বেরিয়ে আসছে ক্ষত বাড়ছে রোগবালাই
সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি
প্রকাশ | ১৬ জুলাই ২০২৪, ০০:০০
যাযাদি ডেস্ক
দেশের বন্যাকবলিত এলাকা রংপুর, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা ও সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুরে নদ-নদীর পানি কমতে শুরু করেছে। ফলে বিভিন্ন সড়কের ক্ষয়-ক্ষতি দৃশ্যমান হচ্ছে। পাশাপাশি সর্দি-কাশিসহ পানিবাহিত রোগের প্রাদুর্ভাব বাড়ছে। দেখা দিয়েছে বিশুদ্ধ পানির সংকট।
এদিকে, বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের (এফএফডবিস্নউসি) বুলেটিনে জানানো হয়, সোমবার সকাল ৯টা থেকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ব্রহ্মপুত্র-যমুনা নদীর পানি হ্রাসের প্রবণতা রয়েছে, যা আগামী ৭২ ঘণ্টা অব্যাহত থাকতে পারে।
বুলেটিনে বলা হয়েছে, পদ্মা নদীর পানির স্তর স্থিতিশীল থাকলেও গঙ্গা নদীর পানি বৃদ্ধির প্রবণতা রয়েছে, যা ৭২ ঘণ্টা অব্যাহত থাকতে পারে। তবে বাংলাদেশের প্রধান নদ-নদীগুলোর পানি সামগ্রিকভাবে হ্রাস পাচ্ছে।
আগামী ৭২ ঘণ্টায় কুড়িগ্রাম, জামালপুর, গাইবান্ধা, বগুড়া, টাঙ্গাইল ও সিরাজগঞ্জ জেলায় ব্রহ্মপুত্র-যমুনা নদী সংলগ্ন নিম্নাঞ্চলের বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হতে পারে বলেও জানানো হয়।
কুড়িগ্রামে পানিবাহিত রোগের প্রকোপ :কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি জানান, জেলায় পানিবন্দি মানুষের মধ্যে বেড়েছে পানিবাহিত রোগের প্রকোপ। বিশেষ করে স্যানিটেশন ব্যবস্থা ভেঙে পড়ায় চরম ভোগান্তিতে পড়েছে বানভাসিরা। এসব এলাকায় মানুষজনের মধ্যে পা-হাতে সাদা ঘা, চুলকানি, জ্বর ও পাতলা পায়খানাসহ দেখা দিয়েছে বিভিন্ন পানিবাহিত রোগ। সঠিক পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থা না থাকায় নারী ও কিশোরীরা বেশি সমস্যায় পড়েছে।
সদর উপজেলার রলাকাটার চরের বেসরকারি সংস্থার স্বাস্থ্যকর্মী হাসিনা বেগম সংবাদমাধ্যমকে বলেন, বন্যার কারণে চরের মানুষের জ্বর, সর্দি-কাশি ও ডায়রিয়ার প্রকোপ দেখা দিয়েছে।
যাত্রাপুর ইউনিয়নের কালির আলগা গ্রামের সফিকুল ইসলাম সংবাদমাধ্যমকে বলেন, বাড়ির সবাই ডায়রিয়া ও জ্বরে আক্রান্ত।
কুড়িগ্রাম সদরের স্বাস্থ্যকর্মী আব্দুল হান্নান সংবাদমাধ্যমকে বলেন, বিভিন্ন জায়গা থেকে খবর পাচ্ছি জ্বর ও ডায়রিয়ার প্রকোপ বেড়েছে। প্রাথমিকভাবে সবাইকে কুড়িগ্রাম সদর হাসপাতালে ভর্তির পরামর্শ দিচ্ছি।
জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সাইদুল আরীফ সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন, ত্রাণের মজুদ বাড়ানোর পাশাপাশি বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ ও পানিবাহিত রোগের চিকিৎসার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে।
