দেশের বিভিন্ন এলাকায় নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। এতে উত্তরাঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হওয়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে। শুক্রবার যমুনা ও ব্রহ্মপুত্র নদের পানি বিভিন্ন স্থানে বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। তিস্তা, করতোয়া, ঘাঘট, বাঙ্গালীসহ অন্যান্য নদ-নদীর পানিও বাড়ছে হু হু করে। যে কোনো সময় এসব নদ-নদীর পানি বিপৎসীমা অতিক্রম করতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। নদী তীরবর্তী চরাঞ্চল ও নিম্নাঞ্চল পস্নাবিত হয়ে পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন লক্ষাধিক মানুষ। দফায় দফায় বন্যায় খাদ্য, সুপেয় পানিসহ নানা সংকটে ভুগছেন বানভাসি মানুষ। অনেক এলাকায় স্কুল-কলেজে পানি উঠে বন্ধ হয়ে গেছে শিক্ষা কার্যক্রম। এছাড়াও বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে আমন বীজতলা, পাট ও মৌসুমি ফসলের ক্ষেত। কাঁচা-পাকা সড়ক তলিয়ে যাওয়ায় বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে যোগাযোগ ব্যবস্থা। বন্যার মধ্যেই মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে বিভিন্ন এলাকায় শুরু হয়েছে তীব্র নদীভাঙন। এতে ভোগান্তিতে পড়েছেন এসব অঞ্চলের লোকজন।
এদিকে, সিলেটের কোথাও কোথাও বন্যা পরিস্থিতি স্থিতিশীল থাকলেও পানি বেড়েছে কয়েকটি স্থানে। বৃষ্টি কম হলেও ভারতের বরাক নদের শাখা কুশিয়ারার পানিপ্রবাহ বেড়েছে। জকিগঞ্জ উপজেলায় চারটি স্থানে কুশিয়ারা নদীর বাঁধ ভেঙে লোকালয়ে পানি প্রবেশ করেছে। শুক্রবার সকাল পর্যন্ত জেলার প্রধান দুই নদী সুরমা ও কুশিয়ারার সব পয়েন্টে পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল।
সিলেট পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সূত্রে জানা গেছে, সুরমা নদীর কানাইঘাট পয়েন্টে শুক্রবার সকাল ৬টায় পানি বিপৎসীমার ৬৯ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। তবে নদীটির সিলেট পয়েন্টে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় বিপৎসীমার ৮ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হলেও শুক্রবার সকালের তথ্য পাওয়া যায়নি। কুশিয়ারা নদীর অমলশিদ পয়েন্টে আজ সকাল ৬টায় পানি বিপৎসীমার ১৪৩ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। নদীর শেওলা পয়েন্টে পানি ছিল ৪০ সেন্টিমিটার ওপরে। ফেঞ্চুগঞ্জ পয়েন্টে ১০৩ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। অন্যদিকে নদীর শেরপুর পয়েন্টে পানি আজ সকাল ৬টায় ১১ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। তবে জেলার অন্য নদ-নদীর পানি গতকাল সন্ধ্যার তুলনায় আজ কিছুটা কমেছে।
জকিগঞ্জ পৌরসভার মেয়র আবদুল আহাদ বলেন, কুশিয়ারা নদীর কয়েকটি স্থানে বাঁধ ভেঙে লোকালয়ে হু হু করে পানি প্রবেশ করছে। বাঁধগুলো বাঁচানোর জন্য স্থানীয়রা চেষ্টা করলেও সফল হননি। বুধবার ভোরে নরসিংপুরের বাঁধ ভেঙে লোকালয়ে পানি প্রবেশ করতে শুরু করে। এর আগে স্থানীয় বাসিন্দাদের জকিগঞ্জ সরকারি কলেজে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।
এদিকে বিয়ানীবাজার উপজেলায় দেউলগ্রাম, গোবিন্দশ্রী, আঙ্গুরা মোহাম্মদপুর, আলীনগরসহ বিভিন্ন এলাকায় কুশিয়ারা নদীর পানি উপচে লোকালয়ে প্রবেশ করছে। দুই দিন ধরে বৃষ্টি কমলেও সিলেট নগরের অভ্যন্তরে জলাবদ্ধতা কাটেনি। শহরের অভ্যন্তরেও বেশ কয়েকটি এলাকা পানিতে তলিয়ে রয়েছে। এর মধ্যে শাহজালাল উপশহর, যতরপুর, মীরাবাজার, তালতলা, জামতলা, মির্জাজাঙ্গাল, মণিপুরি রাজবাড়ীসহ বিভিন্ন পাড়া-মহলস্নায় এখনো পানিবন্দি বাসিন্দারা।
