নেপালে গ্রেপ্তার সিয়ামকে কলকাতায় জিজ্ঞাসাবাদ করছে দেশটির গোয়েন্দারা

এমপি আনোয়ারুল আজীম হত্যা :কসাই জিহাদকে সহায়তা করে সিয়াম

প্রকাশ | ০৮ জুন ২০২৪, ০০:০০

যাযাদি রিপোর্ট
আনোয়ারুল আজীম আনার
ঝিনাইদহ-৪ আসনের আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনার হত্যা মামলার অন্যতম আসামি নেপালে গ্রেপ্তার হওয়া সিয়ামকে কলকাতা পুলিশের কাছে হস্তান্তর করেছে নেপাল সরকার। কলকাতায় সিয়ামকে আনার হত্যাকান্ডের বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছে দেশটির গোয়েন্দারা। হত্যার পর আনারের লাশ টুকরো টুকরো করা থেকে শুরু করে গুম করার কাজেও কসাই জিহাদকে নানাভাবে সিয়াম সহায়তা করেছে বলে তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। তদন্ত সংশ্লিষ্ট উচ্চ পর্যায়ের একটি সূত্রে জানা গেছে, এমপি আনার হত্যাকান্ডের অন্যতম আসামি ও সহযোগী সিয়াম। নেপালের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাকে গ্রেপ্তারের পর কলকাতা পুলিশের কাছে হস্তান্তর করেছে। নিজেদের হেফাজতে পেয়ে কলকাতা পুলিশসহ তদন্ত সংশ্লিষ্টরা সিয়ামকে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করেছে। সিয়ামও জিহাদের মতোই এক প্রকার কসাই। হত্যার পর আনারের লাশ টুকরো টুকরো করতে গ্রেপ্তার সিয়াম নানাভাবে সহায়তা করেছে কসাই জিহাদকে। সূত্রটি বলছে, হত্যার পর মূলত চারজন আনারের লাশ টুকরো টুকরো করার কাজটি করে। তারা হচ্ছে কলকাতা পুলিশ হেফাজতে থাকা কসাই জিহাদ, সিয়াম ও ফয়সাল এবং পলাতক মোস্তাফিজ। হত্যার পর আনারের লাশ টুকরো টুকরো করতে ব্যবহৃত কাঠের গুঁড়ি আনা, চাপাতি ধারালো করা ও পলিথিন বিছানো থেকে শুরু করে গুম করার কাজগুলো মূলত এ চারজনই করেছে। আনারের লাশ কাঠের গুঁড়ির ওপর ফেলার পর হাত, পা, মাথাসহ শরীরের বিভিন্ন অংশ ধরে টুকরো টুকরো করার কাজে সহায়তা করার কাজটি করে জিহাদ ছাড়া বাকি তিনজন। টুকরো টুকরো করার পর চামড়া, মাংস ও হাড় আলাদা করা। এসব প্যাকেজ করা এবং লাশ গুমের কাজটিও করে তারাই। তবে মূল দায়িত্ব পালন করে কসাই জিহাদ। কসাই জিহাদ লাশ টুকরো টুকরো করতে করতে অনেক সময় ক্লান্ত হয়ে পড়ত। তখন সিয়াম, মোস্তাফিজ ও ফয়সাল লাশ টুকরো টুকরো করার কাজ করত। যদিও জিহাদ ব্যতীত অন্য তিনজনের লাশ টুকরো টুকরো করা, চামড়া, হাড় ও মাংস আলাদা করতে বেশি সময় কাজ করতে হয়নি। খানিকটা বিরতি নিয়েই আবার জিহাদ লাশ কাটার কাজ শুরু করত। শুক্রবার কোরবানির পশুর হাটের নিরাপত্তা সংক্রান্ত এক সংবাদ সম্মেলনে ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার অতিরিক্ত আইজিপি হাবিবুর রহমান সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, কলকাতা