দুই দশকে দাম বেড়েছে ৬গুণ সংসার চালাতে পেশা বদলের চিন্তা জেলেদের

ইলিশের জৌলুস হারাচ্ছে চাঁদপুর

প্রকাশ | ০৮ জুন ২০২৪, ০০:০০

আল ইমরান শোভন, চাঁদপুর
মেঘনা থেকে ইলিশ ধরার পর চাঁদপুর বড় স্টেশন মাছঘাটে বিক্রি করেন ব্যবসায়ীরা। ছবিটি শুক্রবার তোলা -যাযাদি
ইলিশের জেলা খ্যাত চাঁদপুরে এখন ইলিশ দুষ্প্রাপ্য হয়ে উঠেছে। সুদীর্ঘকাল থেকে চলে আসা চাঁদপুরে জৌলুস হারাতে বসেছে ইলিশ। প্রতিবছর সরকারি খাতায় উৎপাদন বৃদ্ধি পেলেও জেলেরা বলছেন, আগের মতো ইলিশ উঠছে না জালে। চাঁদপুরের পদ্মা-মেঘনা হয়ে পড়ছে ইলিশশূন্য। ইলিশের চাহিদা আর জোগানের বিপরীতে দাম ছুঁয়েছে আকাশচুম্বী। চাঁদপুর বড় স্টেশন মাছঘাটে ২০১১ সালেও ১ কেজি ওজনের একটি ইলিশ কেনা যেত ৭০০ থেকে ৮০০ টাকায়। একই ওজনের একটি মাছ কিনতে এখন গুনতে হচ্ছে ২০০০ থেকে ২ হাজার ২শ' টাকা। হোটেল মালিক মো. শাহজাহান। দীর্ঘ ৫০ বছর যাবৎ ব্যবসায় করছেন চাঁদপুরের বড়স্টেশন মাছঘাট এলাকায়। তিনি বলেন, 'মাত্র দুই দশক আগেও বড় সাইজের ভাজা ইলিশের ১ টুকরো বিক্রি করতেন ৪০ থেকে ৫০ টাকায়। এখন তা খেতে গেলে গুনতে হয় ৩শ' থেকে সাড়ে ৩শ' টাকা। একই পরিমাণ অর্থে আগে আস্ত একটি ইলিশ মাছ কেনা যেত। অতিরিক্ত দামের কারণে অনেকেই এখন মন ভরে ইলিশ খেতে পারেন না।' শাজাহান বলেন, 'ইলিশ মাছের দাম আগের তুলনায় অনেক বেড়েছে। ছোট সাইজের ইলিশের পিস ১০০ টাকায় বিক্রি করি। তবে মাছের দাম বাড়ায় অনেক কাস্টমাররা খেতে এসে দামাদামি করেন।' এদিকে, কাঙ্ক্ষিত ইলিশ না পেয়ে বছরজুড়ে পদ্মা-মেঘনা নদীতে মাছ ধরতে নামা জেলেদের অবস্থা করুণ থেকে আরও করুণ হচ্ছে। বিভিন্ন এনজিও ও মহাজনদের কাছে করা তাদের ঋণের তালিকাও হচ্ছে দীর্ঘতর। ভাটি অঞ্চলে অতিরিক্ত জাল ফেলা, জাটকা নিধন, দূষণ আর অসংখ্য ডুবোচরসহ নানা কারণে ক্রমেই কমে যাচ্ছে নদীর মাছ। এতে নদীনির্ভর জেলেদের জীবন হয়ে উঠছে দুর্বিষহ। চাঁদপুর সদর উপজেলার চান্দ্রা এলাকার বাসিন্দা আবুল খায়ের রাঁঢ়ী। ষাটোর্ধ্ব এই জেলে সংসারের হাল ধরতে মাত্র ১২ বছর বয়সে বাবার সঙ্গে নদীতে নামেন মাছ শিকারে। প্রায় ৫০ বছরের জেলে জীবনে খুব কাছ থেকে দেখেছেন নদীর চিত্র। জেলে আবুল খায়ের বলেন, 'আগে কত মাছ পাওয়া যেত গাঙ্গে। তখন মাছের দাম অনেক কম ছিল। কিন্তু মাছ ভালো পাওয়ায় লাভ হতো। কিন্তু এখন দাম বাড়লেও মাছ না পাওয়ায় জাল বেয়ে সংসার চালাতে কষ্ট হয়ে যায়।' আরেক জেলে হোসেন আলী বলেন, 'কিস্তি আর ঋণের জালে আমরা জর্জরিত। সংসার চালানোই দায় হয়ে পড়ছে। নদীতে মাছ না থাকায় অনেকেই মাছ ধরা ছেড়ে অন্য কাজে যাওয়ার চিন্তা-ভাবনা করছেন।' জেলেদের জালে ইলিশ কম ধরা পড়ার প্রভাব পড়েছে বাজারে। সরকারের খাতায় প্রতিবছর ইলিশের উৎপাদন ঊর্ধ্বমুখী হলেও দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে প্রায় প্রতি বছর। চাঁদপুর জেলা মৎস্য অফিস থেকে পাওয়া তথ্যমতে, চাঁদপুরে ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ইলিশ উৎপাদন হয়েছে ২০৪১৮ মে.