পরিবার নিয়ে গ্রামে ঈদ উদযাপন শেষে হাসিমুখে রাজধানীতে ফিরছেন কর্মজীবী মানুষ। তবে ঈদযাত্রায় ফিরতি ট্রেন-লঞ্চ ও বাসে যাত্রীর চাপ খুব বেশি নেই। এ জন্য অনেকটা স্বস্তিতেই ফিরছেন মানুষ। শুক্রবার রাজধানীর কমলাপুর রেলস্টেশন, সদরঘাট লঞ্চ স্টেশন, বাস টার্মিনালে এমন চিত্র দেখা গেছে। তবে আজ যাত্রী চাপ আরও বাড়তে পারে বলে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
এদিকে, শুক্র ও শনিবার সরকারি ছুটি থাকায় ঈদের পঞ্চম দিনও বাড়ি ফিরেছেন অনেকে। ভিড় আর ভোগান্তি এড়াতেই ঈদের পর ঢাকা ছেড়েছেন তারা।
আমাদের কেরানীগঞ্জ (ঢাকা) প্রতিনিধি জানান, শুক্রবার ভোর থেকেই সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালে ভিড়তে শুরু করে বরিশাল, ভোলা, চরফ্যাশন, ভান্ডারিয়া, লালমোহনসহ দেশের বিভিন্ন রুটের যাত্রীবাহী লঞ্চ। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে টার্মিনালে বাড়তে থাকে ঢাকায় ফেরা মানুষের ভিড়। বাড়তি চাপ না থাকায় যাত্রীরা ফিরছেন নিরাপদে ও স্বস্তিতে। পরিবার-পরিজনের সঙ্গে ঈদ করতে পেরে খুশি সবাই। ঢাকায় ফেরা যাত্রীরা বলছেন, অফিস খুলে যাওয়ায় মন না চাইলেও বাধ্য হয়ে ফিরতে হচ্ছে ঢাকায়। ঈদযাত্রা ছিল নির্বিঘ্ন।
দুপুরের পর থেকেই ঢাকা-বরিশাল নৌরুটের লঞ্চগুলো ডেকে পরিপূর্ণ যাত্রী নিয়ে সদরঘাটের পন্টুনে ভিড়তে থাকে। সন্ধ্যা পর্যন্ত সদরঘাটের লঞ্চ টার্মিনালে ঢাকায় ফেরা মানুষের ভিড় লক্ষ্য করা গেছে। দুপুরের পর থেকে গ্রিন লাইন-৩ ও সন্ধ্যার পর পারাবত-৯, ১০, ১২ ও ১৮; মানামী, কুয়াকাটা-২, কীর্তনখোলা-২ ও ১০, সুরভী-৮ ও ৯, অ্যাডভেঞ্চার-১ ও ৯, সুন্দরবন-১২ লঞ্চসহ মোট ২৫টি লঞ্চ বরিশাল নদীবন্দর থেকে সদরঘাটে এসে পৌঁছায়। ধারণ ক্ষমতার বেশি যাত্রী নিয়েও কিছু লঞ্চ ঢাকায় এসে পৌঁছায়। এছাড়াও নিকটবর্তী জেলা চাঁদপুর, ভোলা, ইলিশা থেকে ছেড়ে আসা লঞ্চগুলোও ছিল কানায় কানায় পূর্ণ।
সংশ্লিষ্টরা জানান, সদরঘাট টার্মিনাল থেকে দেশের ৩১টি নৌপথে নিয়মিত ৭০টি লঞ্চ চলাচল করে। তবে ঈদুল আজহা উপলক্ষে তা দ্বিগুণের বেশি করা হয়েছে। ঈদের আগে-পরের প্রায় ১৫ দিন ছোট-বড় মিলিয়ে ১৮০টিরও বেশি লঞ্চ যাতায়াত করেছে। আগে ঢাকা থেকে ৪১টি নৌপথে লঞ্চসহ পণ্যবাহী বিভিন্ন নৌযান চলত। নদী খনন ও ড্রেজিংয়ে অনিয়মের কারণে ঢাকা থেকে দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলগামী ১০টি নৌপথ বন্ধ হয়ে গেছে।
মানামি লঞ্চের চালক মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, 'এবার ঈদের আগে যেমন যাত্রী চাপ ছিল পরে তেমন হচ্ছে না। সরকারি ছুটি শেষ হওয়ায় অনেকেই এখন ঢাকা ফিরছেন। তবে অনেকে শুক্র ও শনিবার ছুটি নিয়ে সাপ্তাহিক ছুটির সঙ্গে সমন্বয় করে নিয়েছেন। ধারণা করা হচ্ছে আজ যাত্রীর চাপ অনেকটা বাড়বে।'
রাজধানীর মিরপুরের বাসিন্দা মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম পরিবার নিয়ে গ্রামের বাড়ি পটুয়াখালী থেকে ফিরেছেন ঢাকায়। তিনি বলেন, 'এমভি টিপু-৭ লঞ্চের টিকিট পেয়েছিলাম। তবে লঞ্চে অনেক ভিড় ছিল। ঠিকভাবে ঢাকায় আসতে পেরেছি এটাই অনেক।'
ভোলা থেকে আসা বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা ফারুক হোসেন বলেন, 'পরিবারের সঙ্গে ঈদ কাটিয়ে আবার ঢাকায় ফিরলাম। আসতে তেমন কোনো ভোগান্তি হয়নি। ঝড় নিয়ে আতঙ্ক ছিল, কী হয় না হয়। ভালোভাবে পৌঁছে গেছি।' একই ঘাটে পাশেই চাঁদপুর থেকে এমবি কর্ণফুলী লঞ্চটি তার সাত আট মিনিট আগে ঘাটে ভিড়ে। সেই লঞ্চ থেকেও যাত্রীরা নামছেন ঘাটে।
এমভি তাসরিফ-৮ লঞ্চটির কর্মী আসাদুল হক মুন্সি বলেন, 'এই ট্রিপে পাঁচ-ছয়শ' মানুষ ঢাকা এসেছে। ছুটি শেষ হওয়ায় মানুষ ঢাকায় ফিরছেন। আরামের যাত্রা লঞ্চ। এজন্য অনেকেই লঞ্চে যাতায়াত করেন।'
যাত্রী পরিবহণ সংস্থার সিনিয়র সহ-সভাপতি আবুল কালাম বলেন, 'আমাদের লঞ্চ আছে অনেক। কিন্তু সে অনুযায়ী যাত্রী নেই। তাই লঞ্চ কম ছাড়ছে। যেগুলো ছাড়ছে সেগুলো যাত্রী ভরেই যাচ্ছে। ঈদের পরও আমরা যাত্রীর চাপ আশা করেছিলাম। কিন্তু পাইনি।'
লঞ্চ মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক সিদ্দিকুর রহমান পাটোয়ারী বলেন, ঈদের আগে যাত্রীর চাপ বাড়ায় আশা পেয়েছিলাম। এখন সে আশা আর দেখছি না। সামনের দিনগুলোতে কী হয় দেখা যাক।
সদরঘাটের দায়িত্বে থাকা বিআইডবিস্নউটিএ-এর নৌ-নিরাপত্তা ও ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা বিভাগের যুগ্ম পরিচালক মোহাম্মদ ইসমাইল হোসেন জানান, 'ঈদের পর যাত্রীর চাপ স্বাভাবিক রয়েছে। আমাদের নিয়মিত লঞ্চগুলোই চলাচল করছে। অতিরিক্ত কোনো লঞ্চের প্রয়োজন পড়ছে না। আর ভাড়া বেশি নেয়ার অভিযোগ পেলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।'
টার্মিনাল এলাকায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে সদরঘাট নৌ-থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আবুল কালাম বলেন, 'শুক্রবার যাত্রীর চাপ আগের থেকে বেড়েছে। পুলিশ, র?্যাবসহ আনসার সদস্যরা যাত্রীদের নিরাপদ যাত্রা নিশ্চিত করতে কাজ করছেন। সন্দেহজনক কিছু দেখলে তলস্নাশিও চালানো হচ্ছে। যাত্রীর চাপ বাড়লে নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরও জোরদার করা হবে।'
এদিকে, শুক্রবার সকালে রাজধানীর কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন ঘুরে নিজস্ব প্রতিনিধি জানান, ঈদের ছুটি শেষে কর্মজীবী মানুষরা ঢাকা ফিরতে শুরু করেছেন। ঈদের ছুটি গত বুধবার শেষ হওয়ায় যারা অতিরিক্ত ২ থেকে ৩ দিন ছুটি নিয়েছিলেন তারাই এখন ঢাকায় ফিরছেন। তবে ঈদযাত্রায় ফিরতি ট্রেনে যাত্রীর চাপ খুব বেশি নেই।
সরেজমিন দেখা গেছে, কমলাপুর রেলস্টেশনে ঈদযাত্রা শেষে মানুষ ফিরছেন। কিন্তু ট্রেন ভর্তি থাকলে ট্রেনের ছাদে কিংবা দাঁড়িয়ে আসার যে যাত্রীর চাপ থাকে সেটা নেই। অন্যদিকে ঈদের আগে যারা বাড়ি যেতে পারেননি তারা অনেকে ঢাকা ত্যাগ করছেন। তাদের উপস্থিতিও ছিল বেশি। যাদের ঢাকার বাইরে যাওয়ার টিকিট নেই তারা কেউ কেউ স্ট্যান্ডিং টিকিট সংগ্রহ করতে ব্যস্ত।
এদিন দিনাজপুর থেকে ঢাকা ফিরেছেন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মজীবী শাহরিয়ার। তিনি বলেন, 'ঈদের ছুটিতে বাড়িতে গিয়েছিলাম। পরিবারসহ যাওয়ায় তিন দিনের ছুটির সঙ্গে আরও তিনদিন ছুটি নিয়েছিলাম। ছুটি শেষ হওয়ায় পরিবারসহ ফিরে আসলাম।'
নীলফামারী থেকে ঢাকায় ফেরা বাপ্পী বলেন, 'এবার ঈদে মাত্র চার দিনের ছুটি পেয়েছিলাম তার সঙ্গে অতিরিক্ত ছুটি নিয়েছিলাম। ছুটি শেষ করে বাড়ি থেকে ফিরলাম। ট্রেনে শান্তিতেই ফিরতে পেরেছি।'
কমলাপুর রেলস্টেশন থেকে নাটোরে যাচ্ছিলেন মোহাম্মদ মাসুদ হোসেন। তিনি বলেন, 'আমার কাপড়ের ব্যবসা, ঈদের চাঁদরাত পর্যন্ত ব্যবসা করেছি। পরে কোরবানি দিলাম এজন্য ঢাকা থেকে একটু দেরিতে গ্রামের বাড়ি যাচ্ছি।'
কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন মাস্টার শাহাদাৎ হোসেন বলেন, 'বৃহস্পতিবার থেকে অগ্রিম টিকিটের যাত্রা শুরু হয়েছে। যাত্রী চাপ স্বাভাবিকের চেয়ে একটু বেশি। তবে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রয়েছে।'
বাস সংকটে যাত্রীরা
এদিকে, ঈদের ছুটি শেষে ঢাকায় ফিরছেন দক্ষিণাঞ্চলের ২১ জেলার বাস যাত্রীরা। গত বুধবার থেকেই ঢাকায় ফেরার যাত্রা শুরু হয়েছে ঈদের ছুটি কাটাতে গ্রামের বাড়িতে যাওয়া সাধারণ মানুষের।
শুক্রবার সকাল থেকে মাদারীপুরের শিবচরের এক্সপ্রেসওয়ের বিভিন্ন স্ট্যান্ডে গাড়ির অপেক্ষায় দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেছে যাত্রীদের। দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন জেলা থেকে ছেড়ে আসা বাসগুলো এখন আর পথে থামছে না। যাত্রী ভরে আসায় পথ থেকে আর যাত্রী তুলছে না বেশির ভাগ পরিবহণ।
এদিকে, বরিশাল, গোপালগঞ্জ, ফরিদপুরসহ বিভিন্ন স্থান থেকে ছেড়ে আসা পরিবহণগুলোতে যাত্রী ভরা থাকায় শিবচরের সূর্যনগর, পাঁচ্চর, গোলচত্বর, নাওডোবাসহ একাধিক স্ট্যান্ডে থামছে না। ফলে ঢাকাগামী স্থানীয় যাত্রীদের পরতে হচ্ছে দুর্ভোগে।
শুক্রবার সকালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এক্সপ্রেসওয়ের শিবচরের বিভিন্ন স্ট্যান্ড ঘুরে দেখা গেছে, বাসের জন্য ঢাকাগামী যাত্রীরা দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করছেন। ঢাকা-ভাঙ্গা লোকাল পরিবহণগুলো ভাঙ্গা থেকেই যাত্রীপূর্ণ করে ছেড়ে আসছে। এছাড়া দূরপালস্নার কোনো পরিবহণই কোনো স্ট্যান্ডে এখন আর থামছে না। ফলে বাসস্ট্যান্ডেই অপেক্ষা করতে হচ্ছে যাত্রীদের। লোকাল বাস এসে থামলে বাসে ওঠার প্রতিযোগিতা শুরু হয়। পাঁচ্চর থেকে ২০০ টাকার ভাড়া ২৫০ করে নিচ্ছে বাসগুলো। ভাঙ্গা থেকে ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকা ভাড়া নিচ্ছে। বাড়তি ভাড়া দিয়ে বাসে দাঁড়িয়ে ঢাকা যেতে হচ্ছে যাত্রীদের।
পাঁচ্চর বাসস্ট্যান্ডে ঢাকাগামী একাধিক যাত্রী জানান, 'ঈদের সময়ে যাত্রী চাপ থাকায় ভাঙ্গা থেকেই যাত্রীপূর্ণ করে বাসগুলো আসছে। ফলে পাচ্চর স্ট্যান্ডে বেশির ভাগ বাসই থামছে না। মাঝে মধ্যে থামলেও সিট খালি নেই। বাড়তি ভাড়া দিয়ে দাঁড়িয়ে যেতে হচ্ছে। বাসের জন্য দীর্ঘসময় অপেক্ষা করতে হয়। যাত্রীর চাপ অনেক বেশি। সে তুলনায় গাড়ি আসছে না।'
পাঁচ্চর গোলচত্বর স্ট্যান্ডে বাসের জন্য অপেক্ষায় থাকা ঢাকায় ফেরা যাত্রী মো. নাসির বলেন, 'বাসের জন্য দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে। ঢাকার ভাড়া ৩০০ টাকা চায়। দর-দাম করে ২৫০ টাকা দিয়ে গাড়িতে উঠেছি।'
সোমা আক্তার নামের এক যাত্রী বলেন, 'পাঁচ্চর বাসস্ট্যান্ডে এক ঘণ্টা ধরে বসে থাকতে হয়েছে গাড়ির জন্য। সব বাসেই যাত্রী ভরা। ভাঙ্গা থেকে আসা বেশির ভাগ বাসই এখানে থামিয়েই চলে গেছে। সকাল থেকে পাঁচ্চর স্ট্যান্ডে অসংখ্য যাত্রীকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হচ্ছে বাসের জন্য।'
ঢাকাগামী একাধিক বাসের সুপারভাইজার জানান, যাত্রীচাপ বেশি থাকায় ভাঙ্গা থেকেই বাসের সব সিটের যাত্রী হয়ে যায়। এজন্য বেশির ভাগ বাসই পথে থামানো হয় না। তারপরও অনেক যাত্রীদের দাঁড়িয়ে নিতে হচ্ছে। আর দূরপালস্নার বাসেরও সব সিট ভরে আসে। ফলে পথে থামানোর প্রয়োজন হয় না।
শিবচর হাইওয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. শাকিল আহমেদ জানান, ঈদের ছুটি শেষে ঢাকামুখী পরিবহণের চাপ রয়েছে মহাসড়কে। যাত্রীদেরও প্রচুর ভিড়। হাইওয়ে পুলিশ সার্বক্ষণিক মহাসড়কে রয়েছে। যেকোনো অপ্রীতিকর ঘটনা এড়িয়ে যাত্রীদের স্বস্তিদায়ক যাত্রা নিশ্চিতে হাইওয়ে পুলিশ কাজ করছে।