জিনজিরার কামার শিল্পে নেই আগের জৌলুস

ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখতে সরকারের হস্তক্ষেপ চান কামারিরা

প্রকাশ | ১৩ জুন ২০২৪, ০০:০০

মাসুম পারভেজ, কেরানীগঞ্জ (ঢাকা)
'সোনারুর টুকুর টুকুর, কামারের এক ঘা' প্রচলিত প্রবাদটি এখন আর শোনা যায় না। সময় বদলেছে কামারশিল্প এখন বিলুপ্তির পথে। বংশ পরম্পরায় চলে আসা এক সময়ের ঐতিহ্য এখন হারিয়ে যাচ্ছে। মাত্র তিন থেকে চার দশক আগেও কোরবানির ঈদকে ঘিরে টুং-টাং আর টিক-টক শব্দে মুখরিত থাকত কেরানীগঞ্জের জিনজিরার কামারপাড়া। এখানকার তৈরি জিনিসপত্রের কদর ছিল দেশজুড়ে। আগে কোরবানির ঈদের প্রাক্কালে কেরানীগঞ্জের জিনজিরা ইউনিয়নের তাওয়াপট্টি, টিনপট্টি, আগানগর, বাসপট্টি, কাঠপট্টি, থানাঘাট, ফেরিঘাট এলাকার কামারপট্টিতে দাঁড়ানোর জায়গা মিলত না। এখন এখানকার কামাররা সময় পার করছেন চা খেয়ে, আড্ডা দিয়ে। কেউ কেউ কাজ করলেও নেই সেই আগের জৌলুস। এতে পরিষ্কার বোঝা যায়, অনেকটা নেতিয়ে পড়েছে এ ঐতিহ্য। কেউ কেউ বলছেন, আগামী কয়েক বছর পর এখানে কামারপাড়াই থাকবে না। বর্তমানে জিনজিরা কামার শিল্পকে প্রতিনিধিত্ব করে আসছে ঢাকার চকবাজার কামারপট্টি। এই বাজারে ঘুরে দেখা গেছে, প্রায় ২৫টি দোকান এখনো বংশ পরম্পরায় ধরে রেখেছে এই শিল্পের বৈঠা। আধুনিক মেশিনের সাহায্যে তৈরি দা-ছুরির ভিড়ে কামারদের হাতে তৈরি এসব বস্তুর চাহিদা দিনদিন কমছে। মেশিনের তৈরি চকচকে আর বাহারি হাতলের জিনিসই বেশি কিনছে মানুষ। এতে যেমন জৌলুস হারাচ্ছে এ জিনজিরা কামারশিল্প, তেমনি লোহা ও কয়লার দামবৃদ্ধির ফলে এ পেশা থেকে সরে যাচ্ছেন কামারিরা। ৫০ বছরের ঊর্ধ্ব বয়সি রামেন্দ্র কর্মকার বলেন, 'জিনজিরা কামারপট্টি আগে জমজমাট ছিল। সারা বছর কাজ থাকত। ঈদে রোজগারও ভালো হতো। এখন বিভিন্ন কোম্পানি স্টিলের জিনিস বাজারে এনেছে। সেগুলোর দাম আমাদের শ্রমের তুলনায় কম। সেগুলো রেডিমেড পাওয়া যায়। তাই মানুষ এখন আর আমাদের কাছে আসে না। এখন আবার আধুনিক মেশিন দিয়ে বাড়ি বাড়ি গিয়ে দা, ছুরি ধার দিয়ে আসে কিছু লোক। তাই একবার কিছু কিনলে আর আমাদের কাছে আসতে হয় না। এছাড়া ভাঙা জাহাজের লোহার দাম বেড়েছে। যে কারণে অনেক ব্যবসায়ী পুঁজির অভাবে এই কাজ ছেড়ে দিচ্ছেন।' তিনি আরও বলেন, 'বর্তমানে কয়লার দামও দ্বিগুণ হয়েছে। আগে ছিল সাত কেজি ৫০ টাকা এখন ৯০ টাকা। আমাদের কাজ অনুযায়ী দিনে প্রায় ১৫ থেকে ২০ কেজি কয়লা লাগে। আমদানি করা পণ্য হালকা গড়নের হলেও শৌখিন ক্রেতাদের কাছে এগুলোর কদর বেশি। ফলে কামারদের ব্যবসার পরিস্থিতি আগের চেয়ে খারাপ হয়ে পড়েছে।' মৃদুল কর্মকার বলেন, দেশীয় ধারালো সরঞ্জামের পাশাপাশি এখন বিদেশ থেকে আমদানি করা পণ্যের বাজার বাড়ছে। ক্রোকারিজ হিসেবে ধারালো এসব পণ্য আমদানি করা হয়ে থাকে। দেখতে সুন্দর, গড়নে এগুলো হালকা-পাতলা। তবে বড় হাড্ডি কাটতে গেলে ধারালো এসব সরঞ্জাম নষ্ট হয়। নামিদামি রেস্তোরাঁ ও শৌখিন ব্যবহারকারীরা এসব পণ্যের বড় ক্রেতা। তবে এখন কোরবানির ঈদের সময় এসব পণ্য বেশ বিক্রি হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, 'আমাদের তৈরি প্রতিটি চাপাতির দাম আকার ভেদে পড়ছে ৫০০ থেকে ৮০০ টাকা। পশুর চামড়া খোলা ও সাধারণ ব্যবহারের ছুরির দাম ১০০ থেকে ৩০০ টাকা। আর পশু জবাই দেওয়ার ছোরার দাম পড়ছে মানভেদে ৬০০ থেকে হাজার টাকা। দেশি হাত কুড়ালের দাম ৬০০ থেকে ৮০০ টাকা। স্প্রিংয়ের ছুরির দাম শুরু হয় ১৫০ টাকায়। আকারের ওপরে ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকা দাম পড়ে। অন্যদিকে পাকা লোহার ভালো মানের একটা দা কিনতে হলে ক্রেতাকে দিতে হবে ৪০০ থেকে ৬০০ টাকা। কাঁচা লোহায় তৈরি দা সাড়ে ৩৫০ থেকে ৪০০ টাকা। আর বঁটির দাম ৩০০ থেকে হাজার টাকার মধ্যে।' কামার দিদার হোসেন বলেন, 'কামারের ব্যবসা আর আগের মতো নেই। চিন্তা করতেছি পেশা ছেড়ে চলে যাইতে। যে কয়লা আর লোহার দাম তাতে কোনোভাবেই টিকতে পারছি না। তার ওপর মানুষ আমাদের কাছে জিনিস কিনছে না। দোকান থেকে আধুনিক মেশিনের বানানো জিনিস কিনছে। এজন্য ব্যবসায় লোকসান হচ্ছে।' কামারপট্টির ষাটোর্ধ্ব গোপাল কর্মকার জানান, দীর্ঘ ৪০ বছর ধরে এই শিল্পের সঙ্গে আছেন। এক সময় তার দোকানে ১২ জন কর্মচারী থাকলেও বর্তমানে তার দোকানে কর্মচারীর সংখ্যা চারজন। দিন দিন বেচাবিক্রি কমে যাওয়ার অনেকটাই হতাশা প্রকাশ করে গোপাল কর্মকার বলেন, 'এক সময় কাজ কইরা কুল পাইতাম না। কোরবানি আইলে তো দুই মাস আগের থিকা দিন রাইত কাজ করা লাগত। এহন আমাদের তৈরি লোহার জিনিসপত্রের চাহিদা কমে গেছে। বেচাবিক্রি কমে যাওয়ায় আমাগো অনেকেই এ পেশা ছাইড়া দিছে। বাপদাদার পেশা তাই কষ্ট হইলেও কোনমতে ধইরা রাখছি।' বাঁশপট্টি হারুন স্টোরে কর্মচারী সাগর কর্মকার