ফেঞ্চুগঞ্জ বাজারের মুদিদোকানি পাভেল আহমদ বলেন, যে সড়কে যানবাহন চলত, এখন ১০ দিন ধরে সেই সড়কে নৌকা চলছে। নৌকায় মানুষজন বাজার করতে আসছে। বন্যা পরিস্থিতির কারণে বেচাকেনা কম হলেও প্রতিদিন পানির সঙ্গে অনেকটা যুদ্ধ করেই তিনি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান চালু রেখেছেন।
পাউবো সিলেটের নির্বাহী প্রকৌশলী দীপক রঞ্জন দাশ জানান, বাঁধ মেরামতের জন্য এরই মধ্যে প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। পানি না নামলে সেগুলো মেরামত করা সম্ভব নয়।
সিলেট জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, সিলেটের সব উপজেলা বন্যায় পস্নাবিত হয়েছে। পানিবন্দি মানুষের জন্য আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়েছে। জেলায় ৬৫০টি আশ্রয়কেন্দ্রের মধ্যে ২০৭টি আশ্রয়কেন্দ্রে লোকজন অবস্থান করছেন। আশ্রয়কেন্দ্র ছাড়াও জেলায় বন্যাকবলিত বাসিন্দাদের জন্য ত্রাণসহায়তা অব্যাহত আছে।
কুড়িগ্রামে ব্রহ্মপুত্র ও দুধকুমার নদের পানি বেড়ে নতুন নতুন এলাকা পস্নাবিত হয়েছে। জেলার পাঁচটি উপজেলার ১৪টি ইউনিয়নের দুই লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। এ কারণে তাঁরা দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন। তিনটি পয়েন্টে ব্রহ্মপুত্র নদের পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। বন্যায় পস্নাবিত ৩৭টি বিদ্যালয়ের পাঠদান কার্যক্রম সাময়িক বন্ধ আছে।
শুক্রবার সকাল নয়টায় কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) জানায়, ব্রহ্মপুত্র নদের পানি চিলমারী পয়েন্টে ৭৮ সেন্টিমিটার, নুনখাওয়া পয়েন্টে ৭২ সেন্টিমিটার ও হাতিয়া পয়েন্টে ৮০ সেন্টিমিটারের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। দুধকুমার নদ ও ধরলা নদীর পানি বাড়লেও বিপৎসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। কুড়িগ্রাম সদর পয়েন্টে ধরলা নদীর পানি বিপৎসীমার ৭ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। দুধকুমার নদের পানি বাড়লেও পাটেশ্বরী পয়েন্টে ২২ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
বন্যা-পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে কুড়িগ্রাম পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী রাকিবুল হাসান বলেন, 'দেশের উত্তরাঞ্চলে হালকা থেকে ভারী বৃষ্টি হতে পারে। ফলে আগামী তিন দিন ব্রহ্মপুত্র নদ অববাহিকায় পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকবে। এ সময় কুড়িগ্রামের বিভিন্ন স্থানে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হতে পারে। এ ছাড়া তিস্তা, ধরলা নদী ও দুধকুমার নদের পানি আগামী তিন দিন বেড়ে স্বল্পমেয়াদে বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হতে পারে। জেলার নদ-নদীর অববাহিকায় নিম্নাঞ্চল পস্নাবিত হয়ে মধ্যম মানের বন্যা হতে পারে।'
কুড়িগ্রামে নদ-নদীর পানি বাড়ায় অনেক স্থানে ভাঙন দেখা দিয়েছে। বন্যায় পস্নাবিত হয়েছে অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। শুক্রবার সকালে জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা নবেজ উদ্দীন সরকার বলেন, 'জেলার ১৪৬টি প্রাথমিক বিদ্যালয় বন্যার পানিতে পস্নাবিত হয়েছে। ৩৭টি বিদ্যালয়ের পাঠদান কার্যক্রম সাময়িক বন্ধ করা হয়েছে। তিস্তা নদীর ভাঙনে চর গুজিমারী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় বিলীন হয়েছে। ১ নম্বর খামার দামার হাট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একাংশ ভেঙে গেছে।'
জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সাইদুল আরীফ বলেন, 'তাদের পাওয়া তথ্যমতে, জেলার ৬২ হাজার ২০০ জন পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। বন্যার্তদের জন্য নগদ অর্থ ও ত্রাণ পর্যাপ্ত রয়েছে। জেলায় মোট ৪০০টি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়েছে।'
দেশের এমন বন্যা পরিস্থিতির মধ্যে শুক্রবার আবহাওয়াবিদ মো. শাহীনুল ইসলাম স্বাক্ষরিত বিজ্ঞপ্তিতে আবহাওয়ার পূর্বাভাসে জানানো হয়েছে, মৌসুমি বায়ুর অক্ষ পাঞ্জাব, হরিয়ানা, উত্তর প্রদেশ, বিহার, পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের মধ্যাঞ্চল হয়ে আসাম পর্যন্ত বিস্তৃত রয়েছে। এর একটি বর্ধিতাংশ উত্তর বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত। মৌসুমি বায়ু বাংলাদেশের ওপর সক্রিয় এবং উত্তর বঙ্গোপসাগরে মাঝারি অবস্থায় রয়েছে।
আজ শনিবার সকাল ৯টা থেকে পরের ২৪ ঘণ্টায়ও বৃষ্টির সম্ভাবনা আছে। রংপুর বিভাগের অধিকাংশ জায়গায়; রাজশাহী, ময়মনসিংহ ও সিলেট বিভাগের অনেক জায়গায় এবং ঢাকা, খুলনা, বরিশাল ও চট্টগ্রাম বিভাগের কিছু কিছু জায়গায় অস্থায়ীভাবে দমকা হাওয়াসহ হালকা থেকে মাঝারি ধরনের বৃষ্টি বা বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে। সেই সঙ্গে রংপুর ও সিলেট বিভাগের কোথাও কোথাও মাঝারি ধরনের ভারী থেকে ভারী বর্ষণ হতে পারে। এসময় সারা দেশে দিনের তাপামাত্রা সামান্য বাড়তে পারে এবং রাতের তাপমাত্রা প্রায় অপরিবর্তিত থাকতে পারে।
রোববার সকাল ৯টা থেকে পরের ২৪ ঘণ্টায় রংপুর বিভাগের অনেক জায়গায়; রাজশাহী, ময়মনসিংহ ও সিলেট বিভাগের কিছু কিছু জায়গায় এবং ঢাকা, খুলনা, বরিশাল ও চট্টগ্রাম বিভাগের দু'এক জায়গায় অস্থায়ীভাবে দমকা হাওয়াসহ হালকা থেকে মাঝারি ধরনের বৃষ্টি বা বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে। সেই সঙ্গে রংপুর ও সিলেট বিভাগের কোথাও কোথাও মাঝারি ধরনের ভারী থেকে ভারী বর্ষণ হতে পারে। এ সময় সারা দেশে দিনের তাপমাত্রা সামান্য বাড়তে পারে এবং রাতের তাপমাত্রা প্রায় অপরিবর্তিত থাকতে পারে।
অন্যদিকে, বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র শুক্রবার জানায়, ব্রহ্মপুত্র-যমুনা ও গঙ্গা-পদ্মার সঙ্গে সংযুক্ত নদ-নদীগুলোর পানি সমতল বাড়ছে যা আগামী ৪৮ ঘণ্টা পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পারে। কুশিয়ারা ছাড়া দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের অন্যান্য প্রধান নদীগুলোর পানি সমতল সার্বিকভাবে হ্রাস পাচ্ছে, যা আগামী ২৪ ঘণ্টা পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পারে।
আবহাওয়া সংস্থাগুলোর তথ্য অনুযায়ী, দেশের উত্তরাঞ্চল ও তৎসংলগ্ন উজানে আগামী ৪৮ ঘণ্টায় ভারী থেকে অতিভারী এবং উত্তর-পূর্বাঞ্চল ও তৎসংলগ্ন উজানে ভারী বৃষ্টিপাতের পূর্বাভাস রয়েছে। ফলে আগামী ২৪ ঘণ্টায় কুড়িগ্রাম, জামালপুর, গাইবান্ধা, বগুড়া, সিরাজগঞ্জ ও টাঙ্গাইল জেলার ব্রহ্মপুত্র-যমুনা নদ-নদী সংলগ্ন নিম্নাঞ্চলের বন্যার পরিস্থিতি অবনতি হতে পারে।
