বগুড়ার সোনাতলা উপজেলায় সরকারি খাদ্যগুদামের ধান ক্রয়ে কৃষকদের লটারির নামের তালিকায় ব্যাপক জালিয়াতির অভিযোগ উঠেছে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে। সরকারিভাবে প্রান্তিক কৃষকদের কাছ থেকে স্বচ্ছভাবে ধান সংগ্রহ করতে অনলাইন (ডিজিটাল) প্রক্রিয়া চালু করা সত্ত্বেও এ তালিকায় ছাত্র, চাকরিজীবী, রাজনৈতিক নেতাকর্মীসহ বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষের নাম উঠেছে। অজানা-অচেনা বিভিন্ন জেলার এসব মানুষের নামে খোলা হয়েছে ব্যাংক অ্যাকাউন্টে। ধান বিক্রির লাখ লাখ টাকা এসব অ্যাকাউন্টে জমা করে উত্তোলনও করা হয়েছে। এ নিয়ে উপজেলার প্রকৃত প্রান্তিক কৃষকদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে।
জানা যায়, প্রকৃত কৃষকদের সুবিধা দিতে এ বছর মোবাইল অ্যাপে অনলাইনে আবেদনের মাধ্যমে লটারিতে ধান ক্রয় শুরু করে সরকার। কিন্তু সোনাতলায় লটারিতে নাম এসেছে রংপুর, দিনাজপুর, সিরাজগঞ্জ, ঠাকুরগাঁওসহ বিভিন্ন জেলার বাসিন্দার। এসব অজানা-অচেনা ব্যক্তির নামে তৈরি হয়েছে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট। কোনো ব্যক্তির অনুপস্থিতিতে, তার ভোটার আইডিসহ প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ছাড়া কীভাবে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট তৈরি হতে পারে তা ভেবে পাচ্ছেন না সচেতনমহল।
নিয়মানুযায়ী খাদ্যশস্য সংগ্রহের নির্দিষ্ট অ্যাপসের মাধ্যমে উপজেলার প্রান্তিক কৃষকরা আবেদন করবেন। নিজ নিজ মোবাইলে ওটিপি প্রাপ্তির মাধ্যমে তথ্য দিয়ে আবেদন সম্পন্ন করবেন কৃষক। আবেদনের সময় শেষ হলে উপজেলা কৃষি অফিসার আবেদনকারীদের তালিকা ধান সংগ্রহ কমিটির সভায় উপস্থাপন করে লটারি করবেন। লটারির মাধ্যমে কৃষককে বাছাই করে তাদের নিকট থেকে সরাসরি ধান সংগ্রহ করা হবে। কিন্তু স্থানীয় কৃষকদের অজান্তে এত ধাপ কিভাবে পার হলো, কৃষকদের মনে এখন সেই প্রশ্ন।
এদিকে লটারির তালিকার ২১৩ সিরিয়ালের মো. নয়ামিয়ার মোবাইল নম্বরে কল দেওয়া হলে তা রিসিভ করেন ঠাকুরগাঁওয়ের সাখাওয়াত নামক এক ব্যক্তি। তিনি বলেন, 'আমি রেল ডিপার্টমেন্টে চাকরি করি এসবের কিছুই জানি না।' তালিকার ২১৪ নম্বরে থাকা ইমান উদ্দিনের মোবাইল নম্বরে কল দিলে তা রিসিভ করে সুখানপুকুরের গোলাম মোস্তফা বলেন, 'এসবের আমি কিছুই জানি না।' ২১২ নম্বরের শাহজাহান আলীর কাছে কল করলে তিনি বলেন, 'আমি মুর্খ মানুষ কিভাবে আবেদন করতে হয় তাই জানি না, ধান দিব কেমনে।'
এ লটারির তালিকায় আমিরুল ইসলাম মোলস্নাকে কল দেওয়া হলে তা রিসিভ করেন গাইবান্ধা জেলার নবম শ্রেণীর ছাত্র রিয়াদ। লটারি জেতার কথা শুনে তিনি আকাশ থেকে পড়েন। কৃষকের নামের তালিকা ধরে অনেকের সঙ্গেই কথা হয়। এদের বেশির ভাগই অন্য জেলা ও উপজেলার বাসিন্দা এবং তারা এসবের কিছুই জানেন না বলে উলেস্নখ করেন।
