রাজশাহীর বাঘায় দলিল লেখক সমিতির কমিটি নিয়ে বিরোধের জেরে দুই পক্ষের সংঘর্ষে খুন হয়েছেন আওয়ামী লীগ নেতা আশরাফুল ইসলাম। সংঘর্ষে আহত হয়ে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় বুধবার বিকালে তিনি মারা যান। তার মাথায় ধারালো অস্ত্রের কোপ ছিল।
বাঘা সাবরেজিস্ট্রি অফিসের দলিল লেখক সমিতির কমিটি নিয়ে চলতি মাসে দুই দফা সংঘর্ষে অন্তত ৪৫ জন আহত হন। সবশেষ ২২ জুন উপজেলা আওয়ামী লীগের দুই পক্ষের সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষে অন্তত ৩০ নেতাকর্মী আহত হন। সংঘর্ষের একপর্যায়ে গুরুতর আহত অবস্থায় আশরাফুল ইসলাম বাবুলকে উদ্ধার করা হয়। তিনি বাঘা উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন।
জানা যায়, আগে নির্বাচনের মাধ্যমে দলিল লেখক সমিতির কমিটি গঠন করা হতো। তবে ২০১৯ সাল থেকে স্থানীয় সংসদ সদস্য শাহরিয়ার আলম মৌখিকভাবে সমিতির কমিটি করে দিচ্ছেন। এখন পর্যন্ত চারটি কমিটি করে দিয়েছেন তিনি। দলীয় পদধারী নেতারাই এসব কমিটিতে নেতৃত্ব দিয়েছেন। যারা সবাই সংসদ সদস্যের অনুসারী হিসেবে পরিচিত।
সমিতির সাবেক সভাপতি জহুরুল হকসহ ৬৯ জন দলিল লেখক গত ১২ মে বর্তমান কমিটি বিলুপ্ত করার দাবি জানিয়ে জেলা প্রশাসকের কাছে আবেদন করেন। আবেদনে তারা উলেস্নখ করেন, দলিল লেখকদের বাধ্য করে অতিরিক্ত টাকা আদায় করছেন সমিতির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক। এতে জমি রেজিস্ট্রি কমে যাচ্ছে। রাষ্ট্র রাজস্ব হারাচ্ছে।
দলিল লেখকেরা জানিয়েছেন, সর্বশেষ ৭ জুন মৌখিকভাবে সমিতির নতুন কমিটি করে দেন এমপি শাহরিয়ার আলম। এতে সভাপতি হন উপজেলা যুবলীগের যুগ্ম সম্পাদক শাহিনুর রহমান এবং সাধারণ সম্পাদক হন পাকুড়িয়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের যুগ্ম আহ্বায়ক সামিউল আলম ওরফে নয়ন সরকার। এই কমিটি হওয়ার পর থেকেই দলিল লেখকদের মধ্যে ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, গত ১০ জুন সাবরেজিস্ট্রি অফিসে দলিল লেখক সমিতির দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ ও পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনায় অন্তত ১৫ জন আহত হন। পরে ২০ জুন দলিল লেখক সমিতির কমিটি বাতিলের দাবি জানিয়ে মানববন্ধন করেন উপজেলা চেয়ারম্যান লায়েব উদ্দিন ও পৌর মেয়র আক্কাস আলীর অনুসারীরা। এরপর ২২ জুন আবারও পাল্টাপাল্টি কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে এই পক্ষের সঙ্গে সংসদ সদস্য শাহরিয়ার আলমের পক্ষের লোকজনের সংঘর্ষ হয়।
সমিতির সাবেক নির্বাচিত সভাপতি জহুরুল ইসলাম বলেন, অনির্বাচিত কমিটি অনেক দিন ধরেই জুলুম করে আসছে। তাদের কারণে কোণঠাসা সাধারণ মানুষ।
