উপজেলা চেয়ারম্যানের হলফনামায় জমি ১০ গুণ!
প্রকাশ | ২৫ জুন ২০২৪, ০০:০০
আকতার হোসেন অপূর্ব সিংড়া (নাটোর)
ষষ্ঠ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের প্রথম ধাপে নাটোর জেলার সিংড়া উপজেলার চেয়ারম্যান পদে বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিজয়ী দেলোয়ার হোসেনের হলফনামায় তথ্য গরমিলের অভিযোগ পাওয়া গেছে।
হলফনামায় তিনি তার পৈতৃক জমি ১০ একর দেখালেও ইউনিয়ন ভূমি অফিসের রেকর্ডে পাওয়া গেছে মাত্র ১.৩১৫ একর। ফলে হলফনামায় তিনি প্রকৃত জমির চেয়ে প্রায় ১০গুণ বেশি দেখিয়েছেন। বিষয়টি জানাজানি হলে জনমনে সৃষ্টি হয়েছে নানা প্রশ্ন আর সমালোচনা।
অনেকের ধারণা, দেলোয়ার হোসেন চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার পর হয়তো দুর্নীতি করে অঢেল সম্পদের মালিক হবেন এমন চিন্তা থেকেই হলফনামায় বেশি জমি দেখিয়েছেন। যাতে মেয়াদ শেষে তিনি হলফনামা সূত্রে বলতে পারেন, নির্বাচন করার সময়ই তার ১০ একর জমি ছিল।
জানা যায়, হলফনামায় ওই প্রার্থী তাদের কৃষিজমি ১০ একরে নিজের অংশ ১৩ ভাগ দেখিয়েছেন। এ ছাড়া একটি আধাপাকা বাড়ি ও পুকুরে তার ৬ ভাগ রয়েছে বলে উলেস্নখ করেছেন।
এদিকে হলফনামায় তথ্য গোপন ও দাখিলকৃত মনোনয়নপত্রে অসঙ্গতি এবং ত্রম্নটিপূর্ণ থাকার পরও বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় চেয়ারম্যান নির্বাচিত ঘোষণা করায় প্রকাশিত গেজেট ও শপথ বাতিলের জন্য আবেদন করেছেন এলাকার তিন ব্যক্তি। সিংড়া উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান দেলোয়ার হোসেন ওই উপজেলার কলম ইউনিয়নের পারসাঐল এলাকার শের আলীর ছেলে।
প্রকাশিত গেজেট ও শপথ বাতিলের আবেদনকারীরা হলেন ওই উপজেলার সাতারবাড়িয়া এলাকার বাবুল হোসেন, চক দুর্গাপুর এলাকার রাজু আহম্মেদ এবং সিংড়া বাজার এলাকার আক্তার হোসেন।
প্রকাশিত গেজেট ও শপথ বাতিলের আবেদনকারী তিনজনের দাবি- দেলোয়ার হোসেন তার হলফনামায় তথ্য গোপন করেছেন।
এ ছাড়া মনোনয়নপত্রে অসঙ্গতি ও ত্রম্নটিপূর্ণ থাকার পরও গত ২৩ এপ্রিল তাকে বিনাপ্রতিদন্দ্বিতায় নির্বাচিত ঘোষণা করেন নাটোর জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা ও রিটার্নিং অফিসার।
গত ৮ মে ওই ভোটগ্রহণের দিন ধার্য ছিল।
তারা দাবি করেন, ৬ষ্ঠ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে (১ম ধাপে) ২ জন চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী হিসেবে গত ১৭ এপ্রিল দেলোয়ার হোসেন ও লুৎফুল হাবিবের মনোনয়নপত্র বৈধ ঘোষণা করে প্রার্থীদের তালিকা প্রকাশ করেন জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা ও রিটার্নিং অফিসার।
ওই বৈধ তালিকায় দেলোয়ার হোসেনের মাতার নাম- লায়লা জেসমিন এবং মো. লুৎফুল হাবিবের মাতার নাম মোছা. আংগুর বালা। কিন্তু দুইজন প্রার্থী জাতীয় পরিচয়পত্রের সঙ্গে জমাকৃত হলফনামা ও মনোনয়নপত্রের সঙ্গে বৈধ প্রার্থীর তালিকায় মায়ের নামে কোনো মিল নেই।
এ ছাড়া দেলোয়ার হোসেনের দাখিলকৃত হলফনামার 'শিক্ষাগত যোগ্যতা' কলামে স্বশিক্ষিত লেখেন। অপরদিকে তার জাতীয় পরিচয়পত্রের তথ্যে তার 'শিক্ষাগত যোগ্যতা' কলামে 'মাধ্যমিক' উলেস্নখ রয়েছে। দেলোয়ার হোসেন হলফনামায় স্বাক্ষর করেন ১৩ এপ্রিল। হলফনামা ও মনোনয়নপত্র জমা দেন ১৫ এপ্রিল। অথচ তার জাতীয় পরিচয়পত্রের ইসু্য তারিখ ১৬ এপ্রিল।
তাদের দাবি, দেলোয়ার হোসেন হলফনামায় যে স্বাক্ষর করেছেন ওই স্বাক্ষরের সঙ্গে ভোটার আইডি কার্ডের স্বাক্ষরের কোনো মিল নেই।
জেলা নির্বাচন ও রিটার্নিং অফিসার বরাবর গত ৫ মে জমা দেওয়া ওই আবেদনে তারা দেলোয়ার হোসেনের মনোনয়নপত্র অবৈধ ঘোষণা করে পুনঃতফসিলের দাবি করেছেন।
এর আগে ২২ এপ্রিল প্রধান নির্বাচন কমিশনার বরাবরও আবেদন করেছেন ওই তিনজন।
আবেদনকারীদের দাবি- ওই আবেদন বিষয়ে গত ১২ মে জেলা রিটার্নিং কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বললেও তিনি কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করতে অপারগতা প্রকাশ করেন। এরপর দেলোয়ারকে সিংড়া উপজেলা চেয়ারম্যান হিসেবে গেজেট প্রকাশ করা হয়েছে।
তিনি শপথগ্রহণ করে বর্তমানে দায়িত্বও পালন করছেন।
অভিযোগ বিষয়ে অনুসন্ধানে কলম ইউনিয়ন ভূমি অফিসে গেলে জানা যায়, দেলোয়ারের পিতার নামে ২৪৭,২৫১,২৫২,২৫৩ মৌজায় ৫ দাগে মোট জমির পরিমাণ ১.৩১৫ একর। এর মধ্যে পুকুর ৪০ শতক, বাড়ি ২৭ শতক, ভিটা ৩০ শতক ও দুই দাগে ধানি জমি রয়েছে ৯৫ ও ২৫ শতক। ওই জমির বাংলা ১৪২৮ সাল পর্যন্ত খাজনাদি পরিশোধ রয়েছে যার হোল্ডিং নম্বর ৫৯১৮৩৭। সর্বশেষ খাজনাদি পরিশোধ করা হয়েছে ৬ হাজার ৬২০ টাকা।
ওই জমির বর্তমান মালিকরা হলেন দেলোয়ারের মা আঙ্গুরবালা, ভাই এমদাদুল হক, মজিবর রহমান, দেলোয়ার নিজে ও অপর ভাই জুয়েল হোসেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে দেলোয়ার হোসেন তার বিরুদ্ধে আনীত সব অভিযোগ অস্বীকার করলেও জমির বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে চাননি।
এ ব্যাপারে বিশিষ্ট আইনজীবী মো. হাসান উজ জামান বাপ্পি জানান, গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ ১৯৭২ (আরপিও) অনুযায়ী হলফনামায় ভুল বা মিথ্যা তথ্য প্রমাণিত হলে প্রার্থিতা বাতিল হতে পারে। এমনকি নির্বাচিত হওয়ার পরও প্রার্থী সদস্যপদ হারাবেন।
নির্বাচন অফিস সূত্রে জানা যায়, নির্বাচন কমিশনের এত জনবল নেই যে, সব প্রার্থীর হলফনামা যাচাই করবে বা খতিয়ে দেখবে।
এ বিষয়ে জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা আব্দুল লতিফ শেখকে বারবার ফোন দেওয়া হলেও তিনি তা রিসিভ করেননি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে নাটোর কোর্টের সরকারি কৌঁসুলি (জিপি) অ্যাডভোকেট মালেক শেখ জানান, কোনো প্রার্থী যদি হলফনামায় প্রকৃত সম্পদের চেয়ে বেশি সম্পদ দেখায় তবে তা প্রশ্নের জন্ম দেয়। কেননা সাধারণ মানুষের মধ্যে এমন মনে হয়, নির্বাচিত হলে ওই অতিরিক্ত জমিজমা দূর্নীতির মাধ্যমে অর্জন করবে এমন ইনটেনশন থেকেই ওই বেশি সম্পদ দেখানো হয়েছে কি-না?
এটি গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ ১৯৭২ (আরপিও) অনুযায়ী শুধু অপরাধই নয় বরং তা তদন্তের দাবি রাখে। তদন্তে অভিযোগ সত্য প্রমাণিত হলে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধির পদও বাতিল হবে।