সেদিন ছিল শুক্রবার রাত। পুলিশের চারজন সদস্য অভিযান চালান রিফাত সরদারের (ছদ্মনাম) বাড়িতে।
বাসায় অবৈধ মালামাল আছে- এমন অভিযোগের কথা জানায় পুলিশ। এরপর রিফাতের হাতে হ্যান্ডকাফ লাগিয়ে শুরু হয় তলস্নাশি।
রিফাত সরদার জানাচ্ছেন, তলস্নাশির একপর্যায়ে বাড়িতে থাকা স্বর্ণালংকার, নগদ অর্থসহ প্রায় ৩২ লাখ টাকার সম্পদ 'নিয়ে নেন' অভিযানে আসা সদস্যরা।
'আমি বললাম, আমার বাসায় যদি অবৈধ মালামাল থাকে, তাহলে দেখান। আমাকে সার্চ ওয়ারেন্ট দেন। কিন্তু তারা জবাব না দিয়ে আমাকে চড়-থাপ্পড় মারতে থাকে। এরপর চোখ বেঁধে হাতকড়া পরিয়ে থানায় নিয়ে যায়। থানায় এনে আবারও মুক্তিপণের জন্য নির্যাতন শুরু করে। আমি বললাম, আমার তো প্রায় ৩২ লাখ টাকার সম্পদ আপনারা নিয়ে নিয়েছেন। আমার তো আর কিছু নেই। তখন বলে যে, ছাড়া পেতে হলে আরও পাঁচ লাখ টাকা দিতে হবে,' বলছিলেন রিফাত সরদার।
তিনি জানান, শেষ পর্যন্ত আরও দুই লাখ টাকা দিয়ে থানা থেকে ছাড়া পেয়েছিলেন। যদিও তার বিরুদ্ধে কোনো মামলা, এমনকি কোনো অভিযোগও করা হয়নি থানায়।
'আমি বলেছিলাম, আমি অপরাধ করে থাকলে আদালতে সোপর্দ করেন। তো বলল যে, আমাকে একদম উপরের আদালতে পাঠিয়ে দেবে, ক্রসফায়ারে দিয়ে মেরে ফেলবে। তারা যা নিয়েছে, সেসব যেন কাউকে কিছু না বলি। এভাবেই তারা আমার স্বর্ণ এবং টাকা আত্মসাৎ করে। তবে এটা ঠিক, টাকা গেলেও আমি প্রাণে বেঁচে ফিরতে পেরেছি।'
রিফাত সরদার পুলিশের কয়েকজনের বিরুদ্ধে যেভাবে ভয় দেখিয়ে, নির্যাতন করে টাকা আদায়ের অভিযোগ তুলছেন, বাংলাদেশে এমনটা মাঝে মাঝেই শোনা যায়।
এখানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কারও কারও দুর্নীতি নিয়ে অভিযোগ নতুন নয়।
সাম্প্রতিক সময় সাবেক পুলিশপ্রধান বেনজীর আহমেদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠার পর বিষয়টি নিয়ে আলোচনা-বিতর্ক আরও জোরালো হয়েছে।
বিশেষ করে যে ব্যাপক মাত্রায় দুর্নীতির অভিযোগ আসছে, এতে বিস্মিত হয়েছেন অনেকেই।
প্রশ্ন হচ্ছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভেতর থেকে অবৈধভাবে এত বিপুল অর্থসম্পদ বানানোর সুযোগ কীভাবে তৈরি হচ্ছে? আর এই দুর্নীতির উৎসগুলোই বা কী?
কোন কোন খাতে দুর্নীতি হয়?