বাঘা পৌরসভার ৬ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা মো. কুদ্দুস এক মাস আগে পৌর এলাকায় ১৮ কাঠা জমি কিনেছেন, তবে এখনো নিবন্ধন করতে পারেননি। মৌজা দর ২৫ হাজার টাকা কাঠা ধরে এই জমির দাম ৪ লাখ ৫০ হাজার টাকা। এ ধরনের জমি নিবন্ধনে সাড়ে ৯ শতাংশ ফি দিতে হয়। সেই হিসাবে ফি আসে ৮০ হাজার ৭৫০ টাকা। কিন্তু দলিল লেখক সমিতি বাড়তি ৪৭ হাজার ২৫০ টাকা দাবি করে।
মো. কুদ্দুসের মতো বাঘার অনেকেই এই অতিরিক্ত টাকা দাবির কারণে জমি কেনাবেচা করেও দলিল করতে পারছেন না। একটি দলিল রেজিস্ট্রিতে বৈধভাবে যে খরচ হওয়ার কথা, দলিল লেখক সমিতি তার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি অর্থ আদায় করছে বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে।
দলিল লেখক সমিতির নতুন সভাপতি শাহিনুর রহমান বলেন, 'আগের কমিটিগুলো দুর্নীতি করেছে। এ কারণেই নতুন কমিটি করে দিয়েছেন সংসদ সদস্য। জমি নিবন্ধন বাবদ জমির মূল্যের প্রতি এক লাখ টাকার বিপরীতে সমিতি পাঁচ হাজার টাকা নেয়। এর মধ্যে দলিল লেখক খরচও থাকে। অনেক সময় তদবিরে পাঁচ হাজার টাকার কমও নেওয়া হয়।'
আবদুর রহমান নামে এক দলিল লেখক (মুহুরি) বলেন, 'তার কাছে সাধারণত কাছের আত্মীয়স্বজনই জমি রেজিস্ট্রি করতে আসেন। তাদের কাছ থেকে তো আর বেশি টাকা নেওয়া যায় না; কিন্তু সমিতির চাপে কিছুই করার থাকে না। অনেক সময় নিজের নির্ধারিত ফি না নিয়ে উল্টো সমিতিতে পকেট থেকে টাকা দিতে হয়। এই সমিতির টাকা ভাগ-বাঁটোয়ারার ক্ষেত্রেও কোনো হিসাব নেই।'
১৯৯৪ সালে আইন ও বিচার বিভাগ থেকে এক প্রজ্ঞাপনে দলিল লিখতে পাতা প্রতি (৩০০ শব্দ) ১৫ টাকা হারে মুহুরি ফি নির্ধারিত ছিল। কিন্তু ২০১৪ সালে নতুন করে দলিল লেখক (সনদ) বিধিমালা-২০১৪ প্রকাশিত হয়। সেখানে ফির বিষয়ে উলেস্নখ নেই।
দলিল লেখকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ২০১৯ সাল থেকে অনির্বাচিত দলিল লেখক কমিটি গঠনের পর নেতারা মুহুরিদের প্রলোভন দেখান, প্রতিটি দলিল লেখার বিপরীতে লেখক কোনো সম্মানি নেবেন না। তিনি সমিতির নির্ধারিত ফি নিয়ে সমিতিতে জমা দেবেন। সমিতি দিনের শেষে দলিল লেখককে প্রতিটি দলিল লেখার বিপরীতে নগদ ২৫ শতাংশ বিল বুঝিয়ে দেবেন। বাকি টাকার একটি অংশ সমিতিতে জমা হবে। বাকি প্রাপ্য অংশ সমিতির নেতারা প্রতি সপ্তাহে ১৬৫ জন দলিল লেখকের মধ্যে বণ্টন করে দেবেন। কিন্তু সেই প্রতিশ্রম্নতি পূরণ করেননি সমিতির নেতারা। সম্মানির টাকা সেই থেকে আর নিয়মিত পাচ্ছেন না দলিল লেখকরা।'
বাঘার সাবরেজিস্ট্রার এন এ এম নকিবুল আলম বলেন, 'সরকার নির্ধারিত টাকা দিয়ে জমি নিবন্ধন করতে হয়। এ জন্য ব্যাংকে ট্রেজারির মাধ্যমে টাকা জমা দিতে হয়। এর বাইরে আর কোনো বাড়তি টাকা নেওয়া হয় না। এখন মুহুরি বা অন্যরা বাড়তি টাকা নিতে পারেন। বিষয়টি তার জানা নেই।'