এমপি আনার হত্যা
'মাস্টারমাইন্ড' শাহীনকে ফেরাতে ভরসা ইন্টারপোল ও ভারত
সিয়ামকে নিয়ে কলকাতার খালে তলস্নাশি, মিলেছে হাড়গোড়
প্রকাশ | ১০ জুন ২০২৪, ০০:০০
গাফফার খান চৌধুরী
ঝিনাইদহ-৪ আসনের আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনার হত্যার অন্যতম আসামি সিয়ামকে নিয়ে কলকাতার বাগজোলা খালে তলস্নাশি চালিয়ে হাড়গোড় উদ্ধার করা হয়েছে। সেগুলো আনারের বলে দাবি করেছে সিয়াম। বিষয়টি নিশ্চিত হতে উদ্ধার হওয়া হাড় পরীক্ষার জন্য ফরেনসিক ল্যাবরেটরিতে পাঠানো হয়েছে বলে তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট উচ্চ পর্যায়ের এক সূত্রে জানা গেছে, সিয়ামের সূত্র ধরেই আনার হত্যার মাস্টারমাইন্ড আখতারুজ্জামান শাহীনকে হেফাজতে পাওয়ার চেষ্টা করছে তদন্তকারীরা। তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রয়েছেন বলে অনেকটাই নিশ্চিত হওয়া গেছে। এমপি আনার হত্যাকান্ডের ইসু্যতে আন্তরিকতা দেখিয়েছে মার্কিন প্রশাসন। এজন্য স্বল্প সময়ের মধ্যেই হয়তো শাহীনকে ভারতীয় তদন্তকারীরা পেয়ে যেতে পারেন। তাকে আইনের আওতায় আনার মূল কাজটি করছে পুলিশের আন্তর্জাতিক সংস্থা ইন্টারপোল ও ভারত সরকার। এ ছাড়া কৌশলে শাহীনকে আমেরিকা থেকে পার্শ্ববর্তী কোনো দেশে পাঠিয়ে দেওয়া হতে পারে। যাতে তদন্তকারীরা সহজেই তাকে হেফাজতে নিতে পারেন।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, শনিবার সিয়ামকে ১৪ দিনের রিমান্ডে পেয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে কলকাতার সিআইডি পুলিশ। পরে তাকে নিয়ে রোববার সকাল ৯টা থেকে সিআইডি ও ভারতীয় ডুবুরিরা কলকাতার বাগজোলা খালে অভিযান শুরু করে। অভিযান চলে দুপুর পর্যন্ত। অভিযানে কলকাতার ভাঙড়ের পোলেরহাট থানা এলাকার কৃষ্ণমাটি এলাকায় অবস্থিত বাগজোলা খালে অভিযান চালায়। তলস্নাশির এক পর্যায়ে খালের পাড়ের একটি ঝোঁপের পাশ থেকে বেশকিছু হাড় উদ্ধার হয়। হাড়গুলো মানুষের বলে অনেকটাই নিশ্চিত তদন্তকারীরা। সিয়ামও হাড়গুলো হত্যাকান্ডের শিকার এমপি আনারের বলে দাবি করেছেন। বিষয়টি নিশ্চিত হতে উদ্ধার হওয়া হাড় পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়েছে ফরেনসিক ল্যাবরেটরিতে। এদিকে ডিএনএ পরীক্ষার জন্য এমপি আনারের মেয়েকে কলকাতায় গিয়ে নমুনা দিতে বলা হয়েছে।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, এর আগে কসাই জিহাদের তথ্যমতে একই খাল থেকে নৌ-বাহিনীর ডুবুরিরা ও সিআইডির টিম বাগজোলা খালে তলস্নাশি চালিয়ে একটি হাড়ের টুকরো ও দুটি ছুরি উদ্ধার করে। হাড়টি আনারের কিনা এবং উদ্ধার হওয়া চাপাতি আনার হত্যাকান্ডে ব্যবহৃত হয়েছে কিনা তা নিশ্চিত হতে সেগুলো পরীক্ষার জন্য ফরেনসিক ল্যাবরেটরিতে পাঠানো হয়েছে।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট উচ্চ পর্যায়ের সূত্রে জানা গেছে, রিমান্ডে পেয়ে সিয়ামকে কলকাতা পুলিশ ও দেশটির বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা জিজ্ঞাসাবাদ করে যাচ্ছে। এর আগে রিমান্ডে কসাই জিহাদ যে তথ্য দিয়েছে, সেই তথ্যের সঙ্গে সিয়ামের দেওয়া তথ্য ১
মিলে গেছে। সিয়াম আনার হত্যার শুরু থেকে লাশ গুম পর্যন্ত প্রতিটি কাজের সঙ্গে জড়িত ছিলেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, গ্রেপ্তারের আগ পর্যন্ত সিয়ামের সঙ্গে শাহীনের সার্বক্ষণিক যোগাযোগ থাকার তথ্য পাওয়া গেছে। তথ্য মোতাবেক শাহীন বর্তমানে আমেরিকায় রয়েছেন বলে জানা গেছে। তবে দেশটির ঠিক কোন রাজ্যে বা জায়গায় অবস্থান করছেন, সে বিষয়ে সুষ্পষ্ট কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। তা জানার চেষ্টা চলছে। সিয়ামের মাধ্যমে শাহীনের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা চলছে। তবে তেমন কোনো সাড়া মিলছে না। কারণ শাহীন ইতোমধ্যে সিয়ামের গ্রেপ্তারের বিষয়টি নিশ্চিত হয়েছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।
সূত্রটি বলছে, আমেরিকার সঙ্গে বাংলাদেশের বন্দি বিনিময় চুক্তি না থাকলেও ভারতের আছে। যে কারণে বাংলাদেশের তরফ থেকে শাহীনকে পাওয়া কঠিন। তবে আমেরিকা থেকে শাহীনকে পাওয়া ভারতের জন্য অনেকটাই সহজ। শাহীনকে পেতে শেষ ভরসা এখন পুলিশের আন্তর্জাতিক সংস্থা ইন্টারপোল ও ভারত সরকার। বাংলাদেশ সরকার ইন্টারপোল ও ভারতের সঙ্গে এ ব্যাপারে যোগাযোগ বাড়িয়েছে।
দায়িত্বশীল এক উচ্চ পর্যায়ের সূত্র বলছে, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে দেশটিতে সফরে থাকা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এমপি আনার হত্যার ইসু্যতে আলোচনা হওয়ার কথা রয়েছে। এ ছাড়া ইন্টারপোল শাহীনের অবস্থান নিশ্চিত করার পাশাপাশি ধরিয়ে দিতে কাজ করে যাচ্ছে। শাহীনকে পেতে ভারতের প্রশাসন ইতোমধ্যে কয়েক দফায় নানাভাবে সরাসরি কথা বলে ও বিশেষ বার্তা পাঠিয়ে যোগাযোগ করেছে। আমেরিকার তরফ থেকেও শাহীনকে ধরিয়ে দিতে বা তদন্তকারী ভারতীয় সংস্থার কাছে হস্তান্তর করতে ইতিবাচক মনোভাব পোষণ করেছে। ইতোমধ্যে দেশটির তরফ থেকে ইতিবাচক সাড়াও এসেছে। স্বল্প সময়ের মধ্যেই হয়তো শাহীনকে পেয়ে যেতে পারে আনার হত্যাকান্ডে ভারতীয় তদন্তকারীরা।
সূত্রটি জানিয়েছে, ইন্টারপোলের পাশাপাশি চলছে কূটনৈতিক তৎপরতাও। বাংলাদেশ ও ভারত একক এবং সম্মিলিতভাবে আমেরিকার সঙ্গে শাহীনকে ফেরত পেতে নানাভাবে কূটনৈতিক তৎপরতা বা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ভারতের সঙ্গে বন্দি বিনিময়ের পাশাপাশি ভিন্ন কৌশলের বিষয়েও আলোচনা চলছে। তারই অংশ হিসেবে শাহীনকে আমেরিকা থেকে অন্য কোনো সুবিধাজনক দেশে পাঠানো হতে পারে। যেখান থেকে বাংলাদেশ বা ভারত সহজেই শাহীনকে পেতে পারে। পুরো বিষয়টির ছঁক সাজাচ্ছে মার্কিন প্রশাসন। আমেরিকার সঙ্গে আনার ইসু্যতে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ অব্যাহত আছে। বিষয়টি সময় সাপেক্ষ হতে পারে।
সূত্রটি বলছে, শাহীনকে হেফাজতে না পাওয়া পর্যন্ত আনার হত্যাকান্ডের প্রকৃত রহস্য জানা সম্ভব নয়। কারণ শুধু ব্যবসায়িক দ্বন্দ্ব বা টাকার জন্য বা স্বর্ণ চোরাচালানের সূত্র ধরে একজন সিটিং এমপিকে অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে বাংলাদেশ থেকে ভারতে নিয়ে হত্যাকান্ডের ঘটনাটি ঘটেনি বলে তদন্তকারীদের ধারণা। বিদেশি বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থাও এমনটাই ধারণা করছে। এ ছাড়া হত্যাকান্ডের ধরন বা নৃশংসতা প্রমাণ করে, এর পেছনে আরও কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী জড়িত থাকতে পারে। এমন হত্যাকান্ডের পেছনে গভীর কোনো কারণ থাকাটাই স্বাভাবিক। আনার হত্যাকান্ডের প্রকৃত রহস্য উদ্ঘাটন করা সম্ভব হলে বাংলাদেশের জনপ্রতিনিধি ছাড়াও রাজনৈতিকসহ নানা বিষয়ে অনেক অজানা রহস্য ও তথ্য বেরিয়ে আসবে বলে তদন্তকারীদের ধারণা। এজন্য শাহীনকে গ্রেপ্তার করে হেফাজতে নিতে চলছে ব্যাপক তোড়জোড়।
\হ