সিআইডির কাছে আনার হত্যাকান্ডে জড়িত সন্দেহে আরও দুইজন গ্রেপ্তার আছে। গ্রেপ্তার সিয়াম শাহীনের সহকারী হিসাবে কাজ করত। তার বাড়ি ভোলার বোরহানউদ্দিন থানা এলাকায়। প্রসঙ্গত, ঢাকার ডিবির আবেদনের প্রেক্ষিতে ঢাকার অতিরিক্ত মুখ্য মহানগর হাকিম মাহবুবুল হক গত ২ জুন সিয়ামের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন। আনার হত্যাকান্ডটি ভারতে সংঘটিত হওয়ায় মূল তদন্তটি ভারতে হবে। তবে বাংলাদেশ পুলিশও তদন্ত করবে। তদন্তের বিষয়ে দুই দেশ একপর্যায়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে পরবর্তী পদক্ষেপ নিবে। মূলত যেখানে ঘটনাটি সংঘটিত হয়, সেখানেই তদন্ত হয়। সেজন্য কলকাতায় মূল তদন্তটি হচ্ছে। তবে আইন মোতাবেক হত্যাকান্ডে জড়িত কোনো বাংলাদেশি যদি বিদেশে থাকে তাহলে তাকে দেশে এনে দেশীয় আইনেও তার বিচার করা যাবে। উলেস্নখ্য, সিয়াম নেপালে আটক হওয়ার পর গত ১ জুন সেদেশে যান ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) মোহাম্মদ হারুন অর রশীদের নেতৃত্বে একটি দল। দেশে ফিরে ডিবি প্রধান হারুন অর রশীদ সাংবাদিকদের জানান, নেপালের সঙ্গে ভারতের বন্দি বিনিময় চুক্তি আছে। সেই চুক্তি মোতাবেক নেপাল সরকার গ্রেপ্তার সিয়ামকে ভারতের কাছে হস্তান্তর করেছে। উলেস্নখ্য, চলতি বছরের ১২ মে চিকিৎসার জন্য ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ থেকে চুয়াডাঙ্গার দর্শনার গেদে সীমান্ত দিয়ে ভারতে যান এমপি আনার। উঠেন পশ্চিমবঙ্গে বরাহনগর থানার মন্ডলপাড়া লেনে বন্ধু গোপাল বিশ্বাসের বাড়িতে। পরদিন ডাক্তার দেখানোর কথা বলে বেরিয়ে নিখোঁজ হন তিনি। গত ১৮ মে বরাহনগর থানায় আনারের নিখোঁজের বিষয়ে একটি জিডি করেন গোপাল বিশ্বাস। গত ২২ মে কলকাতার পার্শ্ববর্তী নিউটাউন এলাকায় বহুতল সঞ্জীবা গার্ডেনস নামে একটি আবাসিক ভবনের বি ইউ ৫৬ নম্বর রুমে আনারের খুন হন। ঘরের ভেতরে আলামত হিসেবে রক্ত পায় কলকাতা পুলিশ। এ ঘটনায় গত ২২ মে ঢাকার শেরেবাংলা নগর থানায় মামলা করেন আনারের মেয়ে মুমতারিন ফেরদৌস ডরিন। গত ২৩ মে হত্যাকান্ডে জড়িত কসাই জিহাদ হাওলাদারকে (২৪) চব্বিশ পরগনা জেলার বনগাঁও এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করে কলকাতা পুলিশ। তার বাড়ি খুলনা জেলার দিঘুলিয়া থানাধীন বারাকপুরে গ্রামে। তাকে বারাসাতের আদালতের মাধ্যমে রিমান্ডে পেয়ে জিজ্ঞাসাবাদ অব্যাহত আছে জিহাদকে। জিহাদ জানায়, আনারের মাংসের কিছু অংশ কিমা বানিয়ে বাথরুমের কমোটে ফেলে ফ্ল্যাশ করে দেওয়া হয়। সেই তথ্যের সূত্র ধরেই কমোটের লাইন ধরে সাব সেপটিংক ট্যাংক থেকে প্রায় সাড়ে ৪ কেজির মতো মাংস উদ্ধার করে ঢাকার ডিবি ও কলকাতার তদন্তকারীরা। সেগুলোর ফরেনসিক পরীক্ষা নিরীক্ষার জন্য ল্যাবরেটরিতে পাঠানো হয়েছে। উদ্ধার হওয়া মাংস আনারের বলে ধারণা করা হলেও বিষয়টি নিশ্চিত হতে পরীক্ষা-নিরীক্ষা অব্যাহত আছে। শুক্রবার এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত মাংসের ফরেনসিক পরীক্ষার কোনো প্রতিবেদন পাওয়া যায়নি বলে জানান তদন্ত সংশ্লিষ্টরা। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, আনার হত্যাকান্ডে ব্যবহৃত ট্যাক্সি ক্যাবের চালক জুবের এবং ব্যবহৃত প্রাইভেট কারের চালক ফয়সাল কলকাতা পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার রয়েছে। পরবর্তীতে জুবের ও ফয়সাল এমপি হত্যাকান্ডের অনেক অজানা তথ্য দিয়েছে কলকাতা পুলিশকে। এদিকে ঢাকায় গ্রেপ্তারের পর দুই দফায় রিমান্ডে নেওয়া হয় আমানউলস্নাহ ওরফে শিমুল ভূইয়া, সিলাস্তি রহমান ও শিমুল ভূঁইয়ার ভাতিজা তানভীর ভূঁইয়াকে। তারা তিনজনই আদালতে আনার হত্যার দায় স্বীকার করে আদালতে বিচারকের কাছে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, হত্যাকান্ডের মূল মাস্টারমাইন্ড বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক আকতারুজ্জামান শাহীন। তিনিই আনারকে হত্যার জন্য ওই ফ্ল্যাটটি ভাড়া করেন। তার নির্দেশনা মোতাবেক ৫ কোটি টাকার বিনিময়ে হত্যাকান্ডের ঘটনাটি ঘটানোর মূল দায়িত্ব পালন করেন আমানউলস্নাহ ওরফে শিমুল ভূঁইয়া। হত্যাকান্ডে নানাভাবে সহায়তা করেন আমানউলস্নাহ ওরফে শিমুল ভূঁইয়ার বান্ধবী শিলাস্তি রহমান ও তানভীর ভূঁইয়া। আমান উলস্নাহ ওরফে শিমুল ভূঁইয়া ওরফে আমান ওরফে মোহাম্মদ আমান ওরফে মোহাম্মদ আমান উলস্নাহ ওরফে শিমুল ভূঁইয়া ওরফে মোহাম্মদ শিমুল ওরফে জব্বার ওরফে আমানুলস্নাহ সাঈদ ওরফে শিহাব ফজল মোহাম্মদ ভূঁইয়া ও সবশেষ তিনি বব পিটার নাম ধারণ করেছিলেন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সূত্রে জানা গেছে, আনার হত্যাকান্ডের সন্দেহভাজন আসামি হিসেবে আটক করা হয়েছে শিমুল ভূঁইয়ার আত্মীয় আওয়ামী লীগ নেতা কাজী কামাল আহম্মেদ ওরফে গ্যাস বাবুকে। গত ৬ জুন রাতে ঝিনাইদহ শহরের আদর্শপাড়া এলাকা থেকে তাকে আটক করা হয়। গ্যাস বাবু ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও সমাজ কল্যাণ বিষয়ক সম্পাদক। ঝিনাইদহ সদর থানার ওসি শাহীন উদ্দিন আটকের তথ্য নিশ্চিত করে জানান, বৃহস্পতিবার রাতে ঢাকার ডিবির একটি দল ঝিনাইদহে এসে গ্যাস বাবুকে আটক করে নিয়ে গেছে। এদিকে উদ্ধার হওয়া মাংস আনারের কিনা তা নিশ্চিত হতে এমপি আনারের মেয়ে মুমতারিন ইসলাম ডরিনের শরীর থেকে প্রয়োজনীয় ডিএনএ সংগ্রহের কার্যক্রম চলছে। তাকে ভারতে যাওয়ার ভিসা দিয়েছে বাংলাদেশস্থ ভারতীয় দূতাবাস।