উত্তরে চোখ রাঙাচ্ছে তিস্তা বন্যা পরিস্থিতির অবনতি
সাত জেলায় কয়েক হাজার পরিবার পানিবন্দি কুশিয়ারায় বাঁধ উপচে লোকালয়ে ঢুকছে পানি পাঠদান বন্ধ মৌলভীবাজারের ৪৭ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অনিশ্চয়তায় স্নাতক ও এইচএসসি পরীক্ষার্থীরা
প্রকাশ | ০৪ জুলাই ২০২৪, ০০:০০
যাযাদি ডেস্ক
অতিভারী বৃষ্টিপাত ও উজান থেকে নেমে আসা পানিতে দেশের উত্তর ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। বন্যার বিস্তার ঘটছে উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলেও। এদিকে উত্তরে চোখ রাঙাচ্ছে তিস্তা। গত কয়েকদিন ধরে উজান থেকে নেমে আসা পানির তোড়ে কয়েকটি পয়েন্টে বিপৎসীমার কাছাকাছি প্রবাহিত হচ্ছে নদীটি। যমুনা নদীর সমতলে এবং টাঙ্গাইলের বিভিন্ন সদীর পানি হু-হু করে বাড়ছে। ফেনীর মুহুরী নদী রক্ষাবাঁধের নতুন আরেকটি স্থান ধসে গেছে। বাঁধের মোট ছয়টি স্থান ভেঙে গত তিনদিন ধরে পানি ঢুকছে লোকালয়ে। ফলে ফুলগাজী ও পরশুরাম উপজেলার তিন হাজারের বেশি পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। ভেসে গেছে কোটি টাকার মাছ ও সবজি ক্ষেত। কুড়িগ্রামের ব্রহ্মপুত্র নদের পানি দুই পয়েন্টে বিপৎসীমা অতিক্রম করে নিম্নাঞ্চল পস্নাবিত হয়েছে। এতে পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন হাজারও মানুষ।
এদিকে বুধবার দেশের সব প্রাথমিক বিদ্যালয় খুললেও মৌলভীবাজারের বন্যাকবলিত দুই উপজেলার ৪৭টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পাঠদান কার্যক্রম বন্ধ আছে। জেলার কুলাউড়া ও জুড়ী উপজেলার ৪৭টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পানি নামেনি। পাশাপাশি কয়েকটি স্কুল আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হওয়ায় এসব প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা কার্যক্রম আবার সচল করা যায়নি বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। বন্যার পানিতে তলিয়ে আছে রাঙামাটির বাঘাইছড়ির কাচালং ডিগ্রি কলেজ। এতে চলমান এইচএসসি ও দ্বিতীয় বর্ষের স্নাতক পরীক্ষা নিয়ে বিপাকে পড়েছেন কর্তৃপক্ষ। এ ছাড়া শেরপুর, সিলেট, নেত্রকোনাসহ বিভিন্ন জেলার বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটেছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী বর্তমানে সাত জেলার নিম্নাঞ্চল পস্নাবিত হয়েছে বানের পানিতে। ব্রহ্মপুত্র নদের পানি নুন খাওয়া, হাতিয়া ও চিলমারী, যমুনার পানি সাঘাটায়, সুরমার পানি কানাইঘাট, সিলেট ও সুনামগঞ্জে, কুশিয়ারার পানি অমলশীদ, শেরপুর-সিলেট, মারকুলি ও শেওলায়, মনু'র পারি মনু রেলব্রিজ ও মৌলভীবাজারে, খোয়াইয়ের পানি বলস্না ও মৌলভীবাজার এবং সোমেশ্বরীর পানি কলমাকান্দায় বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ফলে সংশ্লিষ্ট এলাকার নিম্নাঞ্চল পস্নাবিত হয়েছে।
পাউবো এক পূর্বাভাসে জানিয়েছে, ব্রহ্মপুত্র-যমুনা ও গঙ্গা-পদ্মা নদ-নদীগুলোর পানির সমতল বাড়ছে, যা আগামী তিনদিন পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পারে। তবে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সুরমা, ভুগাই ও কংস নদীর পানির সমতল কিছুটা কমেছে। অন্যদিকে কুশিয়ারা নদীর পানির সমতল বেড়েছে, যা অব্যাহত থাকতে পারে।