এ বিষয়ে সোনাতলা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. সোহরাব হোসেন বলেন, 'উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক আমাকে বলেন লটারির সময় শেষ হয়ে যাচ্ছে। আপনি কৃষকদের তালিকাটি অনুমোদন করে দেন। আমি তখন ঢাকায় ছিলাম, একথা শোনার পর আমি সেটির অনুমোদন দিয়েছি। তবে এতবড় জালিয়াতি মেনে নেয়া যায় না। বিষয়টি নিয়ে আমি নিজেও মর্মাহত। এর পর এরকম ভুল হওয়া আর কোনোভাবেই সম্ভব নয়।'
উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক শাহ মো. শাহেদুর রহমান বলেন, 'অনিয়ম হলেও কিছু করার নেই কারণ আমার দায়িত্ব ধান ঠিকভাবে পাচ্ছি কিনা। অন্য কোনকিছু আমার কাজ নয়।'
লটারির তালিকা চাইলে তিনি বলেন, 'এই তালিকা আমাদের ব্যক্তিগত আর এটি কাউকে দিলেও মন্ত্রণালয়ের অনুমতি লাগবে।' তথ্য অধিকার আইনে তালিকা চাইলে তিনি বলেন, 'তথ্য অধিকার বলে কোনো আইন তৈরি হয়েছে এটা আমার জানা নেই।'
তালিকা মেলেনি উপজেলা খাদ্য কর্মকর্তার কাছেও। তিনি বলেন. 'তালিকাটি খুঁজতে হবে কোথায় যে গেলো।'
এ ব্যাপারে অগ্রণী ব্যাংক সোনাতলা শাখা ব্যবস্থাপক মো. আজাদুল ইসলাম বলেন, 'এমন অনিয়ম সব জায়গাতেই হয়। এতে কিছু করার নেই।' কয়েক দিন পর আবারো কথা বললে তিনি বলেন, 'আমাদের এসব বাধ্য হয়েই করতে হয়। কারণ ব্যাংকের বড় পার্টিরা যখন অ্যাকাউন্ট করতে বলে তখন করার কিছুই থাকে না। তারা কাগজপত্র এনে দেয় আমি একাউন্ট করে দেই।'
বগুড়া জেলা খাদ্য কর্মকর্তা মো. হুমায়ুন কবির বলেন, 'বিষয়টি আপনাদের মাধ্যমে জানতে পেরেছি। এ বিষয়ে দ্রম্নত একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হবে। এই ঘটনার সাথে যারা জড়িত তাদের কাউকেই ছাড় দেয়া হবে না।'
সোনাতলা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সাবরিনা শারমিন বলেন. 'এ বিষয়ে আমার কাছেও খটকা লাগছে তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।'
এ সময় কিভাবে তালিকা যাচাই-বাছাই করলেন জানতে চাইলে তিনি বিষয়টি এড়িয়ে যান।
বগুড়া জেলা প্রশাসক মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, 'সরকারিভাবে ধান ক্রয়ের অনিয়মের বিষয়টি জেনে আমি ইতোমধ্যে জেলা খাদ্য কর্মকর্তাকে ব্যবস্থা নিতে বলেছি। তিনি ব্যবস্থা না নিলে একজন এডিসিকে দায়িত্ব দিয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করব। ব্যাংক অ্যাকাউন্ট করার বিষয়টি খুবই ভয়ংকর এ বিষয়েও তদন্ত সাপেক্ষে দ্রম্নত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।'
স্থানীয় কৃষক ও সচেতন মহলের দাবি এমন প্রতারণার সঙ্গে জড়িতদের দ্রম্নত আইনের আওতায় এনে উপযুক্ত বিচারের মাধ্যমে শাস্তি নিশ্চিত করা হোক।