আগামী ২৪ ঘণ্টায় দেশের উত্তরাঞ্চলের তিস্তা, ধরলা, দুধকুমার ও ঘাঘট নদীসমূহের পানি সমতল সময় বিশেষে দ্রম্নত বৃদ্ধি পেতে পারে। এর ফলে তিস্তা ও দুধকুমার নদীসমূহের পানি সমতল কতিপয় পয়েন্টে স্বল্পমেয়াদে বিপৎসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হতে পারে এবং ধরলা ও ঘাঘট নদী সংলগ্ন কুড়িগ্রাম ও গাইবান্ধা জেলার কতিপয় নিম্নাঞ্চল বন্যা পরিস্থিতি কিছুটা অবনতি হতে পারে।
আগামী ৪৮ ঘণ্টায় দেশের উত্তরাঞ্চল ও উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের যমুনাশ্বরী, করতোয়া, বাঙ্গালী, আপার করতোয়া, পুনর্ভবা, টাঙ্গন, ইছামতি-যমুনা, আত্রাই, মহানন্দা এবং ছোট যমুনা নদীসমূহের পানি সমতল সময় বিশেষে দ্রম্নত বৃদ্ধি পেতে পারে।
ঢাকার চারপাশের নদীগুলোর পানি সমতল আগামী ৫ দিন স্থিতিশীল ভাবে বৃদ্ধি পেতে পারে। আগামী ১০ দিনের মধ্যে ঢাকার চারপাশের নদীগুলোর অববাহিকায় বিপৎসীমা অতিক্রমের শঙ্কা নেই।
স্টাফ রিপোর্টার, টাঙ্গাইল জানান, শুক্রবার সকাল পর্যন্ত জেলার চার উপজেলার নিম্নাঞ্চল পস্নাবিত হয়ে কয়েক হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। যমুনা ও ঝিনাই নদীর পানি বেড়ে বিপৎসীমার ২০ ও ৭৮ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ইতোমধ্যে তিন উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় নদীভাঙন দেখা দিয়েছে।
টাঙ্গাইল পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা যায়, গত ২৪ ঘণ্টায় শুক্রবার সকাল ৯টায় যমুনা নদীর পানি পোড়াবাড়ী পয়েণ্টে বিপৎসীমার ২০ সেন্টিমিটার এবং ঝিনাই নদীর (নিউ ধলেশ্বরী) পানি জোকারচর পয়েণ্টে বিপৎসীমার ৭৮ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এছাড়া ধলেশ্বরী নদীর পানি এলাসিন পয়েণ্টে ৪১ সেন্টিমিটার বেড়ে বিপৎসীমার ২১ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। একইভাবে ফটিকজানি নদীর পানি নলছোপা পয়েণ্টে ৩০ সেন্টিমিটার বেড়ে বিপৎসীমার ১.৭১ মিটার, বংশাই নদীর পানি কাউলজানী পয়েন্টে ১০ সেণ্টিমিটার বেড়ে বিপৎসীমার ২.৩৯ মিটার, মির্জাপুর পয়েণ্টে ১৩ সেন্টিমিটার বেড়ে ১.০৫ মিটার এবং মধুপুর পয়েণ্টে ২৫ সেন্টিমিটার বেড়ে বিপৎসীমার ৪.২৯ মিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
জেলার অভ্যন্তরীণ নদীগুলোর পানি ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাওয়ায় ভূঞাপুর, গোপালপুর, কালিহাতী ও সদর উপজেলার কয়েকটি গ্রামের কয়েক হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। এছাড়া ভূঞাপুর, কালিহাতী ও সদর উপজেলার কয়েকটি এলাকায় নদীভাঙনে ফসলি জমি তলিয়ে গেছে। লোকালয়ে পানি ওঠায় সাধারণ মানুষ বিপাকে পড়েছেন। একই সঙ্গে বন্যাকবলিত এলাকার মানুষের মধ্যে সাপের আতঙ্ক বিরাজ করছে। বিশেষ করে রাসেলস ভাইপার সাপ নিয়ে বেশি আতঙ্ক রয়েছে।
টাঙ্গাইল পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. সাজ্জাদ হোসেন জানান, যমুনা, ঝিনাই, ধলেশ্বরীসহ জেলার সবকটি নদীর পানি বেড়েছে। আরও কয়েকদিন পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকবে। এতে বন্যার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
টাঙ্গাইল জেলা প্রশাসক মো. কায়ছারুল ইসলাম জানান, উজানের পানি নেমে আসায় ভাটিতে ধীরে ধীরে পানি বাড়ছে। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে বন্যা মোকাবিলায় সব ধরনের প্রস্তুতি নেওয়া আছে।