পাউবোর তথ্য অনুযায়ী, বিভিন্ন নদনদীতে তাদের পর্যবেক্ষণাধীন ১১০টি স্টেশনের মধ্যে বুধবার পানির সমতল বেড়েছে ৮৩টিতে, কমেছে ২৭টিতে। আর বিপৎসীমার ওপর দিয়ে ১৬ স্টেশনের পানি প্রবাহিত হচ্ছে।
আবহাওয়ার তথ্যানুযায়ী, দেশের উত্তরাঞ্চল, উত্তর-পূর্বাঞ্চল ও তৎসংলগ্ন উজানে আগামী ২৪ ঘণ্টায় মাঝারি থেকে ভারী এবং ৪৮ ঘণ্টায় ভারী বৃষ্টির পূর্বাভাস রয়েছে। আজ বৃহস্পতিবার নাগাদ জামালপুর, গাইবান্ধা, বগুড়া ও সিরাজগঞ্জ জেলার যমুনা নদীসংলগ্ন কতিপয় পয়েন্টে পানির সমতল বেড়ে বিপৎসীমা অতিক্রম করতে পারে। এ সময় কুড়িগ্রাম জেলার ব্রহ্মপুত্র নদসংলগ্ন নিম্নাঞ্চলের বন্যার পরিস্থিতি কিছুটা অবনতি হতে পারে। উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বিভিন্ন নিম্নাঞ্চলের সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি স্থিতিশীল থাকতে পারে।
উৎকণ্ঠায় মৌলভীবাজারের ৩ লাখ মানুষ :স্টাফ রিপোর্টার, মৌলভীবাজার জানান, দ্বিতীয় দফার টানা বৃষ্টি ও ভারতের ঢলে কুশিয়ারা, মনূ ও জুড়ী নদীর পানি বেড়ে বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। বুধবার বিকালে পানি উন্নয়ন বোর্ড নিয়মিত বুলেটিনে জানায়, শহর ঘেঁষা মনূ নদের পানি বিপৎসীমার ৫০ সে.মি. ওপর, কুশিয়ারা বিপৎসীমার ১৯ সে.মি. ওপর ও জুড়ী নদী বিপৎসীমার ১৯১ সে.মি. ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এদিকে দ্বিতীয় দফার বন্যায় জেলার সদর, রাজনগর, কুলাউড়া, কমলগঞ্জ, জুড়ী ও বড়লেখা উপজেলার পানিবন্দি প্রায় ৩ লাখ মানুষ উৎকণ্ঠায় সময় পার করছেন। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক-উচ্চ মাধ্যমিক স্কুল-কলেজ বন্ধ রয়েছে প্রায় দেড়শ'টি।
উত্তরে চোখ রাঙাচ্ছে তিস্তা : এদিকে, লালমনিরহাটের তথ্য অনুযায়ী, তিস্তার পানি বিপৎসীমার কাছাকাছি প্রবাহিত হওয়ায় নদীর বাম তীরের জেলা লালমনিরহাটের চরবাসী আতঙ্কে রয়েছেন। বুধবার হাতীবান্ধা উপজেলার দোয়ানীতে দেশের বৃহত্তম সেচ প্রকল্প তিস্তা ব্যারাজের ডালিয়া পয়েন্টে পানি প্রবাহ রেকর্ড করা হয় ৫২ দশমিক ৫৩ মিটার। যা বিপৎসীমার (স্বাভাবিক ৫২ দশমিক ১৫ মিটার) ২২ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। গত ২৪ ঘণ্টায় ৪২ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে।
বন্যা সতর্কীকরণ কেন্দ্র ও চরবাসী জানান, ভারতে সিকিমে উৎপত্তি স্থল থেকে ভারতে প্রবাহিত হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে তিস্তা নদী। নদীর বাংলাদেশ অংশের উজানে ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণ করে তিস্তার পানি নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করছে প্রতিবেশী দেশ ভারত। বর্ষাকালে অতিরিক্ত পানি ফারাক্কা গেট খুলে বাংলাদেশ অংশে ছেড়ে দেওয়া হয়। একইভাবে শুষ্ক মৌসুমে গেট বন্ধ করে বাংলাদেশকে মরুভূমি করে তিস্তার পানি একক ব্যবহার করছে ভারত সরকার।
