প্রকাশ্যে মাছ শিকার ও বিকিকিনি নিয়ে কোটি টাকার বাণিজ্য!

পটুয়াখালীতে সরকারি নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষিত

প্রকাশ | ৩০ জুন ২০২৪, ০০:০০

আব্দুস সালাম আরিফ, পটুয়াখালী
নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে বঙ্গোপসাগর থেকে মাছ ধরে বাজারে চলছে বেচাকেনা -যাযাদি
বঙ্গোপসাগরে সব ধরনের মাছ শিকারে ৬৫ দিনের সরকারি নিষেধাজ্ঞা জারি করা হলেও পটুয়াখালী সংলগ্ন সাগরের চিত্র একেবারের ভিন্ন। জেলার উপকূলজুড়ে প্রকাশ্যেই চলছে মাছ শিকার। অভিযোগ উঠেছে, মৎস্য বিভাগসহ সংশ্লিষ্টদের ম্যানেজ করেই সমুদ্রসংলগ্ন বাজারগুলোয় প্রকাশে চলছে সামুদ্রিক মাছের বিকিকিনি। আর এজন্য জেলেদের গুনতে হচ্ছে মোটা অঙ্কের অর্থ। এতে সাগরে মাছের উৎপাদন ও মজুত বৃদ্ধিতে সরকারি নিষেধাজ্ঞা কাগজে-কলমেই সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। পটুয়াখালী-কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকতসংলগ্ন কুয়াকাটা পৌরভবনের বিপরীতে অবস্থিত কুয়াকাটার প্রধান মাছ বাজার, যা স্থানীয়ভাবে মেয়র বাজার নামে পরিচিতি। এ বাজারে সাগর থেকে শিকার করা বিভিন্ন প্রজাতির মাছ ডাকের মাধ্যমে পাইকারি বিক্রি হয়। গত ২৬ জুন এবং ২৭ জুন এই মার্কেট ও আশপাশের এলাকা ঘুরে দেখা যায়, সরকারি নিষেধাজ্ঞার মধ্যেও সকাল থেকেই ভ্যান-অটোরিকশায় ককশিট আর পস্নাস্টিকের ড্রামভর্তি করে আসতে থাকে বিভিন্ন প্রজাতির সামুদ্রিক মাছ। এর মধ্যে লইট্যা এবং তুলার ডাডি মাছই বেশি। এ ছাড়া রূপচাঁদা, বৈরাগী, কোড়াল, রামসোসসহ অন্য মাছও দেখা যায়। ইলিশ মাছ তুলনামূলক কম। মাছ বাজারে ঢুকতেই বিভিন্ন পাইকারি দোকানে মাছের ডাক হতে দেখা যায়। পাইকাররা দাম বলে তা কিনে নিচ্ছেন। এ বাজারে সকাল থেকে রাত ৯-১০টা পর্যন্ত নিয়মিত মাছ বিক্রি হলেও দুপুরের পর থেকে মাছগুলো রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় পাঠানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়। ককশিটে বরফ দিয়ে পেটি প্রস্তুতের পর ট্রাক এবং বাসে পাঠানো হয় মাছের পেটিগুলো। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মাছ শিকারে নিষেধাজ্ঞা চলাকালে মাছ ধরা, বিক্রি ও পরিবহণ প্রক্রিয়া নিরাপদ করতে নির্দিষ্ট একটি চক্রকে দিতে হয় কোটি টাকা। জেলে, মাছ ব্যবসায়ী ও আড়তদারদের গুনতে হয় এ বিপুল পরিমাণ অর্থ। কুয়াকাটা মেয়র বাজারের মাছ ব্যবসায়ী মো. নূর জামাল গাজী এ প্রক্রিয়া সমন্বয় করেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এ ব্যবসায়ীর মালিকানাধীন