এবার মধ্যাঞ্চলে বন্যার শঙ্কা!

পদ্মার পানি বেড়ে নিম্নাঞ্চল পস্নাবিত বগুড়া ও সিরাজগঞ্জে লাখো মানুষ পানিবন্দি আগামী শুক্রবার থেকে ভারী বৃষ্টির আভাস

প্রকাশ | ১৪ জুলাই ২০২৪, ০০:০০

যাযাদি ডেস্ক
কুড়িগ্রামে বন্যাদুর্গত এক পরিবারের ভোগান্তি -সংগৃহীত
দেশের উত্তর ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলে কয়েক দফা বন্যার পর এবার মধ্যাঞ্চলেও বন্যার শঙ্কা দেখা দিয়েছে। গত কয়েক দিনের বর্ষণ ও উজানের ঢলে পদ্মা নদীর পানি বিপৎসীমা অতিক্রম করেছে। ভারী বর্ষণে কুড়িগ্রামে ব্রহ্মপুত্র নদের পানি ৩টি পয়েন্টে বিপৎসীমার ওপরে প্রবাহিত হলেও অপরিবর্তিত রয়েছে বন্যাপরিস্থিতি। বগুড়া ও সিরাজগঞ্জে যমুনার পানি কিছুটা কমেছে। তবে জেলাগুলোর কয়েক লাখ মানুষ এখনো পানিবন্দি। বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের (পাউবো) তথ্যানুযায়ী, বৃষ্টিপাতের কারণে ফের বেড়েছে উত্তর ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলের নদ-নদীর পানি। গত শুক্রবার দেশের মোট আটটি আবহাওয়া স্টেশনে ভারী এবং আটটি স্টেশনে অতিভারী বৃষ্টিপাত রেকর্ড হয়েছে। এছাড়া প্রবল বর্ষণ হয়েছে ভারতের কলকাতাসহ হাওড়া, হুগলি, উত্তর ২৪ পরগনা, দক্ষিণ ২৪ পরগনা, পূর্ব মেদিনীপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর, ঝাড়গ্রাম, পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, পূর্ব বর্ধমান, পশ্চিম বর্ধমান, বীরভূম, মুর্শিদাবাদ এবং নদিয়া জেলায়। এতে উজান থেকে নেমে আসা পানিতে মধ্যাঞ্চলেও বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে ধারণা করছেন সংশ্লিষ্টরা। এদিকে, দেশজুড়ে বৃষ্টির প্রবণতা কমার মধ্যেই আগামী শুক্রবার থেকে ফের বৃষ্টি বাড়ার আভাস দিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। শনিবার অধিদপ্তরের এক ব্রিফিংয়ে আবহাওয়াবিদ আবুল কালাম মলিস্নক বলেন, 'আজকে থেকে ১৮ জুলাই পর্যন্ত বৃষ্টিপাতের তীব্রতা কমে যাবে; এ সময় গরমের অস্বস্তিবোধ থাকবে। ১৯ তারিখ থেকে আবার একটি নতুন স্কেল শুরু হয়ে বৃষ্টিপাতের তীব্রতা আস্তে আস্তে করে বাড়তে পারে। মাসজুড়েই বৃষ্টি থাকবে। তবে আগামী ১০ দিন সিলেট এবং আশপাশের এলাকায় প্রতিদিনই থেমে থেমে বৃষ্টি হবে।' গত শুক্রবার প্রবল বর্ষণের পর গত দুই দিন ধরে পদ্মা ফুলেফেঁপে ওঠায় ফরিদপুর জেলার চারটি উপজেলার ৯টি ইউনিয়নের নিম্নাঞ্চলে পানি প্রবেশ করেছে। এ ছাড়া পস্নাবিত হয়েছে রাজবাড়ীর গোয়ালন্দ উপজেলার নিম্নাঞ্চল। এসব এলাকায় তলিয়ে গেছে ফসলি ক্ষেত। চরাঞ্চল ও নদী তীরবর্তী এলাকার বাসিন্দাদের যাতায়াতে বেড়েছে দুর্ভোগ। পাট, বাদাম, তিল ও ধান ক্ষেত তলিয়ে যাওয়ায় ক্ষতির মুখে পড়ছেন চাষিরা। ফরিদপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নির্বাহী প্রকৌশলী পার্থ প্রতিম সাহা জানান, গত ২৪ ঘণ্টায় পদ্মার পানি ৭ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়ে ফরিদপুর ও রাজবাড়ীর গোয়ালন্দ পয়েন্টে বিপৎসীমার ৭ দশমিক ৯৭ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ফরিদপুর সদর উপজেলার চর মাধবদিয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান তুহিন মন্ডল বলেন, 'পদ্মায় পানি বেড়ে যাওয়ায় তার ইউনিয়নের অধিকাংশ এলাকায় ফসলের ক্ষেত তলিয়ে গেছে। ক্ষেত ডুবে যাওয়ার ভয়ে অনেক