বলে শুনেছি। এ বিষয়ে আমি কিছুই জানি না। তবে আমার জানা মতে, এলাকায় তার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ নেই। এলাকার মানুষ তাকে ভালো ও ভদ্র মানুষ হিসেবেই জানেন। রাসেল আলী ১০ বছর ধরে বাইরে থাকে।'
ভেড়ামারা থানা অফিসার ইনচার্জ জহুরুল ইসলাম জহির বলেন, 'রাসেল আলীকে ভারতের পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে বলে জানতে পেরেছি। এলাকায় তার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ পাইনি। তার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ পেলে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।'
সম্প্রতি ভারতের রাজস্থানে একটি কিডনি চক্রের কয়েক সদস্য ধরা পড়ে। সেখান থেকে তথ্য পায় পুলিশ। এই তথ্যের ভিত্তিতে বাংলাদেশ ও ভারতে অবৈধভাবে কিডনি ট্রান্সপস্ন্যান্ট চক্রের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে দিলিস্নর ইন্দ্রপ্রস্থ অ্যাপোলো হাসপাতালের চিকিৎসক বিজয়া কুমারী (৫২) ও তিন বাংলাদেশিকে গ্রেপ্তার করে দিলিস্ন পুলিশ। এই চক্র দালালদের মাধ্যমে বাংলাদেশি রোগীদের দিলিস্নর বিভিন্ন সেরা হাসপাতালে কিডনি ট্রান্সপস্ন্যান্টের প্রলোভন দেখিয়ে বিজয়া কুমারী ও তার সহযোগীদের কাছে নিয়ে আসতেন। আল শিফা নামে একটি মেডিকেল টু্যরিজম প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে দাতা ও গ্রহীতার মধ্যে সমন্বয়, চিকিৎসা, মেডিকেল পরীক্ষার কাজগুলোর ব্যবস্থাপনা করা হতো।
ভারতের পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, কুষ্টিয়ার ভেড়ামারার রাসেল আলী, মোহাম্মদ সুমন মিয়া ও ইফতি নামের তিন বাংলাদেশি এবং ত্রিপুরার বাসিন্দা রতিশ পাল তাদের নিজ নিজ এলাকা থেকে আগ্রহী কিডনিদাতাদের মোটা অঙ্কের অর্থের প্রলোভন দেখিয়ে দিলিস্নতে নিয়ে আসতেন। কিডনিদাতাদের চক্রটি চার থেকে পাঁচ লাখ রুপি দিলেও কিডনি গ্রহীতাদের কাছ থেকে ২৫ থেকে ৩০ লাখ রুপি আদায় করতেন। ইফতি ছাড়া অভিযুক্ত বাকি তিন ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
বাংলাদেশের কুষ্টিয়ার ভেড়ামারার বাসিন্দা রাসেলের পাশাপাশি মিঞা ও মোহাম্মদ রোকন নামে দুই ব্যক্তি জিজ্ঞাসাবাদের সময় একই অ্যাপার্টমেন্টে ছিলেন। গ্রেপ্তারের সময় রাসেলের কক্ষ থেকে একটি ব্যাগে নয়টি পাসপোর্ট, দুটি ডায়েরি ও একটি রেজিস্টার খাতা উদ্ধার করা হয়। এর মধ্যে তিনটি পাসপোর্ট কিডনিদাতা ও গ্রহীতার এবং ডায়েরিতে তাদের মধ্যে আর্থিক লেনদেনের বিস্তারিত লেখা ছিল।