গাইবান্ধায় বিশুদ্ধ পানির সংকট :গাইবান্ধা প্রতিনিধি জানান, জেলার সব নদ-নদীর পানি কমতে শুরু করেছে। এতে জেলার সদর, সুন্দরগঞ্জ, ফুলছড়ি ও সাঘাটাসহ চার উপজেলার সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। তবে বানভাসিদের দেখা দিয়েছে বিশুদ্ধ পানি ও খাবারের সংকট।
গাইবান্ধার ফুলছড়ি উপজেলার গজারিয়া ইউনিয়নের কাতলামারী গ্রামের সবুজ মিয়া জানান, বন্যা শেষ হয়ে গেলে আমরা বেঁচে যাই। প্রতি বছর বন্যায় এত কষ্ট আর ভালো লাগে না।
গাইবান্ধা সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আমিনুর জামান রিংকু বলেন, পানি কমে বন্যা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হচ্ছে। তবে চরাঞ্চলের কিছু বাড়িঘরে পানি রয়েছে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে শুকনো খাবার ও চাল রবাদ্দ দেওয়া হয়েছে।
রংপুরে কমছে তিস্তার পানি
রংপুর প্রতিনিধি জানান, তিস্তা নদীর পানি কমতে শুরু করেছে। নদীর তীরবর্তী নিম্নাঞ্চল, চর ও দ্বীপচরের পস্নাবিত এলাকা থেকে পানি সরে গেছে।
পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী রবিউল ইসলাম সংবাদমাধ্যমকে বলেন, নদী ভাঙন দেখা দিলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।
জগন্নাথপুরে বেরিয়ে আসছে সড়কের ক্ষত
বন্যার পানিতে নিমজ্জিত হওয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুরের বিভিন্ন সড়ক। বন্যার পানি কমতে থাকায় ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসছে সড়কের ক্ষত, খানাখন্দ। এছাড়া সিরাজগঞ্জে বন্যার কারণে বন্ধ হওয়া স্কুলগুলো খুলতে শুরু করেছে। ছড়িয়ে পড়ছে সর্দি-কাশিসহ রোগবালাই।
সরেজমিনে দেখা যায়, সুনামগঞ্জ-ঢাকা মহাসড়কে ইছগাঁও গ্রামের পাশে কাটাখাল সেতুর পাশের সড়কে বড় বড় গর্ত সৃষ্টি হয়েছে। প্রত্যেক দিন এখানে বড় মালবাহী ট্রাক আটকা পড়ে যানজটের সৃষ্টি হচ্ছে। এসব গর্তের কারণে ছোট-বড় দুর্ঘটনার কথা জানান স্থানীয়রা।
এদিকে জগন্নাথপুর উপজেলার পাইলগাঁও ইউনিয়নের গোতগাঁও ব্রিজের একাংশের এপ্রোস ধসে গিয়ে বিপজ্জনক গর্ত সৃষ্টি হয়েছে। ঝুঁকি নিয়েই ভারী যানবাহন চলাচল করছে। এতে যেকোনো সময় বড় ধরনের দুর্ঘটনার আশঙ্কা করছেন সাধারণ মানুষ। ক্রমান্বয়ে দেবে যাচ্ছে ওই ব্রিজের এপ্রোস।
গোতগাঁও গ্রামের বাসিন্দা আলাল মিয়া বলেন, হঠাৎ করে ব্রিজের এপ্রোস দেবে যাচ্ছে, গত তিন দিন ধরে ব্রিজটির একাংশের এই অবস্থা, দুর্ঘটনা এড়াতে গর্তে সিগন্যাল দিয়ে রেখেছি।
সওজ সড়ক বিভাগ সুনামগঞ্জ নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আশরাফুল ইসলাম প্রাং সংবাদমাধ্যমকে বলেন, এখানে আমাদের লোক কাজে যাচ্ছে। প্রত্যেক দিন তো বৃষ্টি হচ্ছে, এজন্য কাজ করা যাচ্ছে না। আমরা গর্তগুলো ভরাট করে দিচ্ছি। আমাদের এই কাজ চলমান থাকবে।
সিরাজগঞ্জে ছড়িয়ে পড়েছে রোগবালাই
সিরাজগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, কয়েক দিনে যমুনার পানি কমলে নতুন করে দেখা দিয়েছে নদীভাঙন। এখনো বন্যাকবলিত এলাকা সিরাজগঞ্জ, কাজিপুর, বেলকুচি, চৌহালী, শাহজাদপুর, এনায়েতপুরের বিভিন্ন এলাকায় নদীভাঙন অব্যাহত রয়েছে। নদীর পানি কমতে থাকায় বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে। এই সময় ছড়িয়ে পড়েছে রোগবালাই।
সদর উপজেলা পাইকপাড়া ও চর মালশাপাড়া মহলস্নার আফজাল, রাম চন্দ্র কুন্ড, সুফিয়া বেগম ও হাসনা হেনা জানান, বাড়ি থেকে পানি নামতে শুরু করলেও এখনো কাদা পানির মধ্যে ছেলে-মেয়ে নিয়ে বসবাস করতে হয়। পরিবারের অনেকের পেটের পীড়া, পায়ে ঘা, সর্দি এবং জ্বরের প্রকোপ দেখা দিয়েছে। তা ছাড়া রান্নাবান্নাসহ গবাদিপশু নিয়ে তাদের দুর্ভোগ কমেনি।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক বাবুল কুমার সুত্রধর সংবাদমাধ্যমকে জানান, জেলার ৬,৫২৫ হেক্টর জমির আউশ ধান, বীজতলা, পাট, তিল, কলা ও মরিচ, বিভিন্ন সবজি ক্ষেতে পানি ওঠায় অনেক ফসল নষ্ট হয়ে গেছে। যার পরিপ্রেক্ষিতে জেলার বিভিন্ন বাজারে সরবরাহ কমে গেছে।
বন্যাকবলিত ১১৯টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্যাকবলিত থাকায় এর মধ্যে ৯৭টি প্রাইমারি স্কুলে পাঠদান বন্ধ ছিল। এদিকে বন্যার পানি কমার কারণে এর মধ্যে ৪৯টি প্রাইমারি স্কুল খুলে দেওয়া হয়েছে। ওইসব স্কুলের পাঠদান কার্যক্রম শুরু হয়েছে বলে জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা হারুন অর রশিদ জানান।
জামালপুরে সীমাহীন দুর্ভোগ
নদ-নদীর পানি কমতে শুরু করায় জামালপুরে বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। তবে যমুনা নদীর পানি এখনো বিপৎসীমার ৭ সেন্টিমিটার ওপর দিয়েই প্রবাহিত হচ্ছে।
এদিকে পানি কমতে শুরু করায় ভেসে উঠতে শুরু করেছে দুর্গত এলাকার ঘরবাড়ি ও রাস্তাঘাটের ক্ষত চিহ্ন। ভাঙাচুরা ও বেহাল অবস্থার কারণে অনেকেই নিজ বাড়িঘরে ফিরতে পারছেন না। যারা ফিরেছেন তারাও রয়েছেন সীমাহীন দুর্ভোগে।
বন্যায় পস্নাবিত হয়েছে জেলার ৪২টি ইউনিয়নের বিস্তীর্ণ জনপদ। ভেফু গেছে গ্রামীণ জনপদের অনেক কাঁচা-পাকা রাস্তা ও ব্রিজ-কালভার্ট। পানিতে ভেসে গেছে ৫ শতাধিক পুকুরের মাছ, তলিয়ে গেছে ১২ হাজার হেক্টর জমির ফসল। এখনো পাঠদান বন্ধ আছে ১৫৭টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড বলছে, যমুনা নদীর পানি কমেছে। এতে জেলার সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির আরও উন্নতি হবে।