বর্ষাকাল শুরু হলেই বাংলাদেশের তিস্তা ব্যারাজের ৪৪টি গেট খুলে তিস্তা নদীর পানি প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করেন ব্যারাজ কর্তৃপক্ষ। এবারও এর ব্যত্যয় ঘটেনি। টানা বৃষ্টি আর উজানের ঢেউয়ের কারণে পানি প্রবাহ বৃদ্ধি পেয়ে তিস্তা নদীর তীরবর্তী নিম্নাঞ্চল পস্নাবিত হয়েছে। ডুবে গেছে চরাঞ্চলের সড়ক পথ। চরবাসীর যাতায়াতের মাধ্যম হয়েছে নৌকা।
তিস্তা ব্যারাজ বন্যা সতর্কীকরণ কেন্দ্র জানায়, ডালিয়া পয়েন্টে তিস্তার পানি প্রবাহ ৩ জুলাই সকাল ৬টায় ছিল ১৭ সেন্টিমিটার নিচে, ৯টায় ছিল ১৯ সেন্টিমিটার নিচে ও দুপুর ১২টায় ২২ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। গত ২৪ ঘণ্টায় বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে ৪২ মিলিমিটার। তবে বড় কোনো বন্যার শঙ্কা নেই।
যমুনার সমতলে ও টাঙ্গাইলের
নদীগুলোতে বাড়ছে পানি
অন্যদিকে, সিরাজগঞ্জে যমুনা নদীর পানি সমতলে ফের বাড়ছে। দুদিনের ব্যবধানে কাজিপুর পয়েন্টে ৮০ সেন্টিমিটার ও সদর হার্ডপয়েন্টে ৭৬ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়েছে। আশঙ্কাজনকহারে পানি বাড়ায় ফের পস্নাবিত হচ্ছে যমুনার অভ্যন্তরীণ চরাঞ্চল।
বুধবার সকালে সিরাজগঞ্জ হার্ড পয়েন্টে যমুনার পানি সমতল রেকর্ড করা হয়েছে ১২ দশমিক ৪৪ মিটার। ২৪ ঘণ্টায় ৪২ সেন্টিমিটার বেড়ে বিপৎসীমার ৪৬ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে (বিপৎসীমা ১২ দশমিক ৯০ মিটার)। এর আগের দিন মঙ্গলবার এই পয়েন্টে যমুনার পানি বেড়েছে ৩৪ সেন্টিমিটার। দুদিনে বেড়েছে ৭৬ সেন্টিমিটার।
অন্যদিকে, কাজিপুর মেঘাই পয়েন্টে পানি সমতল রেকর্ড করা হয়েছে ১৪ দশমিক ১০ মিটার। এ পয়েন্টে নদীর পানি ২৪ ঘণ্টায় ৪০ সেন্টিমিটার বেড়ে বিপৎসীমার ৭০ সেন্টিমিটার নিচ প্রবাহিত হচ্ছে (বিপৎসীমা ১৪ দশমিক ৮০ মিটার)। মঙ্গলবারও ৪০ সেন্টিমিটার বেড়েছে। আর দুদিনে বেড়েছে ৮০ সেন্টিমিটার।
সিরাজগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সূত্র জানায়, গত মাসের ৩ জুন থেকে অস্বাভাবিকভাবে পানি বাড়তে থাকে যমুনায়। এক সপ্তাহ পরই পানি কমতে শুরু করে। এরপর ১৮ জুন থেকে ফের বাড়তে থাকে যমুনার পানি। টানা পাঁচদিন বাড়তে থাকার পর ২২ জুন থেকে পানি কমতে শুরু করে। ২৭ জুন স্থিতিশীল থাকার পর ২৮ জুন আবারও পানি বেড়েছে। ২৯ জুন আবার স্থিতিশীল হয়ে ৩০ জন সামান্য কিছুটা কমে যমুনার পানি। ১ জুলাই থেকে আবারও পানি বাড়তে থাকে।
সিরাজগঞ্জ পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মাহবুবুর রহমান বলেন, 'আগামী তিন-চারদিন যমুনার পানি দ্রম্নত বেড়ে বিপৎসীমা অতিক্রম করতে পারে। এতে স্বল্পমেয়াদি বন্যা পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনাও রয়েছে।'
