তাঁবু টানিয়ে চিকিৎসা

ঢাকায় বাড়ছে ডায়রিয়া রোগী

১২ দিনে ১৫ জনের মৃত্যু , প্রতি ঘণ্টায় ভর্তি ৩৯ রোগী

প্রকাশ | ১৩ জুন ২০২৪, ০০:০০

পাঠান সোহাগ
হঠাৎ রাজধানীতে ডায়রিয়াজনিত রোগের প্রকোপ দেখা দেওয়ায় হাসপাতালে বেড়েছে রোগীর চাপ। ছবিটি বুধবার রাজধানীর মহাখালীর আইসিডিডিআরবি থেকে তোলা -যাযাদি

রাজধানীতে তীব্র গরমের পর বৃষ্টি হওয়ায় ডায়রিয়ায় আক্রান্ত রোগী বেড়েছে। এ সময়ে নিন্ম আয়ের তরুন ও বৃদ্ধরাও আক্রান্ত হয়েছেন বেশি। তবে শিশুরা তুলনামূলক কম আক্রান্ত হয়েছে। এদিকে হাসপাতালে রোগী বৃদ্ধি পাওয়ায় ভবনের বাইরে তাঁবু টানিয়ে রোগীর চিকিৎসা দিয়েছেন এবং অস্থায়ী ক্যাম্প প্রস্তুত করে রেখেছে রাজধানীর মহাখালীতে আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র (আইসিডিডিআরবি)। অন্যদিকে আইসিডিডিআর, বিতে প্রতি ঘণ্টায় গড়ে ভর্তি হচ্ছে ৩৯ জন রোগী। ৩০ মে থেকে ১০ জুন পর্যন্ত মোট ১২ দিনে এ হাসপাতালে রোগী ভর্তি হয়েছে ১১ হাজার ৩৫৮ জন। অর্থাৎ প্রতিদিন মোট রোগী ভর্তি হয়েছে ৯৪৬ জন। আইসিডিডিআর,বির বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলছেন, দেশে প্রতি বছর দুইবার ডায়রিয়ার রোগী বাড়ে। শীতকালে রোগী বাড়লে শীতকালীন আউট ব্যাক ও গ্রীষ্মকালে রোগী বাড়লে গ্রীষ্মকালীন আউট ব্যাক বলা হয়। এ বছর মার্চের ১৩ থেকে ১৬ তারিখ সবচেয়ে বেশি রোগী ভর্তি হয়ে ছিল। ১৬ মার্চ ৭৮৮ জন রোগী ভর্তি হয়। এরপর থেকে রোগী কমতে থাকে। সেটা শীতকালীন আউট ব্যাক ছিল। গ্রীষ্মকালীন আউট ব্যাক শুরু হয়েছে ২৯ মে'র পর থেকে। সেটা এখনও চলমান রয়েছে। এ সময়ের মধ্যে এখনও পিক পর্যায়ে এসেছে কিনা সেটা বলা যাবে না। রোগী আরও বাড়তে পারে। এই সময়ের মধ্যে যদি একদিনে সর্বোচ্চ রোগী ভর্তি হয়, তাহলে আমরা সেটাকে পিক ধরে নিবো। আইসিডিডিআর,বি ঢাকা হাসপাতালের তথ্যমতে, গত মাসের ৩০ মে থেকে ১১ জুন পর্যন্ত মোট ১২ দিনে এ হাসপাতালে রোগী ভর্তি হয়েছে ১১ হাজার ৩৫৮ জন। অর্থাৎ প্রতিদিন মোট রোগী ভর্তি হয়েছে ৯৪৬ জন। ১১ জুন ২৪ ঘণ্টায় রোগী ভর্তি হয়েছে ৭০৩ জন। প্রতিদিন সকাল ৮টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত ও সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা থেকে রাত ১২ টার মধ্যে রোগি বেশি আসে। যাদের শারীরিক পরিস্থিতি ভালো থাকে তাদেরকে সকালে ছুটি দেওয়া হয়। তারা ১০-১১টার মধ্যে হাসপাতাল ছেড়ে চলে যায়। তবে এই ১২ দিনের মধ্যে সবচেয়ে বেশি রোগী ভর্তি হয়েছিল ১ জুন এক হাজার ৩৩০ জন। পরবর্তী চার দিন রোগীর সংখ্যা এক হাজারের বেশি ছিল। এই সময়ে হাসপাতালে আসার পথে ১৪ থেকে ১৫ জনের মৃতু্য হয়েছে। হাসপাতালে নিয়ে এলে চিকিৎসকরা তাদেরকে মৃত ঘোষণা করেন। মৃত ব্যাক্তিদের ডায়রিয়ার পাশপাশি নিউমনিয়া বা সেনোফটোনিয়ায় আক্রান্ত ছিলেন। কিংবা সঠিক সময়ে হাসপাতালে এসে পৌঁছাতে পারেনি। চিকিৎসকরা বলেছেন, গত ১২ দিনের রোগী বাড়ছে। এটা ঈদের আগে কিছুটা কমে যাবে। কিন্তু ঈদের পরে সেটা বাড়ার সম্ভবনা খুবই বেশি। কারণ কোরবানির বর্জ্য খাল বিল হয়ে পানিতে মিশে যাবে। এ ছাড়া পরিবেশ দূষণ বাড়বে। এতে সংক্রামক