ব্যালটে ভোট দেওয়ার রীতি থেকে বেরিয়ে যন্ত্রের ব্যবহার বাড়াতে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) কার্যক্রমকে এগিয়ে নেওয়ার চেষ্টা ধুঁকছে অনেকদিন থেকে; তবে এখনই হাল ছাড়তে চাইছে না নির্বাচন কমিশন। চলমান এ প্রকল্পের মেয়াদ আরও এক বছর বাড়াতে চায় সংস্থাটি।
এ সময়ের মধ্যে ইভিএম মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণে তৈরি করা হবে নিজস্ব জনবল; পাশাপাশি ঢাকায় কেন্দ্রীয়ভাবে ইভিএমসহ নির্বাচন সামগ্রী রাখার জন্য বিশেষ গুদামঘর করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।
নির্বাচন কমিশন সচিব শফিউল আজিম বলেছেন, ইভিএম প্রকল্পের মেয়াদ আরও এক বছর বাড়াতে পরিকল্পনা কমিশনে প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। সেই সঙ্গে ঢাকা জেলায় ইভিএমে মেরামত ও সংরক্ষণে একটা গুদাম করার পরিকল্পনা রয়েছে।
এ জন্য জেলা প্রশাসনের কাছে জমি চাওয়ার তথ্য দিয়ে তিনি বলেন, 'সেটা পেলে আমরা সংরক্ষণের জন্য এটিকে ওয়্যারহাউস হিসেবে ব্যবহার করব। সম্পূর্ণভাবে একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ ইউনিট হিসেবে তৈরি করব। এটি আমাদের পরিকল্পনার মধ্যে রয়েছে।'
২০১৮ সালে একাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে লাখো ইভিএমে কেনা হয় প্রকল্পের অধীনে। পাঁচ বছর মেয়াদের প্রকল্পটি শেষ হওয়ার মধ্যে ২০২৩ সালে এক বছর বাড়ানো হয়। এরপর অর্থের সংস্থান না থাকায় ২০২৪ সালের দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে নতুন করে আর ইভিএম কেনা হয়নি।
দেড় লাখের মধ্যে ৭০ হাজার ইভিএম প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ মেশিন টুলস ফ্যাক্টরিতে (বিএমটিএফ) সংরক্ষিত রয়েছে। বাকি ৮০ হাজার যন্ত্র মাঠ পর্যায়ে বিভিন্ন নির্বাচনে ব্যবহার হয়েছে। রক্ষণাবেক্ষণের ঝামেলায় ইভিএমের একটি বড় অংশই অকেজো হয়ে গেছে।
এমন পরিস্থিতিতে এ কার্যক্রমকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেয়ে 'ভালো থাকা' ইভিএম রক্ষণাবেক্ষণই এখন জরুরি হয়ে পড়েছে বলে মনে করছেন কমিশনের কর্মকর্তারা। এজন্য আরও এক বছর প্রকল্পের মেয়াদ বাড়াতে চাইছে কমিশন।
পরিকল্পনা কমিশনের প্রকল্পটির মেয়াদ আরও এক বছর বাড়াতে চলতি মাসেই প্রকল্পের সংশোধনী প্রস্তাব পাঠিয়েছে ইসি।
নির্বাচন কমিশনের সচিব শফিউল আজিম বলেন, 'পরিকল্পনা কমিশনের সঙ্গে যোগাযোগ হচ্ছে। আমরা আশা করছি, এক বছরের এক্সটেনশন পেয়ে যাব।'
তিনি বলেন, খরচ কিভাবে কমানো যায় এবং রক্ষণাবেক্ষণ নিজেদের জনবল দিয়ে করার বিষয়টিও বিবেচনায় রয়েছে।
শফিউল আজিম বলেন, 'আশা করছি আরও এক বছর উইদাউট অ্যানি কস্ট, এই এক্সেটেনশনটা যাতে হয়। ইভিএমে যদি আরও কোনো কিছু করার থাকে; কীভাবে আরও ইন্টিগ্রেশনে যাব, কমিশনের নিজস্ব জনবল তৈরি, এটা কীভাবে সংরক্ষণ, কীভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করব এবং এটার কারিগরি কীভাবে সফলভাবে হ্যান্ডেল করতে পারি, সব কিছুই আমরা পরবর্তী এক বছর সময় পেলে তার মধ্যেই ঠিকঠাক করে ফেলব।'
