দলিল বাতিলের নির্দেশ মানছে না সাব-রেজিস্টার অফিস
চট্টগ্রামের চান্দগাঁওয়ে ভূমিদসু্যদের আরও জাল-জালিয়াতির তথ্য উদ্ঘাটন
এ ধরনের জাল জালিয়াতির মাধ্যমে অর্জিত অর্থ বিদেশে পাচার করা হচ্ছে বলে খবর পাওয়া গেছে। স্থানীয়রা এ বিষয়টি সুষ্ঠু তদন্তের জন্য দুদক বরাবর লিখিত আবেদন জানিয়েছেন
প্রকাশ | ১০ জুন ২০২৪, ০০:০০
চট্টগ্রাম বু্যরো
চট্টগ্রাম নগরের উত্তর চান্দগাঁও বড়বাড়ী নাথপাড়া এলাকায় চলছে ভূমিদসু্যদের মহোৎসব। জাল জালিয়াতির ভিত্তিতে অর্পিত সম্পত্তি বিক্রির মাধ্যমে হাতিয়ে নিচ্ছে বিপুল অর্থ। অতিসম্প্রতি এই চক্রের বিরুদ্ধে এ ধরনের দলিল জাল জালিয়াতির আরও একটি চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া গেছে।
এদিকে জেলা প্রশাসন ওই চক্রের জাল দলিল বাতিলের নির্দেশ দিলেও চট্টগ্রাম সাব-রেজিস্ট্রি অফিস তা মানছে না বলে অভিযোগ উঠেছে। এ ধরনের জাল জালিয়াতির মাধ্যমে অর্জিত অর্থ বিদেশে পাচার করা হচ্ছে বলে খবর পাওয়া গেছে। স্থানীয়রা এ বিষয়টি সুষ্ঠু তদন্তের জন্য দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) বরাবর লিখিত আবেদন জানিয়েছেন।
হাইকোর্টের নির্দেশনায় ভূমিদসু্যদের বিরুদ্ধে চান্দগাঁও থানায় মামলা হলেও প্রশাসনের কার্যকর কোনো তৎপরতা না থাকায় তারা দিন দিন আরও বেপরোয়া হয়ে উঠছে।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, এই ভূমিদসু্য চক্রের বিরুদ্ধে ক্রিমিনাল কেসসহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হাইকোর্টের নির্দেশনার প্রায় চার মাস পর চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের ভিপি শাখার নির্দেশক্রমে ২৫ এপ্রিল চান্দগাঁও সার্কেলের সহকারী কমিশনারের (ভূমি) পক্ষে চান্দগাঁও থানায় মামলা দায়ের করা হয়।
মামলায় আসামি করা হয় উত্তর চান্দগাঁও বড়বাড়ী নাথ পাড়ার মৃত সুবল চন্দ্র নাথের পুত্র তপন কুমার নাথ ও স্বপন কুমার নাথ, হিমাংশু বিমল নাথে পুত্র শিমুল কান্তি নাথ ও কমল দেবনাথ, বিশ্বেসর নাথের পুত্র কৃষ্ণ নাথ, নিকুঞ্জ দেবনাথের পুত্র রূপন দেবনাথ, দুলাল নাথের পুত্র দেবরাজ নাথ, মৃত জলধর দেবনাথের পুত্র সুভাষ চন্দ্র দেবনাথ, শংকর দেবনাথ, তাপস দেবনাথ ও পংকজ দেবনাথ।
তারা ২০ ও ২৬ এপ্রিল হাইকোর্টের বিচারপতি মো. রেজাউল হাসান ও ফাহামিদা কাদেরের আদালতে জামিনের আবেদন করলে তা প্রত্যাখ্যান করা হয়। তারা প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়ালেও পুলিশ গ্রেপ্তারে ব্যর্থ বলে স্থানীয়দের অভিমত।
এ ছাড়া চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের ভিপি শাখা গত ১২ মে ভূমিদসু্যদের বিক্রি করা অর্পিত সম্পত্তির দলিল বাতিলের নির্দেশ জারি করলেও চান্দগাঁও থানা সাব রেজিস্টার এখনো কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি।
