অস্ত্র মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে নগরীর চান্দগাঁও থানা হাজতে এক আসামি মৃতু্যর ঘটনায় নানা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে বিজ্ঞ ও সচেতন মহলে। তাদের প্রশ্ন- থানা হাজতে কিভাবে একজন আসামি আত্মহত্যা করেন? দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যরা কী করেন এবং কোথায় ছিলেন? থানায় বসানো সিসিটিভি ক্যামেরা আদৌ মনিটরিং ও হাজতে কোনো অঘটন ঘটার আশঙ্কা যাচাই করা হয় কিনা!
জানা যায়, পরোয়ানামূলে নগরীর চান্দগাঁও থানা পুলিশের হাতে গত মঙ্গলবার রাতে গ্রেপ্তার হন মো. জুয়েল। গ্রেপ্তারের ৬ ঘণ্টার মাথায় থানা হাজতেই তার মৃতু্যর ঘটনা ঘটে। ঘটনাটি তদন্তে তিন সদস্যের একটি কমিটি করেছে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ (সিএমপি)। ঘটনার পর থেকেই পুলিশ বলছে, এটি 'আত্মহত্যা। নিজের পরনের শার্ট শৌচাগারের ভেন্টিলেটরে পেঁচিয়ে গলায় ফাঁস নিয়েছেন তিনি।
এ প্রসঙ্গে মানবাধিকারকর্মী ও সামাজিক সংগঠক আমিনুল হক বাবু বলেন, 'একজন মানুষের জন্য সবচেয়ে আস্থার এবং নিরাপদ জায়গা থানা ও জেলখানা। একজন চিকিৎসাধীন রোগীকে যেমন সার্বক্ষণিক ডাক্তার এবং নার্সের পর্যবেক্ষণে রাখা হয়। তার চেয়ে বেশি নিবিড় পর্যবেক্ষণের জায়গা হচ্ছে থানা ও জেলখানা। থানা হাজতে আসামির মৃতু্যর ঘটনা চরম দায়িত্বহীনতার পরিচয়। থানা হাজতে যদি আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে সেটি আরও বড় ধরনের অবহেলা এবং প্রশ্ন ওঠার বিষয়। এ ঘটনার দায় চান্দগাঁও থানা কোনোভাবে এড়াতে পারে না।'
সুশাসনের জন্য নাগরিক চট্টগ্রাম জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট আখতার কবির চৌধুরী বলছেন, একজন আসামি
থানা হাজতে পা রাখলেই তার সম্পূর্ণ দায়-দায়িত্ব পুলিশেরই। আসামি যেভাবেই মারা যাক- দায়িত্ব পুলিশকেই নিতে হবে। থানা হাজতে মৃতু্য এক সেকেন্ডের ঘটনা নয়, দীর্ঘ সময়ের ঘটনা। ঘটনার দায় চান্দগাঁও থানাকেই নিতে হবে।'
তবে চান্দগাঁও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জাহিদুল কবিরের দাবি, ওই আসামির উদ্দেশ্যই ছিল আত্মহত্যা করা। তিনদিন আগে দুইবার বাসায় আত্মহত্যার চেষ্টাও করেছিলেন তিনি। আত্মহত্যার আগে আসামি কৌশলে দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যের সহযোগিতা নিয়ে ডিউটি অফিসারের মোবাইলে পরিবারের সঙ্গেও যোগাযোগ করেছেন। আত্মহত্যার চেষ্টার বিষয়টি পরিবারের লোকজন গ্রেপ্তারের সময় কিংবা পরে আমাদের জানায়নি। যদি জানাত তাহলে তাকে আরও নিবিড়ভাবে মনিটরিং করা হতো।
বুধবার সকালে চান্দগাঁও থানা হাজতের ভেন্টিলেটরের সঙ্গে 'গলায় ফাঁস নেওয়া' ২৬ বছর বয়সি মো. জুয়েলের মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। এর আগে মঙ্গলবার রাত ১২টার দিকে পাথরঘাটা ব্রিকফিল্ড এলাকা থেকে অস্ত্র মামলার পরোয়ানামূলে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। পুলিশের বক্তব্য অনুযায়ী তার বিরুদ্ধে অস্ত্র-ডাকাতি আইনে ছিল অন্তত ৭টি মামলা। জুয়েলের বিয়ে হয়েছে দেড় বছর। আছে ছয়মাস বয়সি এক সন্তানও।
জুয়েলের মা মিনারা বেগম বলেন, 'আমার ছেলে মঙ্গলবার রাতে লুডু খেলছিল। আমার ছেলেকে ওই সময় পুলিশ এসে ধরে নিয়ে যায়। আমি ছেলেকে বলেছিলাম সকালে তোকে ছাড়িয়ে আনব। কিন্তু সেই সময় আমাকে দিল না। আমার ছেলে হাসতে হাসতে পুলিশের সঙ্গে চলে গেছে, ফিরল লাশ হয়ে। পুলিশের কারণেই আমার ছেলের মৃতু্য।'
চান্দগাঁও থানা এলাকার সাধারণ মানুষের অভিমত, থানাহাজতে আসামির মৃতু্য দায়িত্বশীলদের চরম উদাসীনতার পরিচয়। অনেকে এ ঘটনাকে রহস্যময় মনে করছেন।
দুদক চট্টগ্রাম জেলা কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, ঘুষ ও দুর্নীতির মাধ্যমে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে ওসি জাহিদুল কবিরের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান ও তদন্ত চলছে।
এদিকে চান্দগাঁও থানাহাজতে আসামি মো. জুয়েলের মৃতু্যর ঘটনা তদন্তে তিন সদস্যের একটি কমিটি করেছে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ (সিএমপি)। উত্তর বিভাগের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার, সহকারী কমিশনার এবং অন্য একটি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে নিয়ে তিন সদস্যের বিভাগীয় তদন্ত কমিটিকে সাত দিনের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।
কমিটির সদস্যরা হলেন- সিএমপির উত্তর বিভাগের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (এডিসি) মো. জাহাঙ্গীর, পাঁচলাইশ জোনের সহকারী পুলিশ কমিশনার (এসি) মো. আরিফ হোসেন ও পাঁচলাইশ মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সন্তোষ কুমার চাকমা।
চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের (সিএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম) প্রকৌশলী আবদুল মান্নান মিয়া বলেন, 'এ ঘটনায় তিন সদস্যের বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। এ ছাড়া ঘটনার পরপরই আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। তদন্ত কমিটিকে ৭ দিনের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে। যদি আমাদের কোনো অফিসারের দায়িত্বে অবহেলা থাকে তদন্ত প্রতিবেদন অনুসারে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।'