বন্যা পরিস্থিতি
উত্তরে ভারী বৃষ্টিতে দুদিন পানি বাড়ার আভাস
প্রকাশ | ১০ জুলাই ২০২৪, ০০:০০
যাযাদি ডেস্ক
নদ-নদীর পানি কমে দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতি উন্নতির দিকে গেলেও আগামী দুই দিন ভারী বৃষ্টিপাতের আভাস রয়েছে উত্তরের জেলাগুলোয়। ফলে এসব এলাকায় বন্যা পরিস্থিতি সামান্য অবনতি হতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
আবহাওয়া সংস্থাগুলোর বরাতে মঙ্গলবার পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র জানিয়েছে, দেশের উত্তরাঞ্চল ও তৎসংলগ্ন উজানে আগামী ৪৮ থেকে ৭২ ঘণ্টায় ভারী বৃষ্টিপাতের পূর্বাভাস রয়েছে। এ সময় তিস্তা, ধরলা ও দুধকুমার এই তিন নদীর পানি বাড়ার পাশাপাশি যমুনা নদীর পানিও তখন ধীরগতিতে কমবে বলে জানিয়েছেন বন্যা পূর্বাভাস কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী সরদার উদয় রায়হান।
তিনি বলেন, 'উন্নতির দিকে যাচ্ছে, তবে দুইদিন উত্তরাঞ্চলে কিছুটা অবনতি হতে পারে, ব্যাপক অবনতি হবে না। বৃষ্টিপাতের স্কেলটা চলে গেলে আবার উন্নতি হবে।'
বন্যা পূর্বাভাসের বুলেটিন অনুযায়ী মঙ্গলবার বিকাল ৩টায় দেশের আটটি নদীর ১৮টি পয়েন্টে পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে বইছিল। এ সময় ব্রহ্মপুত্র অববাহিকার দুধকুমার নদীর পানি পতেশ্বরী পয়েন্টে ৭ সেন্টিমিটার কমে বিপৎসীমার ১ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল।
ব্রহ্মপুত্র নদের নুনখাওয়া পয়েন্টে পানি ৪ সেন্টিমিটার কমে বিপৎসীমার ২৪ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে, হাতিয়া পয়েন্টে ৪ সেন্টিমিটার কমে বিপৎসীমার ২৬ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে, চিলমারী পয়েন্টে ৫ সেন্টিমিটার কমে বিপৎসীমার ৩৮ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে বইছিল।
যমুনা নদীর ফুলছড়ি পয়েন্টে পানি ২ সেন্টিমিটার কমে বিপৎসীমার ৪৬ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে, বাহাদুরাবাদ পয়েন্টে ৩ সেন্টিমিটার কমে বিপৎসীমার ৫৬ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে, সাঘাটা পয়েন্টে ৮ সেন্টিমিটার কমে বিপৎসীমার ৪৮ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে, সারিয়াকান্দি পয়েন্টে ২ সেন্টিমিটার কমে বিপৎসীমার ৩৯ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে, কাজিপুর পয়েন্টে ৭ সেন্টিমিটার কমে বিপৎসীমার ২৬ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে, জগন্নাথগঞ্জ পয়েন্টে ৪ সেন্টিমিটার কমে বিপৎসীমার ৯৭ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে, সিরাজগঞ্জ পয়েন্টে ৩ সেন্টিমিটার কমে বিপৎসীমার ৪৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে এবং পোড়াবাড়ী পয়েন্টে ২ সেন্টিমিটার কমে বিপৎসীমার ১৮ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে বইছিল।
আত্রাই নদীর বাঘাবাড়ী পয়েন্টে ১ সেন্টিমিটার বেড়ে বিপৎসীমার ১২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে বইছিল।
অপরদিকে মেঘনা অববাহিকার সুরমা নদীর কানাইঘাট পয়েন্টে পানি ১ সেন্টিমিটার কমে বিপৎসীমার ২৮ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে বইছিল।
