ঈদের পর এক সপ্তাহ কাঁচা চামড়াবাহী যানবাহন সীমান্তের দিকে যাওয়া নিষিদ্ধ করা হয়েছে। একই সঙ্গে ওই সব যানবাহন সাভারের ট্যানারি শিল্পনগরীতে পাঠাতে বলা হয়েছে। নির্দেশনা অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে নেওয়া হবে আইনগত ব্যবস্থা। ঈদের পর অন্তত তিন মাস এমন নির্দেশনা কঠোরভাবে পালন করা হবে।
এদিকে চামড়া পাচার ঠেকাতে স্বরাষ্ট্র ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তরফ থেকে গঠন করা হয়েছে পৃথক টাস্কফোর্স। সেই সঙ্গে এবারই প্রথম যুক্ত করা হয়েছে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরকে। ন্যায্য মূল্যে চামড়া বিক্রি ও চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণে ব্যবহৃত লবণ ব্যবসায়ীরা যাতে সিন্ডিকেট করতে না পারে এজন্য এমন ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য মতে, এ বছর প্রায় ১ কোটি ২৯ লাখ পশু কোরবানির জন্য তৈরি হয়েছে। ঢাকায় লবণযুক্ত প্রতিটি গরুর চামড়ার দাম পড়বে কমপক্ষে ১২শ' টাকা। ঢাকার বাইরে ১ হাজার টাকা। পশুর চামড়ার দাম চলতি বছর গত বছরের চেয়ে গড়ে প্রতি বর্গফুটে ৫ থেকে ৭ টাকা হারে বেড়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, এতদিন চামড়াজাত পণ্য উৎপাদনকারী শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো সরকারের নানা সুযোগ-সুবিধা পেত। কিন্তু ছোট ছোট উদ্যোক্তরা তেমন সুবিধা পেত না। বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের লক্ষ্য নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ছোট ছোট রপ্তানিকারকদেরও আর্থিক সহায়তা করার ঘোষণা দিয়েছে। সরকারের তরফ থেকে বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনকে আগামী ২০৩০ সাল নাগাদ চামড়া ও চামজাতপণ্য থেকে বৈদেশিক আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ১ হাজার ২৫০ কোটি টাকা বেঁধে দেওয়া হয়েছে।
চামড়া ব্যবসায়ী সমিতির তথ্য মতে, সারাদেশে ছোট-বড় প্রায় ৩শ' চামড়া প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান আছে। যার মধ্যে একসময় ঢাকায় ছিল ২৬৫টি। ঢাকার প্রায় শতভাগ কারখানা বর্তমানে সাভার চামড়া শিল্পনগরীতে চলে গেছে। তবে সেখানে গ্যাস ও বিদু্যতসহ নানা অসুবিধার কারণে কারখানাগুলো শতভাগ উৎপাদনে যেতে পারছে না। একসময় দেশের সব চামড়া সাভারে আসত। সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন জায়গায় গড়ে ওঠা ছোট ছোট কারখানায় অধিকাংশ চামড়া চলে যাচ্ছে।
রপ্তানি উন্নয়ন বু্যরোর পরিসংখ্যান বলছে, বর্তমানে দেশ থেকে রপ্তানি হওয়া পণ্যের শীর্ষে রয়েছে তৈরি পোশাক। দ্বিতীয় অবস্থানে হিমায়িত মাছ। তৃতীয় অবস্থানে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য।
হাইওয়ে পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, চামড়া পাচার ঠেকাতে ঈদের পর টানা এক সপ্তাহ সীমান্তের দিকে চামড়াবাহী সব ধরনের যানবাহন চলা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। একই সঙ্গে পাচার ঠেকাতে দেশের সড়ক-মহাসড়কগুলোতে চেকপোস্ট বসানো হবে। বাংলাদেশ-ভারত স্থল সীমান্তে বসছে সবচেয়ে বেশি চেকপোস্ট। চেকপোস্টে থাকা রেজিস্টার খাতায় চামড়াবাহী গাড়ির চালক, তার ড্রাইভিং লাইসেন্স, মোবাইল নম্বর, গাড়ির কাগজপত্র ও গাড়ির নম্বর লিখে রাখা হবে। একই সঙ্গে তুলে রাখা হবে গাড়ির ছবি।
সূত্রটি বলছে, সব চামড়াবাহী যানবাহনকে চেকপোস্টে চামড়া বেচাকেনার বৈধ কাগজপত্র দেখা হতো। যানবাহনগুলোকে সাভারের চামড়া শিল্প নগরীর দিকে যেতে বাধ্য করা হবে। তবে অন্য কোনো কারখানায় যাওয়ার বৈধ কাগজপত্র থাকা চামড়াবাহী যানবাহনের ক্ষেত্রে এমন নির্দেশনা কার্যকর হবে না। নির্দেশনা অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে নেওয়া হবে আইনগত পদক্ষেপ।
গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, পুরো বিষয়টি মনিটরিং করবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তরফ থেকে গঠিত টাস্কফোর্স। টাস্কফোর্সটির সঙ্গে সমন্বয় করবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের গঠিত পৃথক টাস্কফোর্সটি। আর ন্যায্য দামে চামড়া বিক্রির বিষয়টি নিশ্চিত করতে এবার টাস্কফোর্সের সঙ্গে যুক্ত থাকছে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। পুরো প্রক্রিয়াটির সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গোয়েন্দা বিভাগ যুক্ত থাকছে।
এ ব্যাপারে হাইওয়ে পুলিশের অ্যাডিশনাল ডিআইজি (ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড অপারেশনস) শ্যামল
কুমার মুখার্জী যায়যায়দিনকে বলেন, সরকারের নির্দেশনা মোতাবেক চামড়াবাহী যানবাহন সাভারের ট্যানারি শিল্পনগরীর দিকে পাঠানো হবে। এছাড়া রাস্তায় চেকপোস্ট বসিয়ে নিয়মিত তলস্নাশি অব্যাহত থাকবে। এমন অভিযান বছরব্যাপী অব্যাহত থাকবে। চেকপোস্টে চামড়াবাহী যানবাহনের বৈধ কাগজপত্র যাচাই-বাছাই করতে কড়া নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
একজন শীর্ষ চামড়া ব্যবসায়ীর নাম প্রকাশ না করার শর্তে যায়যায়দিনকে বলেন, পশুর কাঁচা চামড়ার মূল ক্রেতা খুচরা ব্যবসায়ীরা। তারা পরবর্তী সময়ে পাইকারি ক্রেতাদের কাছে বিক্রি করে দেন। এসব পাইকারি ক্রেতা চামড়ায় লবণ দিয়ে সংরক্ষণ করেন। এরপর তা বড় বড় কারখানা কর্তৃপক্ষ বা চামড়া ব্যবসায়ীরা কিনে নেন। নানা কারণে এবার কোরবানি কম হতে পারে। এজন্য এবার গত বছরের তুলনায় অন্তত ২ কোটি ঘনফুট চামড়া কম পাওয়া যেতে পারে। এরমধ্যে গরুর চামড়া সবচেয়ে বেশি। দ্বিতীয় অবস্থানে ছাগল ও বকরির। তৃতীয় অবস্থানে মহিষ ও ভেড়ার চামড়া।
ওই ব্যবসায়ী আরও জানান, কাঁচা চামড়া সংগ্রহ করার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তা প্রক্রিয়াজাতকরণের আওতায় আনতে হয়। চামড়া সংগ্রহের পর তা থেকে চর্বি ও মাংস পরিষ্কার না করলে চামড়ায় পচন ধরে। পরিষ্কার করার পর তাতে পরিমাণমতো লবণ দিতে হয়। চামড়া দেওয়া লবণের পরিমাণগত পার্থক্যের কারণে চামড়ার মান ভালো বা নিম্নমানের হয়ে থাকে। এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। চামড়া ব্যবসায়ী ও লবণ ব্যবসায়ীদের বিশেষ সিন্ডিকেট আছে। তারা যুগের পর যুগ ধরে প্রতি বছরই কোরবানির সময় লবণের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে। তারা পর্যাপ্ত মজুত না থাকার অজুহাতে লবণের দাম বাড়িয়ে দেয়। কারণ লবণ ছাড়া চামড়া রক্ষা বা সংরক্ষণ করা কোনোভাবেই সম্ভব না।
তিনি আরও জানান, লবণ হচ্ছে চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণের অপরিপরিহার্য উপাদান। লবণ ছাড়া চামড়া রক্ষা করা কোনোভাবেই সম্ভব না। ওই সময় চামড়া ব্যবসায়ীরা লবণের সরবরাহ না থাকার দোহাই দিয়ে কোনো কোনো সময় চামড়া কেনা বন্ধ করে দেয়। আবার কোনো কোনো সময় কম দামে চামড়া কিনে নেয়। আর চামড়া বিক্রি না করেও কোনো উপায় নেই। কারণ এটি একদিন পরেই পচন ধরে দুর্গন্ধ ছড়াবে। পরিকল্পিতভাবে কৌশলে সস্তায় চামড়া বিক্রি করতে বাধ্য করা হয়। প্রক্রিয়াজাত করার পর পুরো ব্যবহার বা দীর্ঘ সময় রাখার উপযুক্ত হওয়ার পরেই শুরু হয় চামড়া পাচারকারীদের তৎপরতা। সাধারণত তিন মাসের মধ্যে চামড়া পাচারের ঘটনাগুলো ঘটে থাকে।
\হগোয়েন্দা সূত্রগুলো বলছে, চামড়া পাচার ঠেকাতে ঈদ-পরবর্তী তিন মাস কঠোর নজরদারি করা হয় সড়ক-মহাসড়ক ও স্থল সীমান্তে। তবে বছরের অন্য সময়ও এমন নজরদারি অব্যাহত রাখার নির্দেশনা থাকে। তবে সেই নির্দেশনা নানা কারণে অনেক সময়ই শতভাগ কার্যকর করা সম্ভব হয় না বা হয়ে ওঠে না।
র্
যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া বিভাগের পরিচালক কমান্ডার আরাফাত ইসলাম যায়যায়দিনকে বলেন, চামড়া পাচারসহ যেকোনো ধরনের অপরাধ দমনের্ যাব সক্রিয়ভাবে কাজ করছে। গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানোর পাশাপাশি নিয়মিত চেকপোস্ট পরিচালিত হচ্ছে। ঈদের পর চেকপোস্টের সংখ্যা আরও বাড়ানোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। বিশেষ নজরদারিতে রয়েছে সীমান্তবর্তী জেলাগুলো।
ঢাকা মহানগর পুলিশের মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশনস বিভাগের উপকমিশনার মো. ফারুক হোসেন যায়যায়দিনকে বলেন, চামড়া পাচাররোধে রাজধানীর পোস্তগোলা, লালবাগ, হাজারীবাগ, সোয়ারীঘাট, সদরঘাট, আশুলিয়া, বেড়িবাঁধ, আমিনবাজার, গাবতলী, সাভার, সাভারের বইলারপুর, আব্দুলস্নাহপুর ও যাত্রাবাড়ীসহ আশপাশের এলাকায় চেকপোস্ট বসানো হবে।
পুলিশ সদর দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, সাভারের বইলারপুরের চেকপোস্টটি পরিচালনা করবে ঢাকা জেলা পুলিশ। গাজীপুরের জয়দেবপুর চৌরাস্তা, মানিকগঞ্জ, পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া, পদ্মা সেতুর উত্তর ও দক্ষিণপ্রান্ত, বঙ্গবন্ধু সেতুর উভয়প্রান্ত, কাঁচপুর ব্রিজসহ ঢাকা-চট্টগ্রাম ও ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের সুলতানা কামাল ব্রিজ এলাকায়ও চেকপোস্ট বসানো হবে। রেলস্টেশন ও লঞ্চ টার্মিনালেও বসানো হবে চেকপোস্ট। পুলিশ ওর্ যাব যৌথভাবে কিংবা আলাদা আলাদাভাবে চেকপোস্ট পরিচালনা করবে।
ইতোমধ্যেই পুলিশ মহাপরিদর্শক চৌধুরী আবব্দুলস্নাহ আল মামুন চামড়াসহ সব ধরনের চোরাচালান ও পাচার ঠেকাতে হাইওয়ে পুলিশসহ পুলিশের সংশ্লিষ্ট ইউনিটগুলোকে কড়া নির্দেশনা দিয়েছেন।
বিজিবি মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আশরাফুজ্জামান সিদ্দিকী ইতোমধ্যেই সীমান্ত রক্ষীবাহিনী বিজিবিকে চামড়া পাচারসহ সব ধরনের পাচার ও চোরাচালান প্রতিরোধে সীমান্তে বিশেষ চেকপোস্ট বসিয়ে তলস্নাশি ও নজরদারি বাড়ানোর কড়া নির্দেশনাও দিয়েছেন।