রোগ ছড়িয়ে পড়ার সম্ভবনা থাকে। এ ছাড়া গরুর হাট শেষ হলে সেটাও ভালো করে পরিষ্কার করে মাটিতে পুঁতে রাখতে হবে। এখন যারা গরুর হাটে কাজ করছেন তাদের বারবার হাত ধুতে হবে, খোলা জায়গার খাবার খাওয়া যাবে না। থাকার পারিবেশ ভালো রাখতে হবে। এক কথায় হেলথ হাইজিনিং মেইনটেইন করে চলতে হবে। আইসিডিডিআরবি ঢাকা হাসপাতালের এসিস্টেন্ট সায়েন্টিস্ট ডা. শোয়েব বিন ইসলাম যায়যায়দিনকে বলেন, 'এখন গ্রীষ্মকালীন আউট ব্যাক চলছে। ঈদের আগে রোগী কমবে। তবে ঈদের পরে রোগী বাড়ার সম্ভবনা রয়েছে। দেশের জনগণ যদি সচেতন থাকে তাহেল ঈদ পরবর্তী সময়ে ঝুঁকি কমবে। গ্রীষ্মকালীন আউট ব্যাক চলমান রয়েছে। এ সময়ের মধ্যে এখনো পিক আসছে কিনা সেটা বলা যাচ্ছে না। আবার রোগী বাড়ার সম্ভবনা রয়েছে।' পঞ্চগড় তেঁতুলিয়া এলাকার ভ্যানচালক রেজাউল করিম ১৮ মাসের মেয়ে মরিয়ম রেজাকে ভর্তি করেছেন আইসিডিডিআর, বিতে। সরেজমিনে হাসপাতালের বাইরে কথা হয় রেজাউল করিমের সঙ্গে। তিনি বলেন, 'রোগী না থাকলে এই জায়গায় কেউ আসে। মেয়ের তিন দিন ধরে পাতলা পায়খানা। সকালে নিয়ে এসেছি। এখন ঘুমিয়ে আছে। অবস্থার উন্নতি হয়নি'। গাজীপুর থেকে ৬৫ বছর বয়সের আব্দুল গফুরকে নিয়ে এসেছে ছেলে মুনসুর আলী। তিনি বলেন, 'সকালে এখানে বাবাকে নিয়ে এসেছি। বাবা কিছুই খেতে পারে না। কিছু খেলেই পাতলা পায়খানা আর বমি হয়।' বসুন্ধরা এলাকার ৪৭ বছরের বিলস্নাল শেখ ডায়রিয়া আক্রান্ত হলে পরিবারের সদস্যরা আইসিডিডিআরবিতে নিয়ে আসে। তিনি নিজেই বলেন, 'দুই দিন বমি ও পাতলা পায়খানা হলে ছেলেমেয়ে আমাকে এখানে নিয়ে আসা হয়। আমি আমি এখন ভালো আছি।' ডা. শোয়েব বিন ইসলাম বলেন, 'এবার যারা ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়েছেন তাদের মধ্যে ২৫ শতাংশ রোগী তীব্র পানি শূন্যতায় ভুগছিলেন। ৫০ শতাংশ রোগী মাঝারি ও মৃদু পানি শূন্যতায় ছিলেন। এছাড়া বাকি ২৫ শতাংশ সাধারণ ডায়রিয়ার রোগী ছিলেন। ডায়রিয়ার উপসর্গ দেখা দিলে সঠিক সময়ে কেউ যদি হাসপাতালে এসে পৌঁছাতে পারে এবং সঠিক চিকিৎসা পায় তা হলে মৃতু্যও কম হবে।' আইসিডিডিআরবি ঢাকা হাসপাতালের প্রধান ডা. বাহারুল আলম যায়যায়দিনকে বলেন, 'আমাদের চলতি মাসের ১ তারিখে সবচেয়ে বেশি রোগী ছিল। এটাকে গ্রীষ্মকালীন পিক বলা যেতে পরে। তবে ঈদের পরে রোগী বাড়বে কিনা সেটা বলা যাচ্ছে না। তবে জীবাণু যদি ছড়িয়ে পরে বা থেকে যায় সেটা আবার বাড়তে পারে। এ জন্য সচেতনতা খুবই জরুরি। এ বছরের সেপ্টম্বর ও অক্টোবর মাসে আরেকটা আউট ব্যাক আসবে।' বিশেষজ্ঞ চিৎসকরা বলছেন, গ্রীষ্মকালে তাপমাত্রা ৩৪ থেকে ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি পেলে। পাশাপাশি বৃষ্টি হলে ডায়রিয়ার জন্য দায়ী জীবাণুগুলো শক্তিশালী হয়ে থাকে। এমনকি চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। পানি ও ঠান্ডা-বাসি খাবারে মাধ্যমে এ জীবাণু মানুষের শরীরে প্রবেশ করে। এ ভাইরাস তরুণ ও বয়স্কদের আক্রান্ত করছে। তাই এ সময়ে রাস্তার ধারে বিক্রি হওয়া বিভিন্ন ধরনের শরবত, খাবার, চা স্টলের চা ও বেলপুরি, ফুসকা খাওয়া থেকে বিরত থাকতে পরামর্শ দিয়েছেন।