স্টাফ রিপোর্টার, টাঙ্গাইল জানান, বৃষ্টিপাত ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে টাঙ্গাইল জেলার ওপর দিয়ে প্রবাহিত সব নদীর পানি আবার দ্রম্নতগতিতে বাড়ছে। টাঙ্গাইল পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্র জানায়, গত ২৪ ঘণ্টায় যমুনা নদীর পানি পোড়াবাড়ী পয়েন্টে ৪০ সেন্টিমিটার, ঝিনাই নদীর (নিউ ধলেশ্বরী) পানি জোকারচর পয়েন্টে ৩৯ সেন্টিমিটার, ধলেশ্বরী নদীর পানি এলাসিন পয়েন্টে ৩৬ সেন্টিমিটার, ফটিকজানি নদীর পানি নলছোপা ব্রিজ পয়েন্টে ২২ সেন্টিমিটার, বংশাই নদীর পানি কাউলজানী পয়েন্টে ১০ সেন্টিমিটার, মির্জাপুর পয়েন্টে ১১ সেন্টিমিটার এবং মধুপুর পয়েন্টে ৪০ সেন্টিমিটার বেড়েছে। এর মধ্যে ঝিনাই নদীর (নিউ ধলেশ্বরী) পানি বিপৎসীমার মাত্র ৭ সেন্টিমিটার এবং যমুনা নদীর পানি ৬৫ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
ঝিনাইগাতীতে হাজারও মানুষ পানিবন্দি
শেরপুর প্রতিনিধি জানান, মহারশি নদী পস্নাবিত হয়ে ঝিনাইগাতী উপজেলায় হাজারও মানুষ পানিতে বন্দি হয়ে পড়েছেন। ঝিনাইগাতী সদর বাজারে গরুহাটি ও ভূমি অফিসের পেছন থেকে বন্যার পানি ঢুকে করে গোটা বাজার পস্নাবিত হয়েছে। মসজিদ রোড, ধানহাটি, চালহাটি মধ্যবাজারের ব্যবসায়ীদের দোকানে বন্যার পানি প্রবেশ করে অনেক মালামালের ক্ষতি সাধিত হয়েছে। পানিবন্দি মানুষ অসহায় জীবনযাপন করছে।
জেলা প্রশাসনের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী ঝিরাইগাতী উপজেলার ৭টি ইউনিয়নের মধ্যে ৪টি ইউনিয়ন পস্নাবিত হয়েছে। বন্যাকবলিত এলাকায় পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট, খাবার স্যালাইন ও প্রাথমিক চিকিৎসার ওষুধ বিতরণ করা হয়েছে।
নেত্রকোনার ৫৯ বিদ্যালয়ে পানি
এদিকে নেত্রকোনার প্রধান নদী উব্ধাখালীর পানি এখনো বিপৎসীমার ওপর দিয়ে বইছে। এতে কলমাকান্দা উপজেলার আটটি ইউনিয়েনের নিম্নাঞ্চল পস্নাবিত হয়েছে। এর মধ্যে সদর, পোগলা, বড়খাপন ও কৈলাটি ইউনিয়েনের নিম্নাঞ্চল বেশি পস্নাবিত হওয়ায় সেখানকার মানুষের বাড়ি-ঘরেও পানি ঢুকেছে।
কলমাকান্দা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আসাদুজ্জামান বলেন, 'বন্যার অবনতি হলে তা মোকাবিলায় সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়েছে প্রশাসন।'
জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মিজানুর রহমান খান বলেন, '৫৯টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রাঙ্গণে বন্যার পানি প্রবেশ করায় লেখাপড়া কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। কোথাও সামান্য কয়েকজন শিক্ষার্থী বিদ্যালয়ে আসতে পেরেছে। এমনও বিদ্যালয় রয়েছে সেখানে কোনো শিক্ষার্থীই যায়নি। বিশেষ করে ভারী বৃষ্টির মধ্যে বিদ্যালয়গুলোয় এ অবস্থা চলছে।'
বুধবার সকাল থেকে বেলা ১২টা পর্যন্ত জেলার সোমেশ্বরী নদীর পানি কিছুটা কমতির দিকে। উব্ধাখালী আর কংশের পানি স্থিতিশীল রয়েছে। কিছুটা বেড়েছে ধনু নদীর পানি।
জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. সারোয়ার জাহান বলেন, 'উব্ধাখালী নদীর পানি কলমাকান্দা পয়েন্টে বিপৎসীমার ৫৩ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে বইছে। আর কংশ নদের পানি জারিয়া পয়েন্টে বিপৎসীমার ৭৫ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। হাওড়ের মাঝ দিয়ে বয়ে যাওয়া ধনু নদের পানি খালিয়াজুরী পয়েন্টে বেড়ে বিপৎসীমার ২১ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে বইছে।'