টন, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ২০৪৫১ মে.টন, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ২০৯৩৫ মে.টন, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ২৮০১৬.২ মে.টন, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে : ২৮৪৫০.৫ মে.টন, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ২৯১৪০.৭ মে.টন, ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৩০৯১০ মে.টন, ২০০০-২১ অর্থবছরে ৩৩৯৯২ মে.টন, ২০২১-২২ অর্থবছরে ৩৪০৯২ মে.টন এবং ২০২২-২৩ অর্থবছরে ইলিশ উৎপাদন হয়েছে ৩৪৩২৬ মে.টন। চাঁদপুর বড় স্টেশন মাছ বাজারের জেলেদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যমতে, ২০১১ সালে ১ কেজি ওজনের ইলিশ ছিল ৭০০-৮০০ টাকা আর ৭শ'-৮শ' গ্রাম ওজনের ইলিশ কেজিপ্রতি ৪৫০-৫০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। ২০১২ সালে ১ কেজি ওজনের ইলিশ ছিল ৭৫০-৮০০ টাকা আর ৭শ'-৮শ' গ্রাম ওজনের ইলিশ কেজিপ্রতি ছিল ৫০০-৫৫০ টাকা। ২০১৩ সালে ১ কেজি ওজনের ইলিশ ৮০০-৯০০ টাকা আর ৭শ'-৮শ' গ্রাম ওজনের ইলিশ কেজিপ্রতি ৫৫০-৬৫০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। ২০১৪ সালে ১ কেজি ওজনের ইলিশ ৮৫০-৯৫০ টাকা; ৭শ'-৮শ' গ্রাম ওজনের ইলিশ কেজিপ্রতি ৭০০-৭৫০ টাকা। ২০১৫ সালে ১ কেজি ওজনের ইলিশ ৯০০-১০০০ টাকা; ৭শ'-৮শ' গ্রাম ওজনের ইলিশ কেজিপ্রতি ৭০০-৮০০ টাকা। ২০১৬ সালে ১ কেজি ওজনের ইলিশ ৯৫০-১০০০ টাকা; ৭শ'-৮শ' গ্রাম ওজনের ইলিশ কেজিপ্রতি ৭০০-৮০০ টাকা। ২০১৮ সালে ১ কেজি ওজনের ইলিশ ছিল ৯৫০-১০৫০ টাকা আর ৭শ'-৮শ' গ্রাম ওজনের ইলিশ কেজিপ্রতি ছিল ৭৫০-৮৫০ টাকা। ২০১৯ সালে ১ কেজি ওজনের ইলিশ ছিল ১০০০-১০৫০ টাকা আর ৭শ'-৮শ' গ্রাম ওজনের ইলিশ কেজিপ্রতি ৭০০-৮৫০ টাকা। ২০২০ সালে ১ কেজি ওজনের ইলিশ ১০০০-১১০০ টাকা আর ৭শ'-৮শ' গ্রাম ওজনের ইলিশ কেজিপ্রতি ছিল ৮০০-৯০০ টাকা। ২০২১ সালে ১ কেজি ওজনের ইলিশ ১১০০-১২০০ টাকা ; ৭শ'-৮শ' গ্রাম ওজনের ইলিশ কেজিপ্রতি ১০০০-১১০০ টাকা। ২০২২ সালে ১ কেজি ওজনের ইলিশ ১৩০০-১৩৫০ টাকা ; ৭শ'-৮শ' গ্রাম ওজনের ইলিশ কেজিপ্রতি ১০৫০-১১৫০ টাকা। ২০২৩ সালে ১ কেজি ওজনের ইলিশ ছিল ১৪০০-১৫০০ টাকা আর ৭শ'-৮শ' গ্রাম ওজনের ইলিশ কেজিপ্রতি ছিল ১১০০-১২০০ টাকা। চলতি ২০২৪ সালে জুন মাস পর্যন্ত ১ কেজি ওজনের ইলিশ ২০০০-২২০০ টাকা আর ৭শ'-৮শ' গ্রাম ওজনের ইলিশ কেজিপ্রতি ১৫০০-১৭০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এদিকে, দাম বেড়ে যাওয়ায় নিম্ন ও নিম্ন মধ্যবিত্ত মানুষের পাত থেকে ইলিশ উঠে গেছে অনেক আগে। বাজারে ইলিশ কিনতে এসে দাম শুনে ভাবনায় পড়েন মধ্যবিত্তরাও। খুব বেশি প্রয়োজন ছাড়া অনেকেই এখন আর ইলিশ কিনতে বাজারে আসেন না। কুমিলস্না থেকে মাছ কিনতে আসা মো. ইয়াছিন বলেন, 'চাঁদপুরে আসি তাজা ইলিশ কিনতে। এখানে মাছ ভালো পাওয়া গেলেও দাম সাধ্যের বাইরে চলে যায়। তাই ৪টার জায়গায় ২টা কিনে নিয়ে যাচ্ছি। এতো দাম দিয়ে আমাদের মতো মধ্য আয়ের মানুষের ইলিশ কিনে খাওয়া অনেক কষ্টের।' স্থানীয় বাসিন্দা বশির হোসেন বলেন, 'আগে মৌসুমে এতো ইলিশ খাওয়া পড়ত, এই মাছ দেখলেও খেতে ইচ্ছা করত না। কিন্তু এখন চাইলেও কিনতে পারি না। সারাবছরই দাম বেশি থাকে।' দেশের অন্যতম বড় ইলিশের পাইকারি বাজার বড় স্টেশন মাছঘাটে একটা সময় মৌসুমে প্রতিদিন ৪ থেকে ৫হাজার মন ইলিশ বেচাকেনা হতো। কিন্তু বর্তমানে সেই জৌলুস আর নেই। মাছের সরবরাহ আশঙ্কাজনকভাবে লোকসানের সম্মুখীন হচ্ছেন আড়তদাররা। চাঁদপুর জেলা মৎস্য ব্যবসায়ী সমবায় সমিতির সভাপতি আব্দুল বারী জমাদার বলেন, 'আগের তুলনায় সবকিছুর দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। মাছ ধরতে যাওয়া জেলেদের নৌকার জ্বালানি খরচ বেড়েছে, নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে। তাই ইলিশ মাছের দামও বেড়েছে। দেশের বিভিন্ন স্থানে মাছের আড়ত তৈরি হওয়ায় এখন আর আগের মতো মাছ আসে না বাজারে। তাছাড়া নানা কারণে নদীতেও মাছ কম পাওয়া যায়। তাই আমরা যারা ব্যবসায়ী আছি, লাখ লাখ টাকা পুঁজি খাটিয়েও ঠিকমতো ব্যবসা করতে পারছি না। অনেক ব্যবসায়ী লোকসান গুনছে ব্যবসায় করে।' নদী কেন্দ্র চাঁদপুরের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো. আবু কাউছার দিদার বলেন, ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধিতে কাজ করা হচ্ছে। সরকারি বিভিন্ন উদ্যোগের কারণে প্রতি বছর উৎপাদন বৃদ্ধি পাচ্ছে। চলতি জাটকা রক্ষা অভিযানেও আমরা গবেষণা করে দেখতে পেয়েছি এ বছর নদীতে প্রচুর জাটকা বেড়ে উঠেছে। আশা করি আগামীতেও উৎপাদনের ধারা অব্যাহত থাকবে। চাঁদপুর জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. গোলাম মেহেদী হাসান বলেন, প্রতি বছর ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধি পাচ্ছে। চাঁদপুরেও ইলিশের উৎপাদন বেড়েছে। আগের তুলনায় জেলের সংখ্যা বাড়ায় হয়তো সবাই বেশি মাছ পাচ্ছে না। তাছাড়া ভোক্তার সংখ্যাও বেড়েছে অনেক। তাই মাছের চাহিদাও বৃদ্ধি পেয়েছে অনেক। দাম কিছুটা বেশি হলেও যাদের সামর্থ্য রয়েছে তারা কিনে খেতে পারেন। এ ছাড়া ছোট সাইজের মাছ সবার নাগালের মধ্যে রয়েছে।'