অনুসন্ধানে ভূমিদসু্যদের জাল জালিয়াতির আরেকটি তথ্যে দেখা যায়, ১৯৯৮ সালের ৮ এপ্রিল মামলার আসামি সুভাষ দন্দ্র দেবনাথ, শংকর দেবনাথ, তাপস দেবনাথ ও পংকজ দেবনাথের পিতা মৃত জলধর দেবনাথের ক্রয় করা অর্পিত সম্পত্তির দলিলে উলেস্নখ করা হয় উক্ত সম্পত্তি ১৯৫১ সালের ২১ জুন ৩৪০৫ নম্বর কবলা মূলে বিন বালা দেবী নামে বিক্রি করা হয়। অথচ ১৯৫১ সালের ২১ জুনের ৩৪০৫ নম্বর কবলা সংগ্রহ করে দেখা যায় উক্ত জায়গার কবলার গ্রহিতা চট্টগ্রামের বোয়ালখালী উপজেলার বাচা মিয়ার পুত্র মিয়া মাঝি। দাতা চট্টগ্রাম নগরের পাঁচলাইশ এলাকার মরহুম মুন্সি মকবুল আলীর পুত্র মো. আব্দুল লতিফ। ভুয়া দলিলের ভিত্তিতে তাদের বিভিন্ন জায়গা জমি বেচাকেনা ও দখলের ঘটনায় স্থানীয়রা বিস্ময় প্রকাশ করেছেন।
এদিকে ভুক্তভোগীরা জানান, ভূমিদসু্যরা জাল জালিয়াতির মাধ্যমে অর্পিত সম্পত্তি বিক্রি করে কোটি কোটি টাকা পাচার করছেন। অথচ তারা ধরাছোঁয়ার বাইরে। জমি বিক্রির টাকা কোথায় রেখেছে এবং কোন খাতে ব্যয় করেছে, তা খতিয়ে দেখলে পাচারের বিষয়টি উদ্ঘাটিত হবে। পাশাপাশি অধিকতর তদন্তে অর্পিত সম্পত্তির বেচা বিক্রির আরও চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে আসবে।
উলেস্নখ্য, চান্দগাঁও সার্কেল ভূমি অফিসের কর্মকর্তার প্রতিবেদনেও অর্পিত সম্পত্তি বিক্রির সত্যতা উলেস্নখ রয়েছে। এই প্রতিবেদনে উলেস্নখ করা হয়, অর্পিত সম্পত্তির লিজ গ্রহণকারী প্রিয়তোষ নাথ জানান, চট্টগ্রাম মহানগরীর উত্তর চান্দগাঁও বড়বাড়ী নাথপাড়া এলাকার হ
তপন কুমার নাথ (৬৪) ও স্বপন নাথসহ (৬২) স্থানীয় দুষ্কৃতকারীদের সংঘবদ্ধ একটি সিন্ডিকেট পাকিস্তান আমলে ঘোষিত মূল্যবান অর্পিত সম্পত্তি বিক্রি করে কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার কর্মকান্ডে লিপ্ত রয়েছে। ইতোমধ্যে তারা জাল কবলা ও খতিয়ানে শিমুল কান্তি নাথ (৫০) নামে এক ব্যক্তির কাছে ০১৭১ শতাংশ জমি ৩৩ লাখ ৬২ হাজার টাকায় বিক্রি করেছেন। একইভাবে কৃষ্ণ নামে এক ব্যক্তির কাছেও ০১৬০.১ শতাংশ নাল জমি ১০ লাখ টাকায় বিক্রি করেছেন। যার উপর শিমুল কান্তি নাথ চার তলা ভবন ও কৃষ্ণ একাধিক পাকা গৃহ- দোকানপাট নির্মাণ করে জোরপূর্বক ভোগ দখল করে আসছেন। একইভাবে তপন কুমার নাথ ও স্বপন নাথ ০.০১৫০ একর জমি দখল করে সেমিপাকা দোকান ও ভাড়া ঘর নির্মাণ করে ভোগ দখল করে আসছেন।
এ নিয়ে গত বছর ২৫ মে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের ভিপি শাখায় একটি অভিযোগ দায়ের করেন ঘোষিত অর্পিত সম্পত্তির মালিকপক্ষের ওয়ারিশ নয়ন দেবনাথ। যার মামলা নং ৮৩/৮০-৮১, ৮৩/৮১০৮২।
