মাছ ধরলে আধার দিতে হয় :'কালো টাকা' সাদার সুযোগ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী

প্রকাশ | ০৮ জুন ২০২৪, ০০:০০

যাযাদি রিপোর্ট
ঐতিহাসিক ৬ দফা দিবস উপলক্ষে শুক্রবার তেজগাঁওয়ে ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগ আয়োজিত আলোচনা সভায় বক্তব্য রাখেন দলের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা -ছবি: স্টার মেইল
সাধারণভাবে 'কালো টাকা' হিসেবে অপ্রদর্শিত আয় সাদা বা বৈধ করার সুযোগ দেওয়াকে বড়শিতে আধার গেঁথে মাছ শিকারের সঙ্গে তুলনা করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট পেশের পরদিন শুক্রবার বিকালে তেজগাঁওয়ে ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে এক আলোচনায় তিনি এ কথা বলেন। পাকিস্তান আমলে ১৯৬৬ সালের ৭ জুন বঙ্গবন্ধুর দেওয়া ঐতিহাসিক ছয় দফা প্রস্তাবের স্মরণে এই আলোচনার আয়োজন করা হয়। দিনটিকে 'ছয় দফা দিবস' হিসেবে পালন করে আওয়ামী লীগ। প্রস্তাবিত বাজেটে ১৫ শতাংশ কর দিয়ে অপ্রদর্শিত আয় বৈধ করার সুযোগ ফিরিয়ে আনা হয়েছে। এই টাকার উৎস কী, সেই প্রশ্নও করা হবে না। সংসদের বাইরে বিরোধী দল বিএনপি, অর্থনীতির গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডি এবং সুশাসন নিয়ে কাজ করা প্রতিষ্ঠান টিআইবি- এমন বিধানের সমালোচনা করছে। তারা বলছে, এমন বিধান নৈতিকভাবে গ্রহণযোগ্য না। বিষয়টিকে বড়শি দিয়ে মাছ শিকারের সঙ্গে তুলনা করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, 'আমি বলি মাছ ধরতে গেলে তো আধার দিতে হয়, দিতে হয় না? আধার ছাড়া তো মাছ আসবে না। সে রকম একটা ব্যবস্থা, এটা আসলে আগেও হয়েছে। সেই তত্ত্বাবধায়ক আমলেই শুরু করেছিল, আর পরেও প্রত্যেক সরকারই করে। সেই সুযোগটা আমরাও দিয়েছি। অল্প ট্যাক্স দিয়ে সেই টাকাটা তোমরা ব্যাংকে নিয়ে আস, সেই ব্যবস্থাটাই হয়েছে। এটা নিয়ে নানাজনে নানা কথা বলবে। কিন্তু তারপরেও যেগুলো মানুষের প্রয়োজন সেই ক্ষেত্রে ট্যাক্স কমিয়ে দিয়েছি।' প্রস্তাবিত বাজেটে 'মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ রাখা'কে চ্যালেঞ্জ হিসেবে বর্ণনা করে সরকার প্রধান বলেন, 'বিশেষ করে খাদ্য মূল্য সেখানে উৎপাদন এবং সরবরাহ বৃদ্ধি করতে হবে। বৃষ্টির কারণে যেমন আলুর বীজ নষ্ট হয়ে গেছে, তো এই রকম অনেক কিছু আছে। আমরা এখনো উৎপাদনমুখী হলে খাদ্যে কোনো দিন অভাব হবে না।' 'বিশ্ব পরিস্থিতি মাথায় রেখে পরিকল্পনা নিয়ে চলতে হবে' জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, 'আমাদের দেশে যা হচ্ছে... কিছু ভালো লাগে না। তাদের ভালো না লাগাই থাক, কান দেওয়ার দরকার নাই। মূল্যস্ফীতির চাপ থেকে প্রান্তিক মানুষকে সুরক্ষা দেওয়ার কথাও তুলে ধরেন সরকারপ্রধান। বলেন, নিম্ন আয়ের মানুষ যারা, সীমিত আয়ের মানুষ যারা, তাদের জন্য আমরা পারিবারিক কার্ড করে দিয়েছি। যারা একেবারে হতদরিদ্র তাদের তো একেবারে বিনা পয়সায় খাবার দিচ্ছি। আর সামাজিক নিরাপত্তা তো বিনা পয়সায় দিয়ে যাচ্ছি।' তিনি বলেন, প্রত্যেকটা জিনিস আমরা উৎপাদন বাড়ানোর পাশাপাশি চাহিদা বৃদ্ধির বিষয়টিও মাথায় রাখি। তিনি বলেন, "মানুষের আর্থিক সচ্ছলতা বেড়েছে, খাদ্য গ্রহণের পরিমাণও বেড়েছে। এখন আর দিনের পর দিন না খেয়ে থাকতে হয় না। কমপক্ষে দুই বেলা খাবার তো পাচ্ছে মানুষ। সেখানে গ্রহণটাও বেড়েছে চাহিদাটাও বেড়েছে, আমরা উৎপাদনও বাড়িয়েছি।" মূল্যস্ফীতির কারণ হিসেবে করোনাভাইরাস মহামারি ও ইউক্রেন যুদ্ধকেও দায়ী করেন সরকারপ্রধান। তিনি বলেন, "আমরা এগিয়ে যাচ্ছিলাম। কোভিড ১৯ এর অতিমারী দেখা দিল, এই অতিমারীর ফলে সারা বিশ্বে অর্থনৈতিক মন্দা হয়েছে, আমরাও সেই মন্দায় পড়ে গেলাম। সারাবিশ্বে প্রতিটি জিনিসের দাম বেড়ে গেল। এরপর আসল ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধ, এরপর স্যাংশন-পাল্টা স্যাংশন। স্যাংশনের ফলে প্রত্যেকটা জিনিসের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। \হবৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে আসার কারণে যে চাপ ও সমালোচনা, সেটি নিয়েও কথা বলেন শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, আমাদের মানুষকে খাওয়াতে হবে আগে। আমাদের রিজার্ভ কত আছে না আছে, সেটার চেয়ে বেশি দরকার আমার দেশের মানুষের চাহিদাটা পূরণ করা। সে দিকে লক্ষ্য রেখে আমরা পানির মতো টাকা খরচ করেছি। তিনি বলেন, বাংলাদেশ একমাত্র দেশ, যেটা কোনো উন্নত দেশ করে নাই, বিনা পয়সায় কোভিড ১৯ এর ভ্যাকসিন দিয়েছি, বিনা পয়সায় টেস্ট করিয়েছি। সেটা করেছি কেন? মানুষ বাঁচাতে। চিকিৎসা বিনা পয়সায়, যে ডাক্তার চিকিৎসা করেছে, তাদের প্রতিদিন আলাদা ভাতা দিতে হতো, তারা যে চিকিৎসা দিচ্ছে এভাবে পানির মতো টাকা খরচ হয়েছে। তারপর যখন দাম বেড়েছে, তখন দুইশ ডলারের গম ছয়শ ডলার করেও আমি কিনে নিয়ে এসেছি। ঠিক সেইভাবে তেল ও ভোজ্যতেলের দাম বেড়েছে, উন্নত দেশগুলোও হিমশিম খাচ্ছে। তার পরেও আমরা যে এবার বাজেট দিতে পারলাম। মানুষের চাহিদা পূরণের ভাবনা থেকেই এই বাজেট দেওয়া হয়েছে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, অনেকে বসে বসে হিসাব কষে, আগে এত পার্সেন্ট বেড়েছে এবার কম পার্সেন্ট বাড়ল কেন? এখন সীমিতভাবে খুব সংরক্ষিতভাবেই আমরা এগোতে চাই। যেটা আমাদের দেশের মানুষের কষ্ট না হয়, মানুষের যে চাহিদাটা সেটা যেন পূরণ করতে পারি, সেদিকে লক্ষ্য রেখেই আমরা বাজেট করেছি। এবারের বাজেটে মৌলিক চাহিদাকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, বিএনপির আমলে সবশেষ বাজেট মাত্র ৬২ হাজার কোটি টাকার ছিল। তত্ত্বাবধায়ক সরকার দিয়েছিল ৬৮ হাজার কোটি টাকার, সেখানে আমরা ৭ লাখ ৯৮ হাজার কোটি টাকা বাজেট প্রস্তাব করেছি। এই বাজেটে এবার কতগুলো মৌলিক চাহিদা... মানুষের মৌলিক যে অধিকার, সেটাকে নিশ্চিত করার জন্য, যেমন শিক্ষা, স্বাস্থ্য, খাদ্য তারপর দেশীয় শিল্প, সেগুলো এবং সামাজিক নিরাপত্তা, এইগুলোকে সব থেকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে প্রধানমন্ত্রীর শ্রদ্ধা এর আগে ঐতিহাসিক ছয় দফা দিবসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শুক্রবার সকালে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা জানান সরকারপ্রধান। এ সময় ফুল অর্পণ করে কিছু সময় নীরবে দাঁড়িয়ে থাকেন তিনি। পরে আওয়ামী লীগ সভাপতি হিসেবে দলের শীর্ষ নেতাদের নিয়ে শ্রদ্ধা জানান শেখ হাসিনা। ছাত্রলীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগসহ আওয়ামী লীগের বিভিন্ন সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের নেতাকর্মীরাও জাতির জনকের প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় ও তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা বঙ্গবন্ধুর ৬ দফা ঘোষণা। পাকিস্তানি শাসন-শোষণ-বঞ্চনা থেকে মুক্তির লক্ষ্যে স্বৈরাচার আইয়ুব সরকারের বিরুদ্ধে ১৯৬৬ সালের ৫ ফেব্রম্নয়ারি লাহোরে তৎকালীন পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের সব বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোকে নিয়ে ডাকা এক জাতীয় সম্মেলনে পূর্ব বাংলার জনগণের পক্ষে বঙ্গবন্ধু ৬ দফা দাবি উত্থাপন করেন। পরবর্তীকালে তিনি ঢাকায় ফিরে ৬ দফার পক্ষে দেশব্যাপী প্রচারাভিযানে নামেন এবং বাংলার আনাচে-কানাচে প্রত্যন্ত অঞ্চলে গিয়ে জনগণের সামনে ৬ দফার গুরুত্ব তুলে ধরেন। জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থনের মধ্য দিয়ে ৬ দফা হয়ে ওঠে পূর্ব বাংলার জাতীয় মুক্তির সনদ। ১৯৬৬ সালের ৭ জুন ৬ দফা আদায়ে আওয়ামী লীগের ডাকে হরতাল চলাকালে নিরস্ত্র জনতার উপর পুলিশ ও তৎকালীন ইপিআর গুলিবর্ষণ করে। এতে ঢাকা এবং নারায়ণগঞ্জে মনু মিয়া, সফিক ও শামসুল হকসহ ১১ জন শহীদ হন। ৬ দফার প্রতি ব্যাপক জনসমর্থন এবং শেখ মুজিবুর রহমানের জনপ্রিয়তায় ভীত হয়ে সামরিক জান্তা আইয়ুব খানের সরকার ১৯৬৬ সালের ৮ মে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করে। তাতে বিক্ষোভে ফেটে পড়ে বাংলার রাজপথ। ৬ দফার সেই আন্দোলন-সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলন স্বাধীনতা সংগ্রামে রূপ নেয়। দিবসটি উপলক্ষে আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন নানা কর্মসূচি গ্রহণ করেছে।