সিলেটে একটি উন্নয়ন কূপ এবং রশিদপুরে অনুসন্ধান কূপ খননসহ মোট ৯ ক্রয় প্রস্তাব অনুমোদন দিয়েছে সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি। অনুমোদিত প্রস্তাবের মধ্যে রয়েছে কৃষি মন্ত্রণালয়ের ২টি, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের ২টি, সড়ক পরিবহণ ও মহাসড়ক বিভাগের ১টি ও স্থানীয় সরকার বিভাগের ৪টি ভেরিয়েশন প্রস্তাব। এতে মোট ব্যয় হবে এক হাজার ৪৬৮ কোটি ৯০ লাখ ৪০ হাজার ৭৭৬ টাকা।
এছাড়া পদ্মা বহুমুখী সেতু নির্মাণ প্রকল্পের মেয়াদ শেষে আগামীকাল ৫ জুলাই শুক্রবার সমাপনী অনুষ্ঠানের অনুমোদন দিয়েছে অর্থনৈতিক বিষয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি। এতে ব্যয় হবে ৫ কোটি টাকা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অনুষ্ঠানে অংশ নেবেন।
বুধবার সচিবালয়ে অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলীর সভাপতিত্বে সভায় কমিটির সদস্য, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সিনিয়র সচিব, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সচিব ও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। সভা শেষে অনুমোদিত প্রস্তাবগুলোর বিভিন্ন দিক সাংবাদিকদের সামনে তুলে ধরেন মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সমন্বয় ও সংস্কার সচিব মো. মাহমুদুল হোসাইন খান।
সেতুর মাওয়া প্রান্তে ওই সমাবেশ হবে উলেস্নখ করে মন্ত্রিপরিষদের সমন্বয় ও সংস্কার বিভাগের সচিব মাহমুদুল হোসাইন খান বলেন, 'গত ৩০ জুন পদ্মা বহুমুখী সেতু নির্মাণ প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়েছে। সমাপ্তি উপলক্ষে শুক্রবার আয়োজিত সমাবেশে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী উপস্থিত থাকার সম্মতি জ্ঞাপন করেছেন। যেহেতু হাতে সময় কম, তাই এই অনুষ্ঠান উপলক্ষে ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টসহ অন্যান্য কাজগুলো সরাসরি ক্রয় পদ্ধতিতে কেনার জন্য অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।'
সরকারের তথ্য অনুযায়ী, নিজস্ব অর্থায়নে নির্মিত দেশের দীর্ঘতম সেতুটি ২০২২ সালের ২৫ জুন উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী। এর দুদিন পর সেতুটি চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হয়। এরপর থেকে গত দুই বছর সেতুর উপর দিয়ে ১ কোটি ২৭ লাখ যানবাহন পারাপার হয়েছে। গত ২৯ জুন পর্যন্ত রাজস্ব আদায় হয়েছে এক হাজার ৬৬১ কোটি টাকা।
প্রতিদিন গড়ে ১৯ হাজার যান চলাচল করেছে এই সেতুতে। দৈনিক গড়ে ২ কোটি ৩০ লাখ টাকার টোল আদায় হয়েছে বলেও মন্ত্রিপরিষদের সমন্বয় ও সংস্কার বিভাগের সচিব মাহমুদুল হোসাইন খান জানান।
তিনি জানান, বাংলাদেশের সক্ষমতার প্রতীক 'পদ্মা সেতু' নির্মাণ প্রকল্পটির মেয়াদ ২০২৪ সালের ৩০ জুন শেষ হয়। এ উপলক্ষে আগামী ৫ এপ্রিল সেতুর মাওয়া প্রান্তে একটি সুধী সমাবেশের আয়োজন করা হয়েছে। যেখানে প্রধানমন্ত্রী উপস্থিত থাকার সম্মতি দিয়েছেন। ওই সুধী সমাবেশে ১ হাজার ৫০০ জনের বসার আয়োজনসহ শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ভিভিআইপি ব্যবহার উপযোগী প্যান্ডেল, মঞ্চ, জনসভা, রাস্তা সজ্জিতকরণ, উন্নয়ন ব্র্যান্ডিং, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, ডকুমেন্টারি প্রস্তুত, বিভিন্ন ব্যানার ও ফেস্টুন তৈরি, সাউন্ড সিস্টেমসহ অন্যান্য আনুষঙ্গিক সেবা সংগ্রহের প্রয়োজন হবে।
বিষয়টি জরুরি বিধায় পদ্মা বহুমুখী সেতু নির্মাণ প্রকল্পের সমাপনী অনুষ্ঠান উপলক্ষে সংশ্লিষ্ট সেবাসমূহ পিপিএ ২০০৬ এর ৬৮(১) ধারা এবং পিপিআর ২০০৮ এর বিধি ৭৬(২) অনুযায়ী সরাসরি ক্রয় পদ্ধতিতে ক্রয়ের নীতিগত অনুমোদনের জন্য উপস্থাপন করা হলে কমিটি তাতে অনুমোদন দিয়েছে বলে জানা গেছে।
সচিব জানান, ২ হাজার ৬০৫ কোটি টাকা ব্যয়ে এই সেতু নির্মিত হয়েছে। ২০০১ সালের ৪ জুলাই মুন্সীগঞ্জের মাওয়ায় পদ্মা সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন শেখ হাসিনা। এরপর ২০০৭ সালের ২৮ আগস্ট পদ্মা সেতু প্রকল্পের অনুমোদন দেয় সেনানিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের একনেক। তখন প্রকল্পের নির্মাণ ব্যয় ধরা হয়েছিল ১০ হাজার ১৬২ কোটি টাকা।
২০০৯ সালে সরকার গঠনের পর সেতু কাজ পুরোদমে শুরু করে আওয়ামী লীগ সরকার। এই সময়ে বিস্তারিত নকশা প্রণয়ন করা হয়। দায়িত্ব পায় নিউজিল্যান্ডভিত্তিক মাউনসেল লিমিটেড।
২০১০ সালের ১১ এপ্রিল মূল সেতুর দরপত্র আহ্বান করে সরকার। পরের বছর
২০১১ সালের ১১ জানুয়ারি রেলপথ যুক্ত করে ২০ হাজার ৫০৭ কোটি টাকায় পদ্মা বহুমুখী সেতু সংশোধিত নির্মাণ প্রকল্প অনুমোদন করে একনেক।
এরপর ২০১১ সালে পদ্মা সেতু প্রকল্পের কাজের শুরুতে বিশ্ব ব্যাংক দুর্নীতির অভিযোগ তুলে সরে যায়।
সেই অভিযোগকে ভিত্তি ধরে সমালোচনা হয় সরকারের। যদিও পরে দুর্নীতি দমন কমিশন তদন্ত করে অভিযোগের সত্যতা পায়নি। কানাডার আদালতেও এই সংক্রান্ত মামলাটি প্রমাণ করা যায়নি। ২০১২ সালে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নেয় মন্ত্রিসভা এবং ২০১৫ সালে পদ্মার মূল সেতুর নির্মাণকাজের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
দুটি কূপ খননে ব্যয় প্রায় ৪৪৫ কোটি
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সমন্বয় ও সংস্কার সচিব বলেন, 'বিদু্যৎ ও জ্বালানির দ্রম্নত সরবরাহ বৃদ্ধির (বিশেষ বিধান) আইন, ২০১০ অনুসরণে সিলেট-১১ (উন্নয়ন কূপ) ও রশিদপুর-১৩ নং কূপ (অনুসন্ধান কূপ) খনন করা হবে। এতে ব্যয় ধরা হয়েছে ৪৪৪ কোটি ৮৫ লাখ ৭৯ হাজার ৮৯৩ টাকা ৪৮ পয়সা। এ নিয়ে সিলেট গ্যাস ফিল্ডস লিমিটেড (এসজিএফএল) ও সিনোপ্যাক ইন্টারন্যাশনাল পেট্রোলিয়াম সার্ভিস করপোরেশনর মধ্যে চুক্তি সম্পাদনের প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে।'
তিনি জানান, এটির প্রস্তাবক মন্ত্রণালয় জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ। সুপারিশকৃত দরদাতা প্রতিষ্ঠান চায়নার সিনোপ্যাক ইন্টারন্যাশনাল পেট্রোলিয়াম সার্ভিস করপোরেশন।
কেনা হবে ৭০ হাজার টন সার
সংস্কার সচিব বলেন, 'রাষ্ট্রীয় চুক্তির মাধ্যমে ২০২৪-২০২৫ অর্থবছরের জন্য সৌদি আরব ও রাশিয়া থেকে ৭০ হাজার মেট্রিক টন সার কেনার অনুমোদন দিয়েছে সরকার। এতে মোট ব্যয় হবে ৩৪৪ কোটি ৩৮ লাখ ৩০ হাজার টাকা। এর মধ্যে ৪০ হাজার মেট্রিক টন ডিএপি ও ৩০ হাজার মেট্রিক টন এমওপি সার রয়েছে।'
তিনি জানান, রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সৌদি আরবের মা'আদেন এবং বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএডিসি) মধ্যে স্বাক্ষরিত চুক্তির আওতায় সপ্তম লটে সৌদি আরবের মা'আদেনের কাছ থেকে ৪০ হাজার মেট্রিক টন ডিএপি সার আমদানির করা হবে। এর ক্রয়মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে ২৪৬ কোটি ৮৫ লাখ ৬০ হাজার টাকা। প্রতি মেট্রিক টন সারের দাম ৫২৩.০০ মার্কিন ডলার। যা আগে ছিল ৫১৯.০০ মার্কিন ডলার।
তিনি বলেন, 'অন্য এক প্রস্তাবে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে চুক্তির মাধ্যমে রাশিয়ার জেএসসি ফরেন ইকোনমিক করপোরেশন ও বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএডিসি) মধ্যে স্বাক্ষরিত চুক্তির আওতায় ১ম লটে রাশিয়ার জেএসসি ফরেন ইকোনমিক করপোরেশনের কাছ থেকে ৩০ হাজার মেট্রিক টন এমওপি সার অনুমোদন দিয়েছে সরকার। এতে ব্যয় হবে ৯৭ কোটি ৫২ লাখ ৭০ হাজার টাকা। প্রতি মেট্রিক টনের মূল্য ধরা হয়েছে ২৭৫.৫০ মার্কিন ডলার। যা আগে ছিল প্রতি মেট্রিক টন ২৮৯.৭৫ মার্কিন ডলার।'
এক কার্গো এলএনজি কেনা হবে
সংস্কার সচিব বলেন, 'বিদু্যৎ ও জ্বালানির দ্রম্নত সরবরাহ বৃদ্ধি আইন ২০১০ এর আওতায় স্পট মার্কেট থেকে এক কার্গো এলএনজি কেনার অনুমোদন দিয়েছে সরকার। এতে ব্যয় হবে ৬০৯ কোটি ২৭ লাখ ৬৫ হাজার ৮৯৭ টাকা। ২০২৪ সালের ২১তম এলএনজি আমদানি ক্রয়ের প্রস্তাব এটি।'