কুশিয়ারার অমলশীদ পয়েন্টে ১ সেন্টিমিটার কমে বিপৎসীমার ৪৪ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে, মারকুলি পয়েন্টে ৪ সেন্টিমিটার কমে বইছিল বিপৎসীমার ২১ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে।
সোমেশ্বরী নদীর কলমাকান্দা পয়েন্টে ২ সেন্টিমিটার কমে বিপৎসীমার ১৩ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে বইছিল। মেঘনা নদীর মেঘনা সেতু পয়েন্টে ৫ সেন্টিমিটার কমে বিপৎসীমার ১৬ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল।
বন্যা পূর্বাভাস কেন্দ্র জানিয়েছে, আগামী ২৪ ঘণ্টায় কুড়িগ্রাম, জামালপুর, গাইবান্ধা, বগুড়া, টাঙ্গাইল ও সিরাজগঞ্জ জেলার ব্রহ্মপুত্র-যমুনা নদীসংলগ্ন নিম্নাঞ্চলের বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হতে পারে।
এ সময় উত্তরাঞ্চলের তিস্তা, ধরলা ও দুধকুমার নদীর পানি স্থিতিশীল থাকতে পারে। তাতে ধরলা ও দুধকুমার নদীর পানি কিছু পয়েন্টে বিপৎসীমার কাছাকাছি প্রবাহিত হতে পারে। তবে পরবর্তী ৪৮ হতে ৭২ ঘণ্টায় তিস্তা, ধরলা ও দুধকুমার নদীর পানি সময় বিশেষে দ্রম্নত বাড়তে পারে। আগামী ৪৮ ঘণ্টায় উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বিভিন্ন নিম্নাঞ্চলের সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হতে পারে।
গঙ্গা নদীর পানি সমতল বাড়ছে, অন্যদিকে পদ্মা নদীর পানি স্থিতিশীল রয়েছে। পরবর্তী ৭২ ঘণ্টায় দুই নদীর পানি বাড়তে পারে। ব্রহ্মপুত্র-যমুনা নদীর পানি সমতল কমছে, এ পরিস্থিতি আগামী ২৪ ঘণ্টা পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পারে। দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের প্রধান নদীর পানিও সার্বিকভাবে কমছে এবং পরবর্তী ৪৮ ঘণ্টা এ অবস্থা চলতে পারে। উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের আত্রাই নদীর পানি বাঘাবাড়ী পয়েন্টে কমে সিরাজগঞ্জ জেলার নিম্নাঞ্চলের বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হতে পারে।
এবার জুনের শুরুতে প্রবল বর্ষণ আর উজানের ঢলে সিলেটে বন্যা পরিস্থিতি তৈরি হয়। কয়েক দিন পর পরিস্থিতির উন্নতি হলেও গত ১৭ জুন কোরবানির ঈদের আগের দুদিন থেকে টানা বৃষ্টিতে সিলেট, সুনামগঞ্জ ও নেত্রকোনাসহ আশপাশের জেলার অনেক এলাকা ডুবে যায়। উজানের ঢলে জুলাইয়ের শুরুতে নতুন করে বন্যা দেখা দেয় বিভিন্ন জেলায়।
মঙ্গলবার সকাল ৬টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ১৪৮ মিলিমিটার বৃষ্টি ঝরেছে পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া। নীলফামারীর ডিমলায় ১২৮, ময়মনসিংহ ৩৪, সিলেটে ২৮, নেত্রকোনা ২৩ মিলিমিটারসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় কম-বেশি বৃষ্টি হয়েছে।
জামালপুরে ভোগান্তি বাড়ছে
জামালপুরের সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে। কমতে শুরু করেছে নদ-নদীর পানি। নতুন করে কিছু এলাকা পস্নাবিত হয়েছে। এখনও বিপৎসীমার ওপর রয়েছে যমুনার পানি। খাবার ও সুপেয় পানির সংকটে ভুগছেন বন্যার্তরা।
জামালপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নির্বাহী প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম জানান, মঙ্গলবার সকাল ১০টায় দেওয়ানগঞ্জের বাহাদুরাবাদ ঘাট পয়েন্টে যমুনা নদীর পানি গত ২৪ ঘণ্টায় ১৭ সেন্টিমিটার কমে বিপৎসীমার ৬১ সেন্টিমিটার ও সরিষাবাড়ীর জগন্নাথগঞ্জ ঘাট পয়েন্টে ১১ সেন্টিমিটার কমে বিপৎসীমার ১০৩ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
তবে পানি কিছুটা কমলেও দুর্গতদের দুর্ভোগ এখনও কমেনি। বিস্তীর্ণ এলাকায় বন্যার পানি ছড়িয়ে পড়ায় অনেক এলাকা নতুন করে পস্নাবিত হচ্ছে। দেওয়ানগঞ্জ, বকশীগঞ্জ, ইসলামপুর, মেলান্দহ, মাদারগঞ্জ ও সরিষাবাড়ী উপজেলার ৫০টি ইউনিয়নের প্রায় তিন লাখ মানুষ এখনও পানিবন্দি অবস্থায় রয়েছেন।
জেলার ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা আলমগীর হোসেন বলেন, '১৫টি আশ্রয়কেন্দ্রে জেলার কয়েক হাজার পরিবার আশ্রয় নিয়েছে। বিভিন্ন স্থানীয় ও আঞ্চলিক সড়ক ডুবে যাওয়ায় যাতায়াতে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। দুর্গত এলাকায় খাবার ও সুপেয় পানির তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। দুর্গতদের জন্য ১ হাজার ১০০ মেট্রিক টন চাল, ২২ লাখ টাকা ও সাড়ে ৪ হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।'
গাইবান্ধায় বিপৎসীমার ওপর ব্রহ্মপুত্রের পানি
গাইবান্ধা প্রতিনিধি জানান, গাইবান্ধায় করতোয়া বাদে সব নদ-নদীর পানি কমেছে। পাউবোর নিয়ন্ত্রণকক্ষের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, মঙ্গলবার বেলা ৩টা পর্যন্ত সময়ের আগের ২৪ ঘণ্টায় ব্রহ্মপুত্র নদের পানি ফুলছড়ি উপজেলার তিস্তামুখঘাট পয়েন্টে ১৩ সেন্টিমিটার, ঘাঘট নদের পানি জেলা শহরের নতুন ব্রিজ পয়েন্টে ১৫ সেন্টিমিটার ও তিস্তার পানি সুন্দরগঞ্জ উপজেলাসংলগ্ন কাউনিয়া পয়েন্টে ২৭ সেন্টিমিটার কমেছে। একই সময় করতোয়ার পানি গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার চকরহিমাপুর পয়েন্টে ১৭ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়েছে।
এ সময় ব্রহ্মপুত্রের পানি বিপৎসীমার ৪৭ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে বইছিল। একই সময় ঘাঘটের পানি বিপৎসীমার ২ সেন্টিমিটার, করতোয়ার পানি ১০৬ সেন্টিমিটার ও তিস্তার পানি বিপৎসীমার ৪১ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। গত ২৪ ঘণ্টায় জেলাটিতে তেমন বৃষ্টি হয়নি।
গাইবান্ধা পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নির্বাহী প্রকৌশলী হাফিজুল হক বলেন, 'নদ-নদীর পানি কমতে শুরু করেছে। তবে চরাঞ্চল থেকে পানি নামতে সময় লাগবে।'
সুনামগঞ্জে মানববন্ধন
সুনামগঞ্জে বন্যা পরিস্থিতি মোকাবিলায় পরিকল্পিত উদ্যোগ নেওয়ার দাবিতে মানববন্ধন করেছে সামাজিক সংগঠন 'জনউদ্যোগ'। মঙ্গলবার দুপুরে পৌর শহরের আলফাত স্কয়ারে এ মানববন্ধনের আয়োজন করে সংগঠনটি। এতে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার লোকজন অংশ নেন।
হাওড়ের কৃষি ও কৃষক রক্ষা আন্দোলনের সদস্য সচিব অধ্যাপক চিত্তরঞ্জন তালুকদার বলেন, 'সুনামগঞ্জে অন্তত ২০টি খাল ভরাট হয়ে গেছে। এসব খাল হয়ে সুরমা নদীর পানি হাওড়ে যেত। এখন এসব খাল দিয়ে আর পানি যেতে পারে না। এজন্য বৃষ্টি হলেই শহর ও নদীতীরবর্তী এলাকাগুলো প্রথমেই পস্নাবিত হয়ে যায়। এ সংকট থেকে পরিত্রাণের জন্য খালগুলো খনন করে পানির অবাধ প্রবাহ নিশ্চিত করতে হবে।'
মানববন্ধনে আরও বক্তব্য রাখেন সমাজকর্মী সুখেন্দু সেন, জেলা উদীচী শিল্পী গোষ্ঠীর সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলম, হাওড় বাঁচাও আন্দোলন সংগঠনের নেতা আনোয়ারুল হক, জেলা খেলাঘর আসরের সাধারণ সম্পাদক মো. রাজু আহমেদ, জনউদ্যোগের সদস্য সচিব সাইদুর রহমান, সদস্য ইখতেখার সাজ্জাদ প্রমুখ।