জামালপুর প্রতিনিধি জানান, জামালপুরে যমুনা, ব্রহ্মপুত্র, জিঞ্জিরামসহ সবগুলো নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় বন্যা দেখা দিয়েছে। এতে পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন অন্তত ১০ হাজার মানুষ।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, জেলার দেওয়ানগঞ্জ উপজেলার চিকাজানী, চুকাইবাড়ী, বাহাদুরাবাদ, ইসলামপুর উপজেলার চিনাডুলী, নোয়ারপাড়া, কুলকান্দি, পাথর্শী, সাপধরী, বেলগাছা, মেলান্দহ উপজেলার ঘোষেরপাড়া, আদ্রা, মাহমুদপুর, নাংলা, কুলিয়া এবং মাদারগঞ্জ উপজেলার চর পাকেরদহ ইউনিয়নের নিম্নাঞ্চল পস্নাবিত হয়েছে। এসব ইউনিয়নের অন্তত দশ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। তলিয়ে গেছে কয়েক হাজার হেক্টর ফসলি জমি।
এদিকে দেওয়ানগঞ্জ উপজেলার কাঠারবিল এলাকায় দেওয়ানগঞ্জ-সানন্দবাড়ি আঞ্চলিক সড়কের ৩০ মিটার অংশ বন্যার পানির স্রোতে ভেঙে গেছে। এতে করে দেওয়ানগঞ্জ উপজেলার সঙ্গে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে উপজেলার পাররামরামপুর, চর আমখাওয়া, ডাংধরা ইউনিয়ন এবং পার্শ্ববর্তী কুড়িগ্রাম জেলার রৌমারী ও রাজিবপুর উপজেলার সড়ক যোগাযোগ।
জামালপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম জানান, গত ২৪ ঘণ্টায় দেওয়ানগঞ্জের বাহাদুরাবাদ ঘাট পয়েন্টে যমুনা নদীর পানি ৭৫ সেন্টিমিটার বেড়ে বিপৎসীমার ৭৭ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। আগামী এক সপ্তাহ পর্যন্ত পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকতে পারে। এবারে মাঝারি আকারের বন্যা হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা আলমগীর হোসেন বলেন, বন্যার্তদের সহায়তায় জেলার ৭ উপজেলায় ৩শ' মেট্টিক টন চাল ও ৩ হাজার ৪শ' প্যাকেট শুকনো খাবার বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।
নাগেশ্বরী (কুড়িগ্রাম) প্রতিনিধি জানান, কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরীতে নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় জেলায় বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। পস্নাবিত হয়েছে নিম্নাঞ্চল, চারাঞ্চল ও দীপচরসহ বিভিন্ন এলাকা। নদ-নদী তীরবর্তী চর ও নিম্নাঞ্চলের বসতভিটায় পানি প্রবেশ করায় চরম দুর্ভোগে পড়েছে বানভাসি মানুষ। অনেক পরিবার গবাদিপশুসহ বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধে আশ্রয় নিয়েছেন। এছাড়াও বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে আমন বীজতলা, পাট ও মৌসুমি ফসলের ক্ষেত। কাঁচা-পাকা সড়ক তলিয়ে যাওয়ায় বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে যোগাযোগ ব্যবস্থা। পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন অন্তত ৩০ হাজার মানুষ।
উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, দুই দফা বন্যায় এ উপজেলার বন্যা কবলিতদের জন্য ৩০ হাজার ৫০০ মে. টন চাল এবং ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।
উপজেলা নির্বাহী অফিসার সিব্বর আহমেদ জানান, এ উপজেলার বন্যাকবলিত এলাকাগুলো পরিদর্শন করে সেখানে ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. রাকিবুল হাসান জানান, ব্রহ্মপুত্রের পানি তিনটি পয়েন্টে বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এর মধ্যে নাগেশ্বরী উপজেলার নুনখাওয়া পয়েন্টে শুক্রবার ৭২ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। ব্রহ্মপুত্রসহ অন্যান্য নদ-নদীর পানি আরও ৪৮ ঘণ্টা বৃদ্ধি অব্যাহত থাকতে পারে।