মেসার্স গাজী ফিশ থেকে এসব নিয়ন্ত্রণ করা হয়। এবার প্রতিটি ট্রলার থেকে প্রতি ট্রিপে ৫ হাজার থেকে ১০ হাজার টাকা করে নিচ্ছেন তিনি। পাশাপাশি প্রশাসন, মৎস্য বিভাগ, নৌপুলিশ ও কোস্টগার্ড সদস্যদের ম্যানেজ করার দায়িত্বও রয়েছে তার। এ বিষয় জানতে চাইলে অভিযুক্ত মো. নূর জামাল গাজী বলেন, 'কাউকে কোনো টাকা দিই না, চুরি করে মাছ ধরি, চুরি করে মাছ বেচি।' তবে নিজের কাছে সাংবাদিকসহ সবার তালিকা থাকার কথা স্বীকার করেন তিনি। বিস্ময়কর হলেও সত্য, কুয়াকাটার মতো একটি পর্যটন এলাকায় যখন প্রকাশ্যে মাছ শিকার ও বিক্রি চলছে তখনও পুরো বিষয়টি উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তার কাছে অজানা। এ বিষয়ে জানতে চাইলে কলাপাড়া উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা অপু সাহা বলেন, 'সার্র্বক্ষণিক তো আমাদের পক্ষে পাহারা দেওয়া সম্ভব নয়। সাগরে কোস্টগার্ড আছে, নৌপুলিশ আছে, নৌবাহিনীর সদস্যরা আছেন। সবাই আমরা কাজ করছি। এরপরও গত কয়েকদিন আবহাওয়া কিছুটা খারাপ এ কারণে হয়তো এমনটি হয়েছে। আমি আজ আবারও বিষয়টি দেখছি।' তবে মৎস্য বিভাগের সঙ্গে মাছ ব্যবসায়ী নূর জামালের কোনো যোগাযোগ নেই এবং তাকে তিনি ব্যক্তিগতভাবে চেনেন না বলে জানান এই কর্মকর্তা। এদিকে এসব বিষয়ে নিজের দপ্তরের জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করে জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. কামরুল ইসলাম বলেন, 'অভিযান সফল করতে আমরা আরও সক্রিয়ভাবে কাজ করব।' খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ইলিশের প্রজনন মৌসুম, জাটকা সংরক্ষণ, সাগরে ৬৫ দিন মাছ শিকার বন্ধসহ সরকারের নিষেধাজ্ঞা থাকাকালে নির্বিঘ্নে মাছ শিকার, বিক্রি ও পরিবহণ করতে কলাপাড়া উপজেলায় গড়ে উঠেছে একটি শক্তিশালী চক্র। প্রতি মৌসুমে জেলে ও মৎস্য ব্যসায়ীদের কাছ থেকে সব পক্ষকে ম্যানেজ করতে প্রায় সাড়ে তিন কোটি টাকা চাঁদা তোলা হয় বলে একাধিক সূত্র নাম প্রকাশ না করার শর্তে অভিযোগ করেছেন। এ প্রসঙ্গে কুয়াকাটা নৌ-পুলিশের অফিসার ইনচার্জ দেলোয়ার হোসেন বলেন, '৬৫ দিনের নিষেধাজ্ঞায় নৌ-পুলিশের কোনো কাজ নেই। সাগরে মাছ ধরা বন্ধে কোস্টগার্ড কাজ করবে, আর মাছ বিক্রি কিংবা পরিবহণে মৎস্য বিভাগ অভিযান পরিচালনা করবে, এটা তাদের দায়িত্ব।' জানতে চাইলে নিজামপুর কোস্টগার্ড স্টেশন থেকে জানানো হয়, '৬৫ দিনের অবরোধ কর্মসূচি সফল করতে তারা নিয়মিত সচেতন করার পাশপাশি সাগরে অভিযান পরিচালনা করছেন। আর নিয়মিত মাছ ধরা ও বিক্রির বিষয়ে তাদের কাছে তথ্য নেই।'