বুড়িগঙ্গার তীর দখল করে প্রভাবশালীদের ২৭ ডকইয়ার্ড!

প্রকাশ | ০৭ জুলাই ২০২৪, ০০:০০

মাসুম পারভেজ, কেরানীগঞ্জ (ঢাকা)
কেরানীগঞ্জের শুভাঢ্যা ইউনিয়নের মীরেরবাগ এলাকায় বুড়িগঙ্গার তীর দখল করে অবৈধভাবে গড়ে ওঠা ডকইয়ার্ড -যাযাদি
রাজধানী ঢাকার বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে কেরানীগঞ্জের কালীগঞ্জ থেকে হাসনাবাদ পর্যন্ত সাড়ে তিন কিলোমিটার এলাকা জুড়ে লঞ্চ-স্টিমার তৈরি ও মেরামতের জন্য গড়ে উঠেছে ব্যক্তিমালিকানাধীন ২৭টি ডকইয়ার্ড। নদীর তীর দখল করে গড়ে উঠা এসব জাহাজ নির্মাণ কারখানা বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহণ কর্তৃপক্ষের (বিআইডবিস্নউটিএ) কাছ থেকে পরিবেশগত ছাড়পত্র নেয়নি। বিআইডবিস্নউটিএ কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, প্রভাবশালী সংসদ সদস্য, স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান ও প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তিরা ডকইয়ার্ডের মালিক হওয়ার কারণে এগুলো উচ্ছেদ করা যায়নি। তারা নানাভাবে প্রভাব বিস্তার করে অবৈধভাবে ডকইয়ার্ডগুলো টিকিয়ে রেখেছেন কয়েক দশক ধরে। জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন বলছে, নদীসংক্রান্ত আইন ও হাইকোর্টের রায় লঙ্ঘন করে এই স্থাপনা তৈরি করা হয়েছে। এখনই সব ধরনের নির্মাণকাজ বন্ধ করা দরকার। সম্প্রতি বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে গড়ে ওঠা ডকইয়ার্ডসহ সব ধরনের স্থাপনা অবিলম্বে অপসারণের দাবি জানিয়েছে নৌ, সড়ক ও রেলপথ রক্ষা জাতীয় কমিটি (ন্যাশনাল কমিটি টু প্রোটেক্ট শিপিং, রোডস অ্যান্ড রেলওয়েজ- এনসিপিএসআরআর)। সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, দক্ষিণ কেরানীগঞ্জে বুড়িগঙ্গা নদীর তীর ঘেঁষে পার গেন্ডারিয়া আপিস মাঠ এলাকা থেকে চর খেজুরবাগ হয়ে তেলঘাট ও হাসনাবাদ পর্যন্ত প্রায় সাড়ে তিন কিলোমিটার এলাকায় গড়ে উঠেছে জাহাজ নির্মাণশিল্প। এখানে কয়েক হাজার শ্রমিক কাজ করেন। নদীসীমার মধ্যে এতগুলো ডকইয়ার্ড গড়ে ওঠার কারণে বুড়িগঙ্গার প্রশস্ততা কমে গেছে। পোড়া তেলে নদীর পানি দূষিত হচ্ছে। এদের বিরুদ্ধে নদী দখলের প্রমাণ মিলেছে নদী রক্ষা কমিশনের যৌথ জরিপে। পরিবেশ দূষণের অভিযোগ আনছেন পরিবেশবাদীরা। জানা যায়, দুটি ডকইয়ার্ডের মালিক বরিশাল-৩ আসনের (জাতীয় পার্টি) সংসদ সদস্য গোলাম কিবরিয়া (টিপু) ও দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ পার গেন্ডারিয়া এলাকায় ডকইয়ার্ডের দুটির মালিক শুভাঢ্যা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক ইকবাল হোসেন। একটি ডকইয়ার্ড দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের প্রভাবশালী একজন সংসদ সদস্যের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে বলে জানা গেছে। বাকিগুলোর মালিকরা সরাসরি রাজনীতিতে যুক্ত নন। তবে তারাও স্থানীয় প্রভাবশালী বলে জানা যায়। এবিষয়ে সংসদ সদস্য গোলাম কিবরিয়া জানান, 'আমার ডকইয়ার্ড দুটি ব্যক্তিমালিকানাধীন জমিতে গড়ে উঠেছে। ওই এলাকার একজন জমি বন্ধক রেখে ঋণ নিয়েছিলেন। তিনি (সংসদ সদস্য) ডকইয়ার্ডের জমির মালিকের হয়ে ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ করে জমি ক্রয় করেন। অন্য ডকইয়ার্ডগুলোও ব্যক্তিমালিকানাধীন জমিতে গড়ে উঠেছে।' তিনি বলেন, উচ্চ আদালতের একটি নির্দেশনা আছে। এ কারণে বিভিন্ন সময়ে এগুলো উচ্ছেদ করতে এসেও নৌপরিবহণ কর্তৃপক্ষকে ফিরে যেতে হয়েছে।' এমন মন্তব্যের প্রতি উত্তরে বিআইডবিস্নউটিএর পরিচালক (অতিরিক্ত দায়িত্ব) একেএম আরিফ উদ্দিন বলেন, 'সদরঘাটের অন্যপ্রান্তের শুভাঢ্যা ইউনিয়নের পার গেন্ডারিয়া-তেলঘাট ও হাসনাবাদ এলাকাসহ ডকইয়ার্ডগুলো অবৈধভাবে গড়ে উঠেছে। এগুলোর মালিকানাসংক্রান্ত বিষয়ে উচ্চ আদালতের একটি নির্দেশনা ছিল। পরে সেটি বাতিল করা হয়েছে। বাস্তবে ডকইয়ার্ডগুলো নদীর সীমানা পিলারের (খুঁটি) ভেতরে নদীর অংশে পড়েছে। গত ২০১৯ সালে চর মীরেরবাগ অংশের ৯ ও ১০ নম্বর পিলার ঘেঁষে নদীর জমিতে গড়ে উঠা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একটি ভবন ভাঙ্গা হয়েছিল। তবে ওই বিদ্যালয় থেকে পূর্ব দিকে ১১ ও ১২ নম্বর পিলারের মাঝামাঝি কুমিলস্না ডকইয়ার্ড গড়ে উঠেছে। সীমানা পিলারের ভেতরের অংশ লোহার পাত দিয়ে দখল করা হয়েছে। স্কুলের পশ্চিম পাশেও একটি ডকইয়ার্ড রয়েছে।' এই অংশে স্থানীয় শুভাঢ্যা ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান ইকবাল হোসেন, 'তার ভাই সোহেল রেজা ও বাসের উদ্দিনের আলাদা ডকইয়ার্ড রয়েছে।' চেয়ারম্যান ইকবাল হোসেনের ভাই সোহেল রেজা বলেন, 'ডকইয়ার্ড পৈতৃক সম্পত্তিতে গড়ে উঠেছে। আগে এসব ডকইয়ার্ডের জন্য বিআইডবিস্নউটিএকে নিয়মিত ফি দেওয়া হতো। এখন বিআইডবিস্নউটিএ সেটা নিচ্ছে না।' তবে নৌপ্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলছেন, 'জাহাজ শিল্পকে বাঁচাতে হবে, তাই ডকইয়ার্ড সরিয়ে নেওয়ার বিষয়ে সব পক্ষের সঙ্গে আলোচনা চলছে। এদিকে, ভাসমানের পাশাপাশি দীর্ঘদিন ধরে পানির নিচে ফেলে রাখা ডকইয়ার্ডের বাতিল জাহাজ, অকেজো যন্ত্রাংশ, পোড়া তেল অবাধে মিশছে নদীর পানিতে। নিয়ম ভেঙে ভাসমান অবস্থায় করা হচ্ছে মেরামত। আর এতে, দূষিত হচ্ছে পরিবেশ, নদীর পানিতে মিশছে ভারী ধাতু ও ক্ষতিকর রাসায়নিক। এ বিষয়ে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক আবদুল মতিন বলেন, 'দখলের ফলে নদী সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে এখানে। ডকইয়ার্ডের কার্যকলাপের যতটুকু ডিস্পোজাল আছে, এগুলো সবকিছুই নদীর পাড় ও ভেতরে ডিজোল্বড করা হয়। দূষণ-দখল এখানে বড় ইসু্য। নদীর পাড়ে এই তুঘলকি কান্ড চললেও কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না পরিবেশ অধিদপ্তর। বিপরীতে তারা বলছে, সদরঘাট টার্মিনালের অন্যপাড়ে ৩৭টির অধিক ডকইয়ার্ডের মধ্যে ৩২টিরই নেই ছাড়পত্র।' এ বিষয়ে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, 'বুড়িগঙ্গা রক্ষায় সীমানা চিহ্নিত করতে উচ্চ আদালতের যে নির্দেশনা রয়েছে, সেটির উদ্দেশ্যই ছিল অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ করা। এখন সীমানা পিলারের ভেতরে কোনো স্থাপনা থাকলে সেটি কোনোভাবেই বৈধ হতে পারে না।'