শনিবার, ১২ অক্টোবর ২০২৪, ২৮ আশ্বিন ১৪৩১
সীমান্তপথে আসছে গরু-মহিষ, লোকসানের শঙ্কায় খামারিরা

কোরবানির চাহিদা মিটিয়েও উদ্বৃত্ত থাকবে ৩০ লাখ পশু

আলতাব হোসেন
  ০৪ জুন ২০২৪, ০০:০০
রাজধানীর একটি হাটে কোরবানির পশু -ফাইল ছ্ি‌ব

কোরবানির গরু-ছাগল উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ বাংলাদেশ। এখন আর কোরবানির পশু ভারত, নেপাল ও মিয়ানমার থেকে আমদানি করতে হয় না। দেশি গরুতেই কোরবানির চাহিদা মিটে। আসন্ন পবিত্র ঈদুল আজহায় কোরবানির জন্য খামারিদের কাছে পর্যাপ্ত গরু-ছাগলের জোগান রয়েছে। এদিকে ভারত, নেপাল ও মিয়ানমার সীমান্তপথে আসছে গরু-মহিষ। এতে লোকসানের শঙ্কায় দেশের খামারিরা। দেশের খামারিদের ন্যায্যমূল্য দিতে সীমান্তপথে গরুর অনুপ্রবেশ ঠেকাতে সীমান্তপথ বন্ধ করার দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশ ডেইরি ফার্মারস অ্যাসোসিয়েশন (বিডিএফএ)।

সরকারি হিসাবে কোরবানি শেষে এবার ২৫ থেকে ৩০ লাখের বেশি গরু অবিক্রীত বা উদ্বৃত্ত থাকতে পারে। সীমান্তপথে কোরবানির পশু আসা অব্যাহত থাকলে অবিক্রীত পশুর সংখ্যা ৫০ লাখ ছাড়িয়ে যেতে পারে। এতে সর্বস্বান্ত হবেন দেশের খামারিরা।

ঈদুল আজহা মুসলমানদের দ্বিতীয় বৃহত্তর ধর্মীয় উৎসব। এই উৎসবকে কেন্দ্র করে সারাদেশে প্রস্তুত হচ্ছে কোরবানির পশুর হাট। এই ঈদকে কেন্দ্র করে গবাদি পশু কেনাবেচায় অর্থপ্রবাহ বৃদ্ধি পায়। রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়ার কারণে অর্থনীতিতে চাঙ্গাভাব আসে। সামর্থ্য অনুযায়ী ধনী-গরিব সবাই পশু কোরবানি করে থাকেন। নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা অনেক কমে গেছে। তাই এবার ছোট ও মাঝারি গরুর চাহিদা বেশি থাকবে বলে বলছেন খামারিরা। কোরবানির সংখ্যাও আগের চেয়ে কমতে পারে বলে জানিয়েছেন তারা।

প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্য মতে, এবার দেশে কোরবানির চাহিদা হচ্ছে ১ কোটি ৭ লাখ ২ হাজার ৩৯৪টি পশু। চাহিদার চেয়ে ২২ লাখ ৭৭ হাজার ৯৭৩টি অতিরিক্ত গবাদি পশু রয়েছে। এবার পবিত্র কোরবানির জন্য প্রস্তুত আছে ৫২ লাখ ৬৮৪টি গরু, ১ লাখ ৬০ হাজার ৩২০টি মহিষ, ৬৮ লাখ ৫০ হাজার ৫৮টি ছাগল, ৭ লাখ ৬৭ হাজার ৭৪৩টি ভেড়া এবং উট দুম্বাসহ এক হাজার ৮৫০টি পশু। এই হিসাবে চাহিদার চেয়ে প্রায় ২৫ লাখের বেশি পশু অবিক্রীত বা উদ্বৃত্ত থাকতে পারে। আর্থিক সংকটের কারণে এবার যৌথভাবে কোরবানি সংখ্যা বেশি হবে এবং ছোট ও মাঝারি মানের গরু কোরবানির জন্য বেশিরভাগ ক্রেতা কেনার চেষ্টা করবেন। সংসারের ব্যয়ভার সামলাতে অনেকে কোরবানিতে এবার অংশ নিতে পারবেন না। ফলে এবার অনেক গরু-ছাগল উদ্বৃত্ত থাকার আশঙ্কা করা হচ্ছে।

মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী আব্দুর রহমান জানান, কোরবানির চাহিদার চেয়ে ২২ লাখ ৭৭ হাজার ৯৭৩টি অতিরিক্ত গবাদিপশু প্রস্তুত রয়েছে। কোরবানির পশু নিয়ে কোনো সংশয়, সংকট বা আশঙ্কার কারণ নেই। পর্যাপ্ত পশু রয়েছে। দুশ্চিন্তার কোনো কারণ নেই। ঈদুল আজহাকে কেন্দ্র করে দেশের বাইরে থেকে যেন পশু না আসে সে বিষয়ে সীমান্ত অঞ্চলে নজরদারি বাড়ানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। মন্ত্রী বলেন, অবৈধভাবে দেশের টাকা বাহিরে চলে যায় এবং স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি থাকার পাশাপাশি দেশের খামারিরাও ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।

এদিকে দেশে কোