কক্সবাজারের প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিন ঘিরে ঠিক কি ঘটছে তা নিয়ে ধোঁয়াশা সৃষ্টি হয়েছে। সংঘাতপূর্ণ মিয়ানমারের দিক থেকে এক সপ্তাহে তিন দিন বাংলাদেশের নৌযান লক্ষ্য করে গুলিবর্ষণের ঘটনায় আতঙ্কে বন্ধ হয়ে যায় টেকনাফ-সেন্টমার্টিন রুটে নৌ-চলাচল। দেশের মূল ভূখন্ড থেকে কার্যত বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে দ্বীপটি। এতে দ্বীপে আটকা পড়েন পর্যটকসহ স্থানীয় ১০ হাজার মানুষ। দেখা দেয় তীব্র খাদ্য সংকট। উদ্ভূত এমন পরিস্থিতিতে মিয়ানমারের আকাশে বিমানের টহল, জলসীমায় যুদ্ধজাহাজ এবং দু'দিন ধরে বিকট শব্দে গোলাগুলির ঘটনা নতুন করে উদ্বেগ বাড়ায়। আর এসব ঘটনার মধ্যেই বাংলাদেশ একমাত্র প্রবাল দ্বীপটির নিয়ন্ত্রণ হারাতে বসেছে কিনা- এমন গুজব ছড়িয়ে পড়ে। বিষয়টি নিয়ে রাজনৈতিক মহলেও জোর আলোচনা চলছে। তবে প্রশাসন জানিয়েছে, মিয়ানমারের নাইক্ষ্যংদিয়া জলসীমায় গোলাগুলি চলা ও বাংলাদেশের নৌযানে গুলি লাগার কারণে নিরাপত্তার স্বার্থে বন্ধ রাখা হয়েছে সব নৌযান। জাহাজ তিনটিও সরে গেছে দেশটির জলসীমা থেকে।
নাব্য সংকটের কারণে টেকনাফ থেকে সেন্টমার্টিন যেতে বাংলাদেশের নৌযানগুলো নাফ নদের মিয়ানমারের কিছু অংশ ব্যবহার করে। কিন্তু সেদেশের অভ্যন্তরীণ সংঘাতের কারণে নিরাপত্তার স্বার্থে সেই রুট কিছুটা সরিয়ে আনা হয়। আর এটাকেই কেন্দ্র করে ফেসবুকে নানা গুজব ছড়াচ্ছে একটি স্বার্থান্বেষী মহল। তবে এসব গুজবকে ভিত্তিহীন বলছে প্রশাসন।
এ বিষয়ে সি-ক্রুজ অপারেটরস ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক হোসাইন ইসলাম বাহাদুর বলেন, 'প্রতিবছর অক্টোবর থেকে মার্চ পর্যন্ত টেকনাফ-সেন্টমার্টিন নৌরুট ১০টির বেশি জাহাজ চলাচল করে। কিন্তু শাহপরীর দ্বীপের ঘোলারচরে চর জেগে যাওয়ায় মিয়ানমারের নাইক্ষ্যংদিয়া চ্যানেল ৩০ থেকে ৪০ মিনিট তাদের অভ্যন্তর দিয়ে জাহাজগুলোকে যেতে হয়। সংঘাতের আগে নাফ নদের মিয়ানমার অংশ দিয়ে টেকনাফ থেকে সেন্টমার্টিন রুটের সব নৌযান চলাচল করলেও কোনো সমস্যা হয়নি।'
তিনি বলেন, 'সেদেশের অভ্যন্তরে শুরু হওয়া সংঘাতের কারণে নাইক্ষ্যংদিয়া জলসীমায়ও চলছে প্রচন্ড গোলাগুলি। যার জেরে চলতি জুনের ৫, ৮ ও ১১ তারিখে আমাদের নৌযান লক্ষ্য করে গুলির ঘটনা ঘটে। সেখানে তিনটি যুদ্ধজাহাজেরও উপস্থিতি দেখেন স্থানীরা। একদিকে গোলাগুলির বিকট শব্দ অন্যদিকে যুদ্ধজাহাজের উপস্থিতিতে আতঙ্কিত হয়ে পড়েন বাসিন্দারা।'
চলতি মাসের ৫ জুন থেকে নাফ নদীর মিয়ানমারের নাইক্ষ্যংদিয়া জলসীমায় নতুন করে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। দেশটির স্থলভাগে অবস্থানরত বিদ্রোহী গ্রম্নপ আরাকান আর্মির সঙ্গে নাফ নদের জলসীমায় অবস্থানরত মিয়ানমার নৌবাহিনীর জাহাজ থেকে থেমে থেমে গুলি ও গোলাবর্ষণের ঘটনা ঘটে। এ সময় টেকনাফ-সেন্টমার্টিন নৌরুটে ট্রলার ও স্পিডবোট নিয়ে যাতায়াত করতে গিয়ে গুলিও এসে পড়ে ট্রলারে। এ ঘটনায় কেউ হতাহত না হলেও গত বৃহস্পতিবার শাহপরীর দ্বীপের পাশ দিয়ে সেন্টমার্টিন যাওয়ার পথে মিয়ানমারের দু'টি ট্রলার থেকে গুলি চালালে একজন গুলিবিদ্ধ হন। আলী জোয়ার নামের ওই ব্যক্তিকে কক্সবাজার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
এছাড়া স্থানীয়রা জানান, সৈকতে মাঝে মধ্যেই ভেসে আসছে অজ্ঞাত ব্যক্তির মৃতদেহ। শুক্রবার দুপুরের দিকে টেকনাফের বাহারছড়া ইউনিয়নের নোয়াখালিয়া পাড়া সৈকত থেকে অর্ধগলিত একটি মৃতদেহটি উদ্ধার করে পুলিশ। কয়েকদিন আগেও টেকনাফ সৈকত ও নাফ নদীর জালিয়াপাড়া পয়েন্ট থেকে অজ্ঞাত আরও দু'টি মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। মরদেহগুলোর অবয়ব দেখে মিয়ানমারের নাগরিক বলে ৫
ধারণা করেন সংশ্লিষ্টরা।
সেন্টমার্টিনের সঙ্গে নৌযান চলাচল বন্ধের পর শাহপরীর দ্বীপ বাসিন্দা স্থানীয় সাংবাদিক জসিম মাহামুদ নিজের ফেসবুকে লিখেন, 'মিয়ানমারের বিস্ফোরণে কাঁপছে শাহপরীর দ্বীপ। মিয়ানমারে সংঘাত শুরু হওয়ার পর এমন বিস্ফোরণের শব্দ পাওয়া যায়নি। এই আওয়াজগুলো খুবই মারাত্মক, কোনোভাবেই রাতে ঘুমানো যাচ্ছে না।'
সেন্টমার্টিন দ্বীপের বাসিন্দা শরাফত বলেন, 'মিয়ানমারের সঙ্গে আমাদের দ্বীপের তো কোনো যুদ্ধ হচ্ছে না। অথচ তাদের যুদ্ধের কারণে আমাদের যাতায়াতের পথ বন্ধ হয়ে গেছে। কারণ গোলাগুলির মধ্যে তো আমরা যেতে পারি না। দ্বীপবাসীর পাশাপাশি দ্বীপে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাও রয়েছেন। তারা আমাদের সার্বক্ষণিক নিরাপত্তা দিয়ে যাচ্ছেন। শুধু মিয়ানমারের যুদ্ধের কারণে দ্বীপবাসীর দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে।'
এদিকে মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ এ সংঘাতকে কেন্দ্র করে সেন্টমার্টিন নিয়ে সৃষ্টি হয় নানা গুজব। সেন্টমার্টিনের নিয়ন্ত্রণে কারা এমন গুজবও ওঠে। তবে একটি মহল গুজব ছড়িয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টির পাঁয়তারা চালাচ্ছে উলেস্নখ করে কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মো. ইয়ামিন হোসেন বলেন, 'মিয়ানমারের সংঘাতের কারণে টেকনাফ-সেন্টমার্টিন নৌরুটে নৌযান চলাচল বন্ধ রাখা হয়েছে। এটা মানুষের নিরাপত্তার স্বার্থে করা হয়েছে। তবে বিকল্পপথ বঙ্গোপসাগর হয়ে ট্রলার নিয়ে যাত্রীদের যাতায়াত ও কক্সবাজার থেকে জাহাজে খাদ্যপণ্য পাঠানো হয়েছে। সাগর উত্তাল হওয়ায় একটু সমস্যা হচ্ছে। সেন্টমার্টিন এখনো বাংলাদেশের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। কেউ গুজবে বিভ্রান্ত হবেন না।'
তবে স্থানীয় প্রশাসন বুঝতে পারছে না গুলি মিয়ানমারের জান্তা, নাকি বিদ্রোহীরা করছে? ফলে কোনো পদক্ষেপ নিতে পারছে না। এমন অবস্থায় দ্বীপবাসীর প্রশ্ন- কী হচ্ছে সেন্টমার্টিনে?
দ্বীপের বাসিন্দা ও জেলা প্রশাসনের বিচকর্মীদের সুপারভাইজার জয়নাল আবেদীন বলেন, 'কষ্টের কথা কাকে বলব? কোনো কিছু সমাধান হচ্ছে না। সবাই আতঙ্কিত।'
সেন্টমার্টিনের বাসিন্দা সাদ্দাম হোসেন জানান, তারা পরিষ্কার দেখেছেন মিয়ানমার অংশে নাফ নদীতে তাদের সরকারি বাহিনী নৌযানে করে পেট্রল দিচ্ছে। তারাই গুলি করছে নৌযানগুলোতে। এখান থেকে তাদের ইউনিফর্মও দেখা যায় বলে উলেস্নখ করেন তিনি।
শনিবার সেন্টমার্টিন ইউপির চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান বলেন, 'সীমান্তে শুক্রবার ভোররাত থেকে আর গোলাগুলির শব্দ পাওয়া যায়নি। তবে দ্বীপে বসবাসকারীদের আতঙ্ক কাটেনি। কখন থেকে তারা আগের নৌপথে (টেকনাফ-সেন্টমার্টিন) যাতায়াত করতে পারবেন, তা নিয়ে চিন্তিত রয়েছেন। কারণ, বঙ্গোপসাগর হয়ে চলাচল খুবই ঝুঁকিপূর্ণ।'
টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. আদনান চৌধুরী বলেন, 'শুক্রবার ভোর থেকে শনিবার বেলা একটা পর্যন্ত মিয়ানমার থেকে আর কোনো গোলাগুলির শব্দ পাওয়া যায়নি। জাহাজও দেখা যায়নি।'
এদিকে নৌযানে গুলির ঘটনায় বর্ডার গার্ডের পক্ষ থেকে মিয়ানমারের সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর কাছে প্রতিবাদলিপি পাঠানো হয়েছে জানিয়ে জেলা প্রশাসন সূত্র বলছে, বিজিবি ও কোস্টগার্ড সতর্ক অবস্থানে রয়েছে। গুজবে বিভ্রান্ত না হওয়ার জন্য সবাইকে অনুরোধ করা হচ্ছে।