বলেন, 'এ কোরবানির মৌসুমে একটু বেচাবিক্রি ভালো হওয়ার কথা কিন্তু তেমন কাজ বেচাকেনা নেই। বাজারে কারখানায় তৈরি নানারকম জিনিসপত্র চলে আসায় আমাদের হাতে তৈরি জিনিসের কদর কমে গেছে।' শ্রমিক আশাপূর্ণ বলেন, 'আমরা বর্তমানে খুব কষ্টে আছি। জিনিসপত্রের দাম বেশি। কোনোভাবে চলতেছি। মহাজনকে বললে বলে, কয়লার দাম বেশি, লোহার দাম বেশি। বেতন কম তার ওপর মানুষ জিনিস কিনছে না। সব ঘুরে ফিরে ভোগান্তি আমাদেরই। সরকার যদি সাহায্য করতো, আমরা পেশাটা ধরে রাখতে পারতাম।' এ বিষয়ে কেরানীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আবু রিয়াদ বলেন, 'মৃতপ্রায় শিল্পগুলোকে টিকিয়ে রাখতে উপজেলা প্রশাসন থেকে বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কেননা এসব আমাদের ঐতিহ্য। কামার শিল্প, মৃৎশিল্প, কাঠের শিল্প, কুটির শিল্পে যারা জড়িত আছেন আমরা বর্তমানে তাদের সার্ভে করছি এবং বাছাই করছি। আগামী অর্থবছরে তাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছি।' তিনি আরও বলেন, 'যুবউন্নয়ন, সমবায় ও মহিলা অধিদপ্তরের মাধ্যমে তাদের ঋণের ব্যবস্থা করব, যাতে তারা পেশাটাকে কাজে লাগাতে পারেন এবং উন্নতি করতে পারেন।' এদিকে ঢাকার চকবাজার ও নিউমার্কেটের একজন আমদানিকারক হাশেম আলী তালুকদার বলেন, বিদেশি পণ্য আগে শুধু শহরের মধ্যে বেচাকেনা হতো। তবে এখন ঢাকার বাইরের ক্রেতারাও এসব পণ্য কিনছেন। সরাসরি বেচাকেনার বাইরে অনলাইনেও বিক্রি হচ্ছে এসব সরঞ্জাম। দেশীয় প্রতিষ্ঠান প্রাণ-আরএফএলের অ্যাসিস্ট্যান্ট জেনারেল ম্যানেজার (পাবলিক রিলেশন্স) তৌহিদুজ্জামান জানান, দু'টি ব্র্যান্ডের মাধ্যমে তারা ৪৫ টাকা থেকে শুরু করে ৩৫০ টাকার মধ্যে ধারালো ছুরি বা ছোট চাপাতির মতো পণ্য বিক্রি করেন। এসব পণ্য তাদের বিক্রয়কেন্দ্র ছাড়া বাসনকোসন বিক্রির দোকানেও পাওয়া যায়। দেশীয় শিল্প বিকাশের সুযোগ দিতে আমদানি করা ধারালো সরঞ্জামের ওপর উচ্চ হারে শুল্ক আরোপের দাবি জানিয়েছে বেসরকারি এ প্রতিষ্ঠান। ঢাকা জেলা প্রশাসক আনিসুর রহমান বলেন, 'শামার শিল্প আমাদের হাজারও বছরের প্রাচীনতম শিল্পের মধ্যে একটি। আমাদের দৈনন্দিন জীবনে এ শিল্পের গুরুত্ব অপরিসীম। এ শিল্পকে টিকিয়ে রাখা আমাদের সবার দায়িত্ব। আমরা দ্রম্নত জিনজিরা কামার সম্প্রদায়ের সঙ্গে কথা বলে তাদের সমস্যাগুলো সমাধানে ব্যবস্থা নেব।'