মাটির নিচের পানি কোথায় গেল?

বরেন্দ্র অঞ্চলে পানির হাহাকার

প্রকাশ | ২৬ জুন ২০২৪, ০০:০০

যাযাদি ডেস্ক
মাত্র চলিস্নশ বছর আগেও যে এলাকায় পানি ছিল সহজলভ্য এখন তার অনেক স্থানেই পানির সংকট। ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ক্রমাগত নিচে নামতে থাকায় বিভিন্ন স্থানে অকেজো হয়ে পড়েছে সরকারি ডিপটিউবওয়েল। এমন অবস্থা বাংলাদেশের উত্তরের ৫টি জেলার বিভিন্ন অংশ নিয়ে গঠিত বরেন্দ্র এলাকায়। সরকারের গবেষণা বলছে, বরেন্দ্রর ৪০ শতাংশ এলাকা রয়েছে উচ্চ পানির সংকটে। খবর : বিবিসি বাংলার। কৃষিতে ব্যাপকভাবে মাটির নিচের পানি উত্তোলন আর সেই সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বৃষ্টি কমে যাওয়া- দুটো মিলিয়েই এই সংকট বলছেন গবেষকরা। রাজশাহীর তানোরে কৃষকসহ সবাই বলছেন এখানে যে পানির তীব্র সংকট তার মূল কারণ মাটির নিচে যথেষ্ট পানি পাওয়া যাচ্ছে না। কিন্তু এখানে পানি আসলে মাটির কতটা গভীরে? পানির সংকট কীভাবে তৈরি হলো? :বরেন্দ্র এলাকায় সামগ্রিকভাবেই ৪০ বছর আগে খুব সহজেই পানি পাওয়া যেত। কিন্তু এখন সেটা কেন পাওয়া যাচ্ছে না? এর উত্তরে কয়েকটি কারণ বের হয়ে আসছে। এক. বরেন্দ্র এলাকায় নব্বইয়ের দশকের আগেও মূলত একটি ফসলের চাষ হতো। সেটা হলো আমন ধান। কিন্তু নব্বই দশক থেকে ব্যাপকভাবে তিন ফসলের চাষ শুরু হয়। এই চাষাবাদের পুরোটাই আবার বলা যায় ভূগর্ভস্থ পানি নির্ভর। বোরো চাষে পানির প্রয়োজন আরও বেশি হয়। সব মিলিয়ে চাষাবাদের জন্য ব্যাপকভাবে পানি উত্তোলন শুরু হয়। দুই. বরেন্দ্র এলাকার গবেষকরা বলছেন, দেশের অন্য এলাকার গড় বৃষ্টিপাতের তুলনায় বরেন্দ্র এলাকায় বৃষ্টিপাত কম হয়। আবহাওয়া অধিদপ্তরে তথ্য নিয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক চৌধুরী সারওয়ার জাহান একটি গবেষণা করেছেন। সেই গবেষণায় তিনি তথ্য দিচ্ছেন, আশি এবং নব্বই দশকের তুলনায় এর পরের দুই দশকে বরেন্দ্রর পানি সংকটে থাকা এলাকাগুলোতে গড় বৃষ্টিপাত কমে গেছে ৪০০ মিলিমিটার। একদিকে পানির উত্তোলন বেড়েছে, অন্যদিকে বৃষ্টি কম হওয়ায় মাটির নিচে পানির পুনর্ভরণ হয়নি। ফলে পানির স্তর আরও নিচে নেমেছে। তিন. আরেকটি বড় কারণ হচ্ছে, বরেন্দ্র এলাকার মাটি উঁচু। অন্যদিকে একে ঘিরে থাকা নদীগুলো তুলনামূলক নিচে। ফলে মাটিতে বৃষ্টির পানি নিচে নামলেও সেটা ভূ-অভ্যন্তরভাগ দিয়েই দ্রম্নত গড়িয়ে নদীর নিচে চলে যায়। এছাড়া নদী-নালা-খাল শুকিয়ে যাওয়ায় সেগুলোতেও পানি জমে থাকে না। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও বরেন্দ্র গবেষক চৌধুরী সারওয়ার জাহান জানান, এখানে আসলে পানি নির্ভরতা বেশি। এখানে শুকনো মওসুমও অনেক লম্বা। কৃষিকে বাঁচাতে মাটির নিচের পানিই ব্যবহার হয়। এখানে পানির আধার তো আনলিমিটেড না। ফলে বিশ বছর আগেও যে অবস্থা ছিল, এখন সে অবস্থা নেই। এখন সব ফ্যাক্টর যোগ হয়ে পরিস্থিতি আরও জটিল আকার ধারণ করেছে। এটা চলতে থাকলে কোথাও কোথাও অচিরেই পানিশূন্য অবস্থা তৈরি হবে। তার মতে, এই এলাকায় প্রচুর গাছপালা রোপণ করতে হবে, যেন জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলা করা যায়। একইসঙ্গে নদী-নালা-খাল বিলের গভীরতা বাড়াতে হবে। পুকুর, খালের সংখ্যা বাড়াতে হবে। যেন বৃষ্টির পানি দীর্ঘদিন জমা থাকে এবং সেটা কৃষির কাজে ব্যবহার করা যায়। সমাধান কোথায়? :বরেন্দ্র এলাকায় পানিসংকট মোকাবিলায় দায়িত্বপ্রাপ্ত সরকারি প্রতিষ্ঠান হচ্ছে 'বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ' বা বিএমডিএ। কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীন এই সংস্থাটি নীতি কৌশল ঠিক করা ও প্রয়োগে ভূমিকা রাখার কথা। কিন্তু পানি সংকট নিরসনে সংস্থাটি কী করছে? এক্ষেত্রে বরেন্দ্র এলাকায় খোঁজ নিয়ে মোটাদাগে দু'টি বিষয় দেখা যাচ্ছে। এক. ২০১৫ সালের পর থেকে বরেন্দ্র এলাকায় সরকারিভাবে ডিপটিউবওয়েল বসানোর কার্যক্রম বন্ধ রেখছে বিএমডিএ। উদ্দেশ্য মাটির নিচের পানি যেন কম ব্যবহার হয়। দুই. একইসঙ্গে পদ্মা, মহানন্দা, করতোয়াসহ বিভিন্ন নদী থেকে পানি এনে রাবার ড্যামে আটকে কৃষিতে সেচের ব্যবস্থা করেছে সংস্থাটি। কিন্তু এরপরও বরেন্দ্র এলাকায় কৃষিতে পানির যে চাহিদা সেটা পূরণ হচ্ছে মাত্র ১৩ শতাংশ। অর্থাৎ বাকি ৮৭ শতাংশ পানি এখনো মাটির নিচ থেকেই উত্তোলন করা হচ্ছে। জানতে চাইলে বিএমডিএ'র ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী পরিচালক মো. আব্দুর রশীদ বলেন, তারা ধাপে ধাপে ভূগর্ভস্থ পানির নির্ভরতা কমানোর চেষ্টা করছেন। তিনি বলেন, 'আমাদের ২০৩০ সালের মধ্যে লক্ষ্যমাত্রা আছে যে, আমরা সারফেস ওয়াটার অর্থাৎ মাটির ওপরের পানির ব্যবহার ৩০ শতাংশে নিয়ে আসব। তখনো ভূগর্ভস্থ পানিতে নির্ভরতা থাকবে ৭০ শতাংশ। কেননা এই শতভাগ পানির চাহিদা সারফেস ওয়াটারে মেটানো সম্ভব না যেহেতু এর উৎস নেই। অর্থাৎ এখানে পানির সোর্স এভেইলেবল না। সুতরাং আমরা এখানে একটা যৌথ ব্যবস্থা বাস্তবায়ন করছি। গ্রাউন্ড ওয়াটারও থাকবে, সারফেস ওয়াটারও থাকবে।' কিন্তু এখন মাটির ওপরে যে পানি পাওয়া যাচ্ছে সেটা কোথা থেকে আসছে এমন প্রশ্নে মো. আব্দুর রশিদ জানান, এই পানি আনা হচ্ছে বিভিন্ন নদী থেকে। তিনি বলেন, 'পদ্মা, মহানন্দা, করতোয়া থেকে পাইপ দিয়ে পানি আনা হচ্ছে। এছাড়া দিনাজপুরের আত্রাই নদীর পানি আনাসহ এ রকম কয়েকটি প্রকল্প নিয়ে এখন কাজ হচ্ছে। মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে, মাটির নিচের পানির ওপর চাপ কমানো। এছাড়া এখানে ধান আবাদে অনেক পানি দরকার হয়।' সেখানে যদি ধানের পরিবর্তে কম পানি লাগে এমন ফসল যেমন মাল্টা, ড্রাগন, আমগাছ, সরিষা, তিল ইত্যাদির চাষ বাড়ানো যায় তাহলেও কৃষিতে পানির ব্যবহার কমে আসবে। এই সবকিছুর মাধ্যমেই আমরা সমন্বিতভাবে ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার কমাতের চাই।' পানির সংকটে বরেন্দ্র এলাকায় অবশ্য ইতোমধ্যেই কৃষকদের অনেকে বিকল্প কৃষিতে ঝুঁকেছেন। এটা একটা বড় পরিবর্তন। আগে ধান চাষ হতো এমন জমিতে এখন আম, মাল্টা, ড্রাগনের বাগান যেমন গড়ে উঠছে, তেমনি সরিষা, তিলসহ ভুট্টা চাষেও আগ্রহী হচ্ছেন কৃষক। যেগুলোতে পানির ব্যবহার কম। এছাড়া কম পানির সেচে বোরো ধান চাষের প্রযুক্তিও কাজে লাগাচ্ছেন অনেকে। যদিও বাস্তবতা হচ্ছে, এসবের ব্যাপকতা কম। ফলে এখানকার কৃষি এখনো মাটির নিচের পানি নির্ভর। সব মিলিয়ে একদিকে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বৃষ্টিপাত কমছে, অন্যদিকে ভূগর্ভস্থ পানির নির্ভরতাও উলেস্নখযোগ্য মাত্রায় কমানো যায়নি। ফলে জাস্টিনা হেমব্রমের মতো মানুষ যারা পানির সংকটে আছেন তাদের নিত্যদিনের সংকটও অব্যাহত থাকছে।