কুলাউড়া (মৌলভীবাজার) প্রতিনিধি জানান, হাকালুকি হাওড় তীরের কুলাউড়া, জুড়ী ও বড়লেখা উপজেলায় বন্যা পরিস্থিতির ভয়াবহ অবনতি হয়েছে। এতে দুর্ভোগে পড়েছেন তিন উপজেলার দুই লক্ষাধিক মানুষ। বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হওয়ায় অনেক প্রতিষ্ঠানে মাধমিক স্থরের ষান্মাসিক পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছে। এদিকে, গত ১৬ দিন ধরে সরকারি হাসপাতাল ও উপজেলা প্রশাসনিক অফিসসহ আশপাশের আবাসিক এলাকাগুলো পানিতে নিমজ্জিত রয়েছে। ফলে স্বাস্থ্যসেবা প্রদান ও সরকারি দাপ্তরিক কার্যক্রমে চরম ব্যাঘাত ঘটছে।
হাওড় তীরের ভূকশিমইল ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আজিজুর রহমান মনির জানান, বন্যার পানি অনেকটা কমে গিয়েছিল। কিন্তু দু'দিনের ব্যাবধানে ফের অবনতি হয়েছে। হাওড় পাড়ের মানুষ পানিবন্দি হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। সরকারিভাবে এখন পর্যন্ত তিন হাজার পরিবারকে ১০ কেজি করে চাল দেওয়া হয়েছে।
কুলাউড়াউ পজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা মো. শিমুল আলী জানান, ফের বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হওয়ায় অতিরিক্ত ২ হাজার পরিবারকে খাদ্য সহায়তা করার ব্যবস্থা আছে। নতুন করে বরাদ্দের চাহিদা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানো হয়েছে। বরাদ্দ পেলেই দ্রম্নত বানভাসি মানুষের মাঝে সেগুলো বিতরণ করা হবে।
মান্দা (নওগাঁ) প্রতিনিধি জানান, নওগাঁর মান্দায় হু হু করে বাড়ছে আত্রাই ও ফকিন্নি নদীর পানি। বর্তমানে এ দুটি নদীর পানি বিপৎসীমা ছুঁই ছুঁই করছে। এরই মধ্যে বেশকিছু এলাকা ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে।
জানা গেছে, গত বছরের বন্যায় ভেঙে যাওয়া কয়েকটি বেড়িবাঁধ মেরামত করা হয়নি। ২০১৭ সালের ভয়াবহ বন্যায় ভেঙে যাওয়া উত্তর নুরুলস্নাবাদ ও চকরামপুর এলাকায় বেড়িবাঁধের দুটি স্থান আজও অরক্ষিত অবস্থায় রয়েছে। এদিকে আত্রাই ও ফকিন্নি নদীর পানি বাড়তে থাকায় বৃহস্পতিবার নদী দুটির ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা পরিদর্শন করেন স্থানীয় সংসদ সদস্য এসএম ব্রহানী সুলতান মামুদ গামা।
৪৯ নওগাঁ- ৪ (মান্দা) আসনের সংসদ সদস্য এসএম ব্রহানী সুলতান মামুদ গামা বলেন, বন্যা মোকাবিলায় সব ধরনের আগাম প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধের ঝুঁকিপূর্ণ পয়েন্টগুলোতে কাজ করার জন্য নওগাঁ পানি উন্নয়ন বোর্ডকে নির্দেশ নেওয়া হয়েছে।
সাঘাটা (গাইবান্ধা) প্রতিনিধি জানান, যমুনা নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় নদীর তীরবর্তী নিম্নাঞ্চল পস্নাবিত হয়ে গাইবান্ধার সাঘাটা উপজেলার ৮টি ইউনিয়নের ১২ হাজার ৫৯০ পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত ২৪ ঘণ্টায় ৬৩ সেন্টিমিটার পানি বৃদ্ধি পেয়ে যমুনা নদীর পানি বিপৎসীমার ৬২ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ওই সব এলাকায় পানিতে তলিয়ে গেছে বসতবাড়িসহ ফসলের ক্ষেত। সেই সঙ্গে গো-খাদ্যের সংকট দেখা দিয়েছে। পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় উপজেলায় অন্তত ৭০টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করেছেন উপজেলা শিক্ষা অফিস। ইতোমধ্যে সাঘাটা ইউনিয়ন, ঘুড়িদহ হলদিয়া ও জুমার বাড়ি, ভরত খালী, ইউনিয়নে সাঘাটা উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে বন?্যার্তদের মাঝে ২০০ মেট্রিক টন জি আর চাল, শুকনো খাবার, গো-খাদ্য ও শিশুখাদ্য বিতরণ করা হয়েছে।