মো. মাহমুদুল হোসাইন খান জানান, বিদু্যৎ ও জ্বালানির দ্রম্নত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইন, ২০১০ এর আওতায় 'মাস্টার সেল অ্যান্ড পারসেজ অ্যাগ্রিমেন্ট' স্বাক্ষরকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্য হতে কোটেশন সংগ্রহ প্রক্রিয়ায় স্পট মার্কেট হতে এক কার্গো এলএনজি আমদানির অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের এক প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে ইউনাইটেড স্টেটসের মেসার্স এক্সিলেরেট এনার্জি এলপি থেকে এক কার্গো এলএনজি আমদানির ক্রয় প্রস্তাবের অনুমোদন দেওয়া হয়। এতে ব্যয় হবে ৬০৯ কোটি ২৭ লাখ ৬৫ হাজার ৮৯৭ টাকা (ভ্যাট ও ট্যাক্সসহ)। প্রতি এমএমবিটিইউ এলএনজির দাম পড়বে ১৩ দশমিক ৫৫৮০ মার্কিন ডলার। পূর্বে ছিল ১২ দশমিক ৯৬৯৭ মার্কিন ডলার।
এর আগে গত ৪ জুন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠকে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে সিঙ্গাপুর মেসার্স গানভোর সিঙ্গাপুর প্রাইভেট লিমিটেডের কাছ থেকে এক কার্গো (২০২৪ সালের ২১তম) এলএনজি কেনার প্রস্তাবে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এতে ব্যয় হবে ৬০১ কোটি ৬৪ লাখ ৫ হাজার ১৮৭ টাকা। প্রতি এমএমবিটিইউ এলএনজি দাম পড়বে ১২ দশমিক ৯৬৯৭ মার্কিন ডলার। যা আগে ছিল প্রতি এমএমবিটিইউ এলএনজির দাম ১০ দশমিক ৩০০০ মার্কিন ডলার।
ব্যয় বাড়ল পরিচ্ছন্নতা কর্মীদের আবাসনে
সংস্কার সচিব জানান, ঢাকা সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্নতা কর্মীদের জন্য চারটি বহুতল ভবন নির্মাণের ব্যয় ৪৭ কোটি ৭১ লাখ টাকা বাড়ানো হয়েছে। ঢাকার গাবতলীতে নির্মাণ হতে যাওয়া ভবন চারটির জন্য খরচ ধরা হয়েছিল ১৮২ কোটি টাকার কিছু বেশি। নির্মাণ ব্যয়ে তৃতীয় সংশোধনীতে ব্যয় দাঁড়াল ২৩০ কোটি টাকা।
তিনি জানান, মোট চারটি প্যাকেজে নির্মাণ হচ্ছে ভবনগুলো। প্যাকেজ নম্বর ডবিস্নউ-২ তে মূল চুক্তিমূল্য ৪৯ কোটি ৪৯ লাখ টাকা থেকে ১৩ কোটি ৪ লাখ টাকা বাড়িয়ে ৬২ কোটি ৫৩ লাখ টাকা করা হয়েছে।
প্যাকেজ নম্বর ডবিস্নউ-৩ এ মূল চুক্তিমূল্য ৪৯ কোটি ৪৮ লাখ ১৬ হাজার ৪৬১ টাকা থেকে ১১ কোটি ৬১ লাখ ৪৭ হাজার ৯৯৫ টাকা বাড়িয়ে ৬১ কোটি ৯ লাখ ৬৪ হাজার ৪৫৭ টাকা করা হয়েছে।
প্যাকেজ ডবিস্নউ-৪ এর মধ্যে চুক্তিমূল্য ৫১ কোটি ১৯ লাখ ৫৩ হাজার ১৮৭ টাকা থেকে ১৩ কোটি ৭৫ লাখ ৫ হাজার ৬৫৮ টাকা বাড়িয়ে ৬৪ কোটি ৯৪ লাখ ৫৮ হাজার ৮৪৫ টাকা করা হয়েছে।
প্যাকেজ ডবিস্নউ-৫ এর মূল চুক্তিমূল্য ৩২ কোটি ১০ লাখ ৬২ হাজার ২৮০ টাকা থেকে ৯ কোটি ৩০ লাখ ৭৯ হাজার ২৬ টাকা বাড়িয়ে ৪১ কোটি ৪১ লাখ ৪১ হাজার ৩০৭ টাকা করা হয়েছে।
সচিব জানান, ভবনে অগ্নি নির্বাপণ ব্যবস্থা ছিল না, সংশোধনে এটা যুক্ত করা হচ্ছে। ড্রেন ও ফুটপাথ সংযোজন করা হয়েছে। বৈদু্যতিক সাব-স্টেশনের স্থান পরিবর্তন ও ড্রয়িং ও ডিজাইন পরিবর্তন আনা হয়েছে। এতে প্রতিটি প্যাকেজের দর ২৩ দশমিক ৪৭ শতাংশ থেকে ২৮ দশমিক ৯৯ শতাংশ বেড়েছে।