এদিকে বন্যার পানিতে গ্রামীণ সংযোগ সড়কগুলো তলিয়ে যাওয়ায় চলাচলে দুর্ভোগ বেড়েছে। গোখাদ্য নিয়ে কৃষকরা বিপাকে পড়েছেন। কোথাও কোথাও বিশুদ্ধ পানি ও খাবারের সংকট দেখা দিয়েছে।
অনিশ্চয়তায় এইচএসসি পরীক্ষার্থীরা
রাঙামাটির তথ্য অনুযায়ী, বাঘাইছড়ি উপজেলায় কাচালং সরকারি ডিগ্রি কলেজ বন্যার পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় চলমান এইচএসসি ও স্নাতক দ্বিতীয়বর্ষের পরীক্ষার্থীরা অনিশ্চয়তায় পড়েছেন। মঙ্গলবার রাতেই উপজেলা সদরের বিস্তীর্ণ এলাকা পানিতে ডুবে যায়। এতে ওই কলেজ ক্যাম্পাস প্রায় ৩ থেকে ৫ ফুট পানি ওঠে নিচতলার শ্রেণিকক্ষ, মাঠ, অধ্যক্ষের বাসভবনসহ পুরো ক্যাম্পাস পানির নিচে চলে গেছে।
বুধবার আড়াইটায় স্নাতক দ্বিতীয়বর্ষের ইতিহাস পরীক্ষার জন্য পরীক্ষার্থীরা কোমর পানিতে ভিজে ভিজে কলেজের দোতলায় এসে পরীক্ষায় অংশ নিয়েছেন। অনেককেই নৌকা করে কলেজ ক্যাম্পাসে প্রবেশ করে সরাসরি দোতলায় যেতে দেখা গেছে। এই উপজেলায় দুটি পরীক্ষাকেন্দ্র, যার আরেকটি দুর্গম সিজক কলেজ। যেটি কাচালং কলেজ থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার দূরে।
এদিকে, আজ বৃহস্পতিবার উচ্চ মাধ্যমিক (এইচএসসি) ইংরেজি প্রথম পত্রের পরীক্ষায় পরীক্ষার্থীরা কীভাবে অংশ নেবে তা বুঝতে পারছেন না কলেজ কর্তৃপক্ষ।
বিষয়টি চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডকে ই-মেইলের মাধ্যমে জানানো হয়েছে জানিয়ে অধ্যক্ষ নজরুল ইসলাম বলেন, 'পুরো উপজেলার বিস্তীর্ণ এলাকা রোববার থেকেই পানির নিচে। কিন্তু মঙ্গলবার রাতে পুরো কলেজ ক্যাম্পাসই পানিতে তলিয়ে গেছে। যেহেতু রাতে আর কিছুই করার ছিল না, তাই বুধবার পূর্বনির্ধারিত স্নাতক পরীক্ষায় শিক্ষার্থী কম থাকায় কোনোভাবে দোতলায় চালিয়ে নিলেও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা কোনোভাবেই সম্ভব হবে না, যদি না পানি কমে।'
তিনি বলেন, 'বিষয়টি আমরা বোর্ডকে জানিয়েছি। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও জেলা প্রশাসককে অবহিত করে তাদের মাধ্যমে বোর্ডকে জানানোর জন্য আমাকে বলা হয়েছে, আমিও সেটাই করেছি। এখনও কোনো পরবর্তী নির্দেশনা পাইনি।'
চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক অধ্যাপক এএনএম মজিবুর রহমান বলেন, 'পরীক্ষা সংক্রান্ত আমাদের একটি কমন নির্দেশনা এর মধ্যেই সবাইকে দেওয়া হয়েছে। যদি কোথাও পানি ওঠে এবং বন্যার কারণে ঝামেলা হয়, সেখানে পরীক্ষা ১ ঘণ্টা পরে বা তারও বেশি সময় পরে শুরু করে সময় সমন্বয় করে নিতে হবে। এ ছাড়া আমাদের পরীক্ষা পরিচালনায় স্থানীয়ভাবে একজন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা থাকেন এবং জেলা প্রশাসক বিষয়গুলো দেখেন। কাচালং কলেজে এমন পরিস্থিতি হয়েছে, সেটা তারা কেউ আমাকে এখনো জানান নাই। তারা যদি জানান, সেই ক্ষেত্রে আমরা পৃথক নির্দেশনা দিতে পারব।'
৩ হাজার পরিবার পানিবন্দি
গত তিনদিনে ফেনীর মুহুরী নদীর বেড়িবাঁধের ছয়টি স্থান ভেঙেছে। ভাঙা স্থান দিয়ে হু-হু করে লোকালয়ে ঢুকছে পানি। এরই মধ্যে ফুলগাজী ও পরশুরাম উপজেলার পাঁচটি ইউনিয়নের তিন হাজার একশ পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। পানিতে তলিয়ে গেছে বাড়ি-ঘর; ভেসে গেছে পুকুর ও ঘেরের মাছ। নষ্ট হচ্চে বীজতলা ও সবজি।
ফেনীর পানি উন্নয়ন বোর্ডের বিভাগীয় প্রকৌশলী মো. আবুল কাশেম জানান, মুহুরী নদীর পানি বুধবার সকালে বিপৎসীমার ১৬ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। বেড়িবাঁধের কয়েকটি স্থান ঝুঁকিপূর্ণ থাকায় বালুর বস্তা ফেলা হচ্ছে। বৃষ্টি না হলে নতুন করে আর ভাঙার সম্ভাবনা নেই।
পরশুরামের ইউএনও জানান, মুহুরী নদীর বন্যা নিয়ন্ত্রণের বাঁধের দক্ষিণ শালধর এলাকার জহির চেয়ারম্যানের বাড়িসংলগ্ন একটি অংশে ভাঙনের সৃষ্টি হয়। এতে দক্ষিণ শালধর, মালিপাথর, ঘোষাইপুর এবং পাগলিরকুল এলাকা পস্নাবিত হয়েছে। এ উপজেলায় ১ হাজার ৪০০ পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে শুকনো খাবার বিতরণ করা হচ্ছে বলে জানান তিনি।
ফেনী পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী রাশেদ শাহরিয়ার বলেন, 'মুহুরী নদীর পানি বুধবার বিপৎসীমার নিচে দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ভাঙন স্থান দিয়ে লোকালয়ে পানি ঢুকছে। নদীর পানি কমলে ভাঙন এলাকা মেরামত করা হবে।'
কুড়িগ্রামে হাজারও মানুষ পানিবন্দি
কুড়িগ্রামে ব্রহ্মপুত্র নদের পানি বেড়ে বিপৎসীমা অতিক্রম করেছে। বুধবার সকাল ৯টায় চিলমারী ও নুনখাওয়া পয়েন্টে এই নদের পানি বিপৎসীমার যথাক্রমে ৯ ও ১৪ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। অব্যাহত পানি বৃদ্ধির ফলে এর অববাহিকার নিম্নাঞ্চল পস্নাবিত হয়ে কয়েকটি উপজেলার হাজারও মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। পাশাপাশি বাড়ছে ধরলা ও দুধকুমার নদের পানি। এ অবস্থায় জেলার নিম্নাঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র জানিয়েছে, ব্রহ্মপুত্রে অব্যাহত পানি বৃদ্ধির ফলে এর নিম্নাঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। পানিবন্দি হয়ে পড়েছে হাজারও মানুষ। উলিপুরের বেগমগঞ্জ ইউনিয়নের চর বালাডোবা, বতুয়াতলী মূসার চর, ব্যাপারীপাড়া নতুন চর এবং পূর্ব ও পশ্চিম মশালের চরের শতাধিক পরিবারের ঘরবাড়িতে পানি প্রবেশ করেছে। বাধ্য হয়ে এসব পরিবারের অনেকে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে নৌকায় আশ্রয় নিয়েছেন। বসতভিটা পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় নৌকাতেই রান্না ও খাবার সেরে নিচ্ছেন। তবে শৌচাগার নিয়ে বিপাকে পড়েছেন পানিবন্দি মানুষজন।
বতুয়াতলি মূসার চরের বাসিন্দা শরিফুল বলেন, 'আমাদের গ্রামে ৪০টিরও বেশি পরিবারের বসবাস। সবকটি পরিবারের ঘরের ভেতর পানি। বাইরে চারপাশে পানি। পানি বাড়ছে।'
উলিপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. আতাউর রহমান বলেন, 'বন্যা পরিস্থিতিতে পানিবন্দি পরিবারে খাদ্য সহায়তা দেওয়া জন্য পর্যাপ্ত প্রস্তুতি রয়েছে। এ ছাড়া দুর্গত পরিবারের সদস্যদের নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়েছে।'