ইভিএম যাত্রার ১৪ বছর
২০১০ সালে ইভিএম চালুর পর স্থানীয় নির্বাচনেই তা ব্যবহার হচ্ছিল। এটিএম শামসুল হুদা কমিশন সিটি করপোরেশনে বড় পরিসরে ব্যবহার করেছিল। কিন্তু সংসদ নির্বাচনে নিতে পারেনি।
২০১২ সালে কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ নেতৃত্বাধীন ইসি আগের ইভিএমকে অনেকটা অকেজো অবস্থায় ফেলে গিয়েছিল। তখন সিটি নির্বাচনেও ইভিএম ব্যবহার হোঁচট খায়।
এরপর কে এম নূরুল হুদার কমিশন নতুন করে ইভিএম নিয়ে এগোয়। ৩ হাজার ৮২৫ কোটি টাকা ব্যয়ে দেড় লাখ ইভিএম কেনার প্রকল্প অনুমোদন পায়। আইন সংশোধন করে ২০১৮ সালের একাদশ সংসদ নির্বাচনে ছয়টি সংসদীয় আসনে ইভিএম ব্যবহারও করা হয়।
এসব যন্ত্রের আয়ুষ্কাল ১০ বছর ধরা হলেও পাঁচ বছরের মাথায় অধিকাংশ ইভিএম অকেজো হয়ে যায়। সেগুলো মেরামতে বড় অঙ্কের অর্থের সংস্থান আর পরে হয়নি।
এর মধ্যেও কাজী হাবিবুল আউয়াল কমিশন স্থানীয় সরকারের বেশির ভাগ নির্বাচন আয়োজন করে ইভিএমে। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে অন্তত দেড়শ আসনে ইভিএমে ভোট করার পরিকল্পনা ছিল ইসির।
তবে কোভিড-পরবর্তী সময়ে আর্থিক সংকটের মধ্যে আরও দুই লাখ নতুন ইভিএম কেনার প্রস্তাবে সরকার সায় দেয়নি। ফলে দ্বাদশ সংসদে ইভিএম ব্যবহারের পরিকল্পনা থেকে সরে আসে ইসি।
এখন সব স্থানীয় নির্বাচনে ইভিএম, নতুন ফিচার নিয়েও কাজ করার পরিকল্পনা করছে কমিশন।
কমিশনের সচিব শফিউল আজিম বলেন, যে কোনো প্রযুক্তি প্রকল্পের মাধ্যমে শুরু হয়। এটি নির্ভর করে জন-আকাঙ্ক্ষা, তাদের মতামতের ওপর। আগামীতে যে নির্বাচনগুলো হবে সেগুলো ইভিএমে নির্বাচন করার জন্য অনুরোধ আসছে।
তিনি জানান, 'পরবর্তী সময়ে যেসব স্থানীয় নির্বাচন হবে সেগুলো ইভিএমে হবে বলে কমিশন সিদ্ধান্ত নিয়েছে।'
নতুন প্রযুক্তি নিয়ে অনেক জিজ্ঞাসা থাকে বলে তৃণমূলের মানুষ যাতে এটা নিয়ে বিস্তারিত জানতে পারে সেজন্য ইসি বিশেষজ্ঞ, সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধি, সুবিধাভোগী ও ব্যবহারকারীদের নিয়ে কাজ করছে।
বিদ্যমান ইভিএমে আরও নতুন ফিচার যোগ করা যায় কি না, আরও কীভাবে নির্ভরযোগ্য করা যায়, অন্য দেশে কীভাবে হচ্ছে, বৈশ্বিকভাবে এটির গ্রহণযোগ্যতা কেমন, সেগুলো নিয়েও কাজ চলছে।
পরিকল্পনায় স্বতন্ত্র ওয়্যারহাউস
ইভিএম সংরক্ষণে নিজস্ব গুদাম (ওয়্যারহাউস) তৈরি করতে চায় নির্বাচন কমিশন (ইসি)। এজন্য জমি চেয়ে ঢাকার ডিসিকে চিঠিও দেওয়া হয়েছে।
ইসি সচিব বলেন, 'আমরা ইভিএমের সংরক্ষণ, মেরামত, টেকনোলজি ট্রান্সফার, নিজস্ব জনবল তৈরি- এসব কিছু নিয়ে কাজ করছি।'
জমি পেলে গুদামঘর তৈরির উদ্যোগ নেবে কমিশন। সেখানে নিজস্ব অবকাঠামো গড়ে তোলা হবে। পাশাপাশি নিজস্ব জনবলের মাধ্যমে মেরামতের সক্ষমতা বাড়ানো হবে। প্রযুক্তিগত দিক ও প্রশিক্ষণের পদক্ষেপ পরের বছর নেওয়ার কথা ভাবছেন কমিশনের কর্মকর্তারা। সূত্র: বিডি নিউজ