চাষি পাট কেটে জাক দেওয়ার চেষ্টা করছেন। বাদাম ও তিল ক্ষেত পুরোপুরি তলিয়ে গেছে।' পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী পার্থ প্রতিম সাহা জানান, উজান থেকে নেমে আসা ঢল এবং যমুনার পানি থেকেই মূলত এ অঞ্চলে পানি বাড়তে শুরু করেছে। আরও বেশ কয়েকদিন পানি বৃদ্ধির সম্ভাবনা রয়েছে; তবে এতে বড় কোনো ক্ষতি না হলেও নদী তীরবর্তী অঞ্চল এবং চরাঞ্চলের মানুষের দুর্ভোগ বাড়বে বলে জানান তিনি। ভারী বর্ষণে কুড়িগ্রামে ব্রহ্মপুত্র নদের পানি ফের ৩টি পয়েন্টে বিপৎসীমার ওপরে প্রবাহিত হচ্ছে। তবে সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে। বসতবাড়ি ও রাস্তাঘাট পানিতে তলিয়ে থাকায় ঘরে ফিরতে পারছেন না বন্যার্তরা। বন্যাকবলিত এলাকায় যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম এখন নৌকা ও ভেলা। এ অবস্থায় চরম দুর্ভোগে পড়েছেন বানভাসি মানুষ। দুই সপ্তাহ ধরে নিম্নাঞ্চলের ৫৫ ইউনিয়নের ৪ শতাধিক গ্রামের প্রায় ২ লাখ মানুষ পানিবন্দি। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে বন্যা দুর্গতদের জন্য ত্রাণ তৎপরতা অব্যাহত থাকলেও যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকায় অনেক এলাকায় পৌঁছেনি ত্রাণ। অন্যদিকে, বগুড়ায় কমতে শুরু করেছে যমুনা নদীর পানি। গত ২৪ ঘণ্টায় ১৪ সেন্টিমিটার পানি কমে এখন বিপৎসীমার ২৮ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। সারিয়াকান্দি, সোনাতলা উপজেলার ১৭ ইউনিয়নের চরাঞ্চল ও নিচু গ্রামগুলো পস্নাবিত হয়ে প্রায় ৮০ হাজার মানুষ এখন পানিবন্দি। পানিতে ডুবেছে তিন উপজেলার প্রায় দেড় হাজার হেক্টর জমির পাট, রোপা-আমনের বীজতলা, সবজি ক্ষেত। এদিকে, পানি কমলেও দুর্ভোগ কমেনি সিরাজগঞ্জে যমুনা নদী তীরবর্তী বন্যার্ত মানুষের। জেলায় এখনো লক্ষাধিক মানুষ বন্যাকবলিত। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের তথ্য মতে, শুক্রবার অতিভারী বৃষ্টিপাত হওয়া এলাকাগুলোর মাঝে আছে টাঙ্গাইল, রাজশাহী, সিরাজগঞ্জের বাঘাবাড়ী, কক্সবাজার, সন্দ্বীপ, কুতুবদিয়া এবং কুষ্টিয়া (কুমারখালী)। আবহাওয়াবিদ আবুল কালাম মলিস্নক বলেন, 'শুক্রবারের আগের তিন দিন বন্যা পরিস্থিতি মোটামুটি উন্নতি হয়েছিল। শুক্রবার থেকে পানি আবার অল্প পরিমাণে বেড়েছে। বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কমে গেলে পানি আবারও স্বাভাবিক অবস্থায় চলে আসবে। গত ২৪ ঘণ্টায় সিলেটের কানাইঘাটে সর্বোচ্চ ৪০ সেন্টিমিটার ও চিলমারী পয়েন্টে ১২ সেন্টিমিটার পর্যন্ত পানি বেড়েছে। আজকে যেহেতু বৃষ্টি হচ্ছে, আগামী ২৪ ঘণ্টায় পানি বাড়বে সামান্য।' পানি কমছে জামালপুরে শনিবার থেকে জামালপুরে যমুনাসহ অন্য নদ-নদীর পানি কমতে শুরু করায় সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে। তবে এখনো পানিবন্দি রয়েছেন বহু মানুষ। জামালপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম জানান, শনিবার সকাল ১০টায় দেওয়ানগঞ্জের বাহাদুরাবাদ ঘাট পয়েন্টে যমুনা নদীর পানি গত ২৪ ঘণ্টায় ২০ সেন্টিমিটার হ্রাস পেয়ে বিপৎসীমার ৩৫ সেন্টিমিটার এবং সরিষাবাড়ীর জগন্নাথগঞ্জ ঘাট পয়েন্টে ১২ সেন্টিমিটার হ্রাস পেয়ে বিপৎসীমার ৮২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পানি কমায় অনেকেই আশ্রয়কেন্দ্র ছেড়ে বাড়িঘরে ফিরতে শুরু করেছেন। দেওয়ানগঞ্জ, বকশীগঞ্জ, ইসলামপুর, মেলান্দহ, মাদারগঞ্জ ও সরিষাবাড়ী উপজেলার ৪০টি ইউনিয়নের আনুমানিক দুই লাখ মানুষ এখনো পানিবন্দি অবস্থায় রয়েছেন। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক জাকিয়া সুলতানা জানান, বন্যার কারণে তলিয়ে গেছে আট হাজার হেক্টর ফসলি জমি। এসব ফসলের মধ্যে রয়েছে আউশ ক্ষেত, রোপা আমন বীজতলা, কলা, পাট, মরিচ, ভুট্টা, তিল ও নানা ধরনের শাকসবজি। জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা আলমগীর হোসেন বলেন, 'বন্যা দুর্গতদের জন্য ১৫টি আশ্রয়কেন্দ্রে কয়েক হাজার পরিবার আশ্রয় নিয়েছে। বিভিন্ন স্থানীয় ও আঞ্চলিক সড়ক ডুবে যাওয়ায় যাতায়াতে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। দুর্গত এলাকায় খাবার, সুপেয় পানি, শিশুখাদ্য ও গো-খাদ্যের তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। দুর্গতদের জন্য ৫৪০ টন চাল, ৭ লাখ টাকা এবং ৪ হাজার ৫০ প্যাকেট শুকনো খাবার বিতরণ করা হয়েছে।' সিরাজগঞ্জে এখনো পানিবন্দি মানুষ যমুনা নদীর পানি সিরাজগঞ্জ ও কাজিপুর মেঘাইঘাট পয়েন্টে কমতে শুরু করেছে। এতে জেলার বন্যার পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে। তবে দীর্ঘ সময় পানিবন্দি থাকা এলাকাগুলোতে দেখা দিচ্ছে পানিবাহিত নানা রোগ। পানি কমলেও জেলার পাঁচ উপজেলার ৩৪টি ইউনিয়নের প্রায় এক লাখ মানুষ পানিবন্দি রয়েছেন। চলতি বন্যায় সিরাজগঞ্জ সদর, শাহজাদপুর ও চৌহালীতে এ পর্যন্ত আটজনের মৃতু্য হয়েছে। স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, গত ৭ জুলাই থেকে সিরাজগঞ্জে বন্যার পানি কমতে শুরু করলে অন্যত্র আশ্রয় নেওয়া বন্যাকবলিত মানুষ ঘরে ফিরতে শুরু করেছিল। কিন্তু গত ১০ জুলাই আবারও যমুনা নদীর পানি বাড়ায় বিপাকে পড়েন তারা। তবে, দুদিন যমুনা নদীর পানি বৃদ্ধির পরে আবারও কমতে শুরু করেছে পানি। একই সঙ্গে কমছে অভ্যন্তরীণ হুরা সাগর, কাটাখালী, ফুলজোড়, ইছামতী নদীর পানি। শনিবার সকালে সিরাজগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী রঞ্জিত কুমার সরকার বলেন, 'গত ১২ ঘণ্টায় সিরাজগঞ্জে যমুনা নদীর শহররক্ষা বাঁধ হার্ড পয়েন্টে ১০ সেন্টিমিটার পানি কমে বিপৎসীমার ৩৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। অপরদিকে, কাজিপুর মেঘাইঘাট পয়েন্টে ১২ সেন্টিমিটার কমে বিপৎসীমার ১০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।' সিরাজগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবোর) নির্বাহী প্রকৌশলী মাহবুবুর রহমান জানান, যমুনা নদীর পানি কমতে শুরু করেছে। তবে উজানে ভারী বর্ষণ হচ্ছে। সেই পানি বাড়লে যমুনায় বাড়বে। চলতি বন্যায় জেলার ভাঙনকবলিত এলাকায় ভাঙন রোধে বালির বস্তা ফেলা হচ্ছে। তবে চলতি বন্যায় বড় ধরনের বন্যার আশঙ্কা নেই। তিনি আরও জানান, যমুনাসহ অভ্যন্তরীণ নদ-নদীর তীরবর্তী ও চরাঞ্চলের প্রায় এক লাখ মানুষ পানিবন্দি অবস্থায় রয়েছেন। যমুনার পানির নিচে তলিয়ে রয়েছে প্রায় ১০ হাজার হেক্টর জমির ফসল। সিরাজগঞ্জ ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা আকতারুজ্জামান জানান, বন্যাকবলিত মানুষের জন্য ১৩৩ টন চাল, ৫ লাখ টাকা, ৩০০ প্যাকেট শুকনো খাবার বিতরণ করা হয়েছে। চলতি বন্যায় নৌকা ডুবে চারজন এবং পানিতে ডুবে চারজনের মৃতু্য হয়েছে।