অভিযোগে বলা হয়, চান্দগাঁও অফিসের আওতাধীন চান্দগাঁও মৌজার আর, এস খতিয়ান নং ৩৪৯৭ আর, এস দাগ নং ২৪৪৮ বি.এস দাগ নং ১২৬৮, জমির পরিমাণ ০.০১৭১ একর বাড়ি ভিটা ও ৭০৮ বর্গফুট পাকা গৃহ শ্রেণির ভূমি জনৈক তপন কুমার নাথ কর্তৃক জালিয়াতিক্রমে অবৈধভাবে দলিল সৃজন করে হস্তান্তর করেছেন। মামলাটি তদন্ত করে চান্দগাঁও সার্কেলের সহকারী ভূমি কমিশনারকে প্রতিবেদন প্রেরণের আদেশ দেওয়া হয়।
কিন্তু দীর্ঘদিন অতিবাহিত হওয়ার পর বিষয়টি চান্দগাঁও ভূমি অফিসের ভূমি সহকারী কর্মকর্তা মো. ইমাম উদ্দিন তদন্ত করে গত বছর ১৫ নভেম্বর চান্দগাঁও সার্কেলের সহকারী ভূমি কমিশনারের কাছে প্রেরণ করেন। সহকারী ভূমি কমিশনার ফেরদৌস আরা প্রতিবেদনটি ভিপি শাখায় প্রেরণ করেন। এই প্রতিবেদনে জাল জালিয়াতির মাধ্যমে ভুয়া কবলা ও খতিয়ান সৃজন করে এই অর্পিত সম্পত্তি বিক্রির সত্যতা পাওয়ার তথ্য উলেস্নখ রয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, বর্ণিত বি. এস ৩০০৪নং খতিয়ানে ১২৬৮ দাগের ০.১৪ একর জমি শ্রেণি বাড়ি হিসেবে নিকুঞ্জ দেবনাথ গং (আট আনা) ও সুবল চন্দ্র নাথ। (চার আনা), পিং-ব্রজ নাথ, জ্ঞানদা বালা দেবী। (চার আনা), জং- শশী মোহন নাথ হাল সাং বাংলাদেশ সরকার। (আট আনা) হিস্যাংশ ভারত পক্ষে বাংল মতে শুদ্ধরূপে জরিপ লিপি চূড়ান্ত প্রচারিত আছে। কিন্তু বি. এস মালিক সুবল চন্দ্র নাথ ও ৬ সেপ্টেম্বর ১৯৬৫ হতে ১৬ ফেব্রম্নয়ারি ১৯৬৯ তারিখের মধ্যে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান তথা স্বদেশ ত্যাগ করে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের নাগরিকত্ব গ্রহণ করেন। ফলে নালিশি দাগের (আট আনা) অংশ ০.০৭ একর ও অন্যান্য দাগাদির সম্পত্তিসহ সরকার কর্তৃক অনাবাসিক সম্পত্তি হিসেবে ভিপি শুমারি তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়। ভারতবাসী সুবল চন্দ্র নাথের সম্পত্তি ভিপি ক তালিকার গেজেটে সার্কেস্ট পি. এস ৬১৭ নম্বর খতিয়ানভুক্ত পি. এস ১৬৬৭ দাগের সামিল বি. এস ১২৬৮ দাগের আন্দর ০.০৭ একর ও অন্যান্য দাগাদির জমিসহ মোট ১.৫৫৫০ একর জমি গেজেট তালিকার পৃষ্ঠা নম্বর- ৯২৪৮ ও ৯২৪৯ এবং ক্রমিক নং-২৮৯ এ অন্তর্ভুক্ত হয়। উক্ত ভিপি সম্পত্তিতে সরকারের যাবতীয় ঋতু স্বার্থ দখল ও নিয়ন্ত্রণ বিদ্যমান থাকাবস্থায় ভারতবাসী সুবল চন্দ্রের ওয়ারিশরা সম্পূর্ণ বেআইনিভাবে এবং জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে সরকারি ক তালিকাভুক্ত ভিপি সম্পত্তি রেজিস্ট্রি দলিল নং- ৬১৭৪/২০২২ তাং-১৮/১০/২০২২ মূলে ০.০১৭১ একর জমি জনৈক শিমুল কান্তি নাথ, পিতা- হিমাংসু বিমল নাথ বরাবর বিক্রি করেন।