রিপোর্টের শুরুতেই রিফাত সরদারের যে অভিজ্ঞতা, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দুর্নীতির এমন অভিযোগ বিভিন্ন সময়ই এসেছে বিভিন্ন গণমাধ্যমে।
তবে দেশটিতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কেউ কেউ যে শুধু এভাবেই দুর্নীতি করছেন, তা নয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে দুর্নীতি এখন অনেকটাই ওপেন সিক্রেট। সে রকমই একটি পরিবহণ খাত।
যদিও এসব বিষয় নিয়ে প্রকাশ্যে মুখ খুলতে চান না কেউই। ঢাকার একজন রেন্ট এ কারের ড্রাইভার আবুল হোসেন (ছদ্মনাম) বলছেন, তার ভাষায়, ট্রাফিক পুলিশকে টাকা না দিয়ে সড়কে গাড়ি চলাচল একরকম অসম্ভব।
'তিনি বলেন, ধরেন আমি
কোনো ব্যস্ত রাস্তায় পার্কিং করলাম বা আইন মানলাম না, তখন যদি ট্রাফিক পুলিশ দেখে, তাহলে ধরবেই। কেউ কেউ আছে মামলা করে। আবার কেউ কেউ আছে টাকা নিয়ে ছেড়ে দেয়। সমস্যা বেশি হয়, যখন আমরা ট্রিপ নিয়ে অন্য জেলায় যাই। যদি পুলিশের সঙ্গে আপনার মান্থলি (মাসিক চাঁদা) করা থাকে, তাহলে কোনো সার্জেন্ট ধরবে না। আর যদি সেটা না থাকে, তাহলে ধরা পড়লেই হয় মামলা না হয় আপনার গাড়ি রিকুইজিশন করবে। তখন টাকা ছাড়া কোনো উপায় নাই।'
কিন্তু বাংলাদেশে আইনশৃঙ্খলা রক্ষকারী বাহিনীর মধ্যে দুর্নীতির ব্যাপকতা কতটা? এ ক্ষেত্রে দুর্নীতিবিরোধী আন্তর্জাতিক সংস্থা টিআইবি সেবা খাতে দুর্নীতি নিয়ে যে জরিপ করেছে, সেখানে সবচেয়ে বেশি দুর্নীতির অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিরুদ্ধে।
সংস্থাটির ২০২২ সালে প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেখা যায়, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে সেবা নিতে গিয়ে দুর্নীতির শিকার হয়েছে ৭৪.৪ শতাংশ খানা।
এরপরের অবস্থানে আছে পাসপোর্ট বিভাগ (৭০.৫ শতাংশ) এবং বিআরটিএ (৬৮.৩ শতাংশ)।
টিআইবির জরিপ অনুযায়ী, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে সেবাগ্রহণ করতে গিয়ে যারা দুর্নীতির শিকার হয়েছেন, সেখানে আর্থিক দুর্নীতির হার ৫৫ শতাংশের বেশি। যেটা হয়েছে মূলত ঘুষের মাধ্যমে এবং জোর করে বা ভয় দেখিয়ে টাকা আদায়ের মাধ্যমে।
কিন্তু এভাবে দুর্নীতি করে টাকা আদায় কোন ক্ষেত্রে বেশি?
এ ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, সবচেয়ে বেশি দুর্নীতি হচ্ছে, আসামি গ্রেপ্তারের সময়। যার হার ৯২.৮ শতাংশ।
এরপরই আছে ট্রাফিক-সংক্রান্ত বিষয়, পুলিশ ভেরিফিকেশন কিংবা মামলা দায়েরের মতো খাতগুলো। এ ছাড়া তদন্তের সময়ও ঘুষ লেনদেন হয় বলে জরিপে মত দিয়েছেন অংশগ্রহণকারীরা।
এত বিপুল অর্থ অর্জন সম্ভব?
বাংলাদেশে সাম্প্রতিককালে পুলিশের দুর্নীতির বিষয়টি ব্যাপকভাবে আলোচিত হচ্ছে মূলত সাবেক পুলিশপ্রধান বেনজীর আহমেদের জ্ঞাত আয়বহির্ভূত বিপুল পরিমাণ সম্পত্তির খোঁজ পাওয়ার পর। তবে এর বাইরেও পুলিশের আরও কিছু কর্মকর্তার বিরুদ্ধেও গণমাধ্যমে বিভিন্ন সময় খবর প্রকাশিত হয়েছে। যেখানে বিপুল দুর্নীতির অভিযোগ স্পষ্ট।
এসব খবরে যে বিপুল পরিমাণে অর্থ-সম্পদ অর্জনের অভিযোগ এবং দুর্নীতির ব্যাপকতা, সেটি বিস্মিত করেছে অনেককেই।
কিন্তু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভেতর থেকে দুর্নীতি করে এত বিপুল সম্পদ অর্জনের সুযোগ কীভাবে তৈরি হচ্ছে, তা একটি বড় প্রশ্ন। ট্রাফিকের চাঁদা আদায়, মামলা দায়েরে ঘুষ গ্রহণ কিংবা তদন্তের সময় অর্থ লেনদেন- এসবের মাধ্যমে এত বিপুল অর্থসম্পদ অর্জন করা আপাতদৃষ্টিতে সম্ভব নয় বলেই মনে করেন অনেকে।
তাহলে এত সম্পদ কীভাবে অর্জিত হচ্ছে- এমন প্রশ্নে সামনে আসছে বাহিনীর অভ্যন্তরীণ কেনাকাটা, উন্নয়ন কর্মকান্ডসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে দুর্নীতির কথা।
সম্প্রতি র?্যাবের কেনাকাটায় প্রকৃত মূল্যের চেয়ে তিনশত গুণ বেশি দামে সাঁজোয়া যান কেনা হয়েছে বলে খবর প্রকাশ করেছে একটি জাতীয় দৈনিক।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ টিআইবির নির্বাহী পরিচালক বলছেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভেতর বড় বড় দুর্নীতির অভিযোগ আসছে বিশেষত সেবা খাতের বাইরে।
তিনি বলেন, 'বড় ধরনের ঘুষ লেনদেনের তথ্য পাওয়া যায় কেনাকাটায়। যেখানে কেনাকাটা ছাড়াও বিভিন্ন ধরনের অবকাঠামো নির্মাণ, ডিজিটাইজেশন কার্যক্রম ইত্যাদিতে যে অর্থ ব্যয় হয়, এর একটি অংশ ক্ষমতার অপব্যবহার করে আত্মসাৎ করা হয়।'
'এর পাশাপাশি পুলিশে যে রিক্রুটমেন্ট, প্রমোশন, পোস্টিং, ট্রান্সফার হয়, সেখানে বড় ধরনের অর্থ লেনদেন হয়। এ ছাড়া আমাদের জেলখানায় অনিয়মের অভিযোগ আছে। আমাদের বর্ডারে যেসব ক্রাইম হয়, যেমন মানব পাচার, চোরাচালান সেগুলোতে কোনো না কোনোভাবে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার সংশ্লিষ্টতা থাকে।'
ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, মূলত আইনি ক্ষমতার সঙ্গে সঙ্গে রাজনীতির যোগসাজশে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অনেকের মধ্যে একটা ক্ষমতার বোধ তৈরি হয়েছে, তাদের কেউ কেউ নিজেকে ধরাছোঁয়ার বাইরে মনে করছেন। যেটা বিপুল দুর্নীতির পথ করে দিচ্ছে।
দুর্নীতি রুখবে কে?
কিন্তু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভেতর কেউ যেন দুর্নীতিতে জড়িয়ে না পড়ে সেটা দেখার জন্য দেশে কী ব্যবস্থা আছে? জানতে চাইলে পুলিশ সদর দপ্তরের মুখপাত্র অবশ্য বিবিসি বাংলাকে জানাচ্ছেন, এসব ক্ষেত্রে পুলিশের নিজস্ব নজরদারি ব্যবস্থা আছে।
পুলিশ সদর দপ্তরে এআইজি (মিডিয়া) ইনামুল হক সাগর বলেন, মনিটরিংয়ে কারও দুর্নীতি ধরা পড়লে, সেটা তদন্ত হয়। অথবা কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ এলে সেটা তদন্তসাপেক্ষে ব্যবস্থা নেওয়া হয়।
তিনি বলেন, 'পুলিশ বাহিনীর কোনো সদস্যের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ প্রমাণিত হলে তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণের পাশাপাশি আইনি ব্যবস্থাও গ্রহণ করা হয়ে থাকে। এ ক্ষেত্রে পুলিশের অবস্থান জিরো টলারেন্স।'
তবে বাস্তবে পুলিশের ভেতরের নিজস্ব মনিটরিং ব্যবস্থা যে দুর্নীতি ঠেকাতে খুব একটা কাজ করছে না, সেটা স্পষ্ট। কারণ, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিভিন্ন স্তরের সদস্যের বিরুদ্ধে একের পর এক দুর্নীতির অভিযোগ বিভিন্ন সময়ই উঠছে।
অন্যদিকে, এসব ঘটনায় স্বাধীন সংস্থার মাধ্যমে নজরদারির কোনো কার্যকর ব্যবস্থাও গড়ে ওঠেনি।
দুর্নীতি দমন কমিশন বা দুদকের কার্যক্রম থাকলেও প্রতিষ্ঠানটির দুর্বলতা এবং সীমাবদ্ধতা স্পষ্ট।
যদিও অনেকেই মনে করেন, বিদ্যমান আইনি কাঠামো এবং ব্যবস্থা দিয়েও দুর্নীতির রাশ টানা সম্ভব।
ইফতেখারুজ্জামান বলেন, 'আমাদের এখানে প্রতিষ্ঠান আছে। দুদক আছে। মন্ত্রণালয়গুলোতে নিজস্ব মনিটরিং সেল আছে। কিন্তু এগুলো অনেকটা কাগজ-কলমে। বাস্তবে অভ্যন্তরীণ এসব ব্যবস্থা ঠিকভাবে কাজ করতে পারে না। আমাদের রাষ্ট্রকাঠামোর সক্ষমতা আছে। কিন্তু সেটির প্রয়োগের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় সমস্যা। এখানে রাজনৈতিক সদিচ্ছার ঘাটতি আছে এবং প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর যে দায়িত্ব অর্পিত হয়েছে, সেটা নিরপেক্ষভাবে, আইনের চোখে সবাই সমান- এই মানদন্ডে কাজ করার মতো পরিবেশটা তৈরি হয়নি এখনো। অথবা যতটুকু পরিবেশ ছিল সেটাও নষ্ট হয়েছে।'
টিআইবির এই নির্বাহী পরিচালক জোর দিচ্ছেন, রাজনৈতিক সদিচ্ছার ওপর। কিন্তু বাংলাদেশে দুর্নীতির যে দীর্ঘ ইতিহাস, সেখানে রাজনৈতিক স্বার্থেই দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেওয়ার নজির কম নয়।
ফলে এখানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মতো প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে শেষ পর্যন্ত দুর্নীতির মূলোৎপাটন কতটা হবে, তা নিয়ে সংশয় থেকেই যায়।