তর্কিত ভিপি সম্পত্তি ওয়ারিশ সূত্রে বিক্রি করার আইনগত অধিকার কবলাদাতা সুবল চন্দ্র নাথের সন্তান তপন কুমার নাথ ও স্বপন নাথ নেই। তর্কিত সম্পত্তি ডিপি মামলা নং- ৮৩/৮০-৮১ মূলে সরকারের ইজারাকৃত সম্পত্তি হওয়ায় আলোচ্য বি. এস ১২৬৮ দাগের আন্দর ০.০১৭১ একর জমি নিয়ে সৃজিত বিক্রীত দলিল নং-৬১৭৪, তারিখ- ১৮/১০/২২ জাল ফেরবী এবং কু-উদ্দেশ্যে সরকারি দ্বার্থ গ্রাস করার সামিল মর্মে প্রতীয়মান হয়।
তদন্তকালে একই ভিপি মামলাভুক্ত বি. এস ১২৮৩ দাগের আন্দর ০.০১৬০ একর ভিপি সম্পত্তি অভিযুক্ত ব্যক্তিরা জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে অন্য একটি রেজিস্ট্রি দলিল নম্বর-৬৮১৯, তারিখ-১৩/১১/২০২২ মূলে হস্তান্তরের প্রমাণ পাওয়া যায়। এই অফিসের রেজিস্টার ২ (তলববাকি) পরীক্ষান্তে দেখা যায়, অভিযুক্ত ব্যক্তিরা বর্ণিত ভিপি সম্পত্তির ভূমি উন্নয়ন কর কিংবা লিজ ফি পরিশোধ করেননি। সরেজমিন তদন্ত করে দেখা যায়, তর্কিত বি. এস ১২৬৮ দাগের ০.১৪ শতক জমিতে শিমুল দেবনাথ, পিতা-হিমাংসু নাথ, ০.০২ (ভিপি সম্পত্তি) জমির ওপর ৪ (চার) তলা ভবন, প্রদীপ নাথ, পিতা- মৃত প্রসন্ন নাথ ০.০২ একর (মালিকানা সম্পত্তি) জমির ওপর সেমিপাকা ঘর, তপন কুমার নাথ, স্বপন নাথ, পিতা- সুবল নাথ ০.০১৫০ একর (ভিপি সম্পত্তি) জমির ওপর সেমিপাকা দোকান ভাড়া ঘর, রতন দেবনাথ গং, পিতা-মৃত শশাংক নাথ ০.০১৫০ একর (মালিকানা সম্পত্তি) জমির বেড়ার ঘর, দুলাল কুমার নাথ, পিতা- নন্দ কুমার নাথ ০.০১৫০ একর (মালিকানা সম্পত্তি) জমির ওপর দোতলা পাকা ঘর, মন্ট গং, পিতা- প্রফুল নাথ, ০.০১ একর (ভিপি সম্পত্তি) জমির ওপর বেড়ার ঘর, দুর্গা মন্দির ০.০২৫০ একর (ভিপি সম্পত্তি) জমির উপর, বিপস্নব নাথ ও রাসেল নাথ, পিতা- হরি শংকর নাথ ০.০১ একর (মালিকানা সম্পত্তি) জমির ওপর সেমিপাকা ঘর ও খালি জমি, সুনীল গং, পিতা- মৃত রেবতী মোহন নাথ ০.০১ একর (মালিকানা সম্পত্তি) খালি জায়গা দখলে আছেন। এমতাবস্থায় দাখিলীয় দলিলপত্র, ভিপি ক তফসিলের গেজেট তালিকা, রেজিস্ট্রি দলিল নং-৬১৭৪, তারিখ- ও ৬৮১৯, তারিখ-১৩/১১/২০২২, পি. এস ও বি. এস খতিয়ান ও বাস্তব দখল সার্বিক পর্যালোচনায় দাখিলীয় অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায়। সরকারি ভিপি এ সম্পত্তি অবৈধ দখলকার ও জাল জালিয়াতির মাধ্যমে। নানা রকম ফেরবী দলিল সৃজন করার দায়ে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে।
অভিযোগ রয়েছে, চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের ভিপি শাখার অফিস সহকারী আনোয়ার হোসেন ও মো. হেনার সহযোগিতায় অর্পিত সম্পত্তি শাখার একাধিক কর্মকর্তা তপন কুমার নাথ ও স্বপন নাথের নেতৃত্বে পরিচালিত ভূমিদসু্য সিন্ডিকেটে জড়িত। এ ছাড়া প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিলেও কোনো ব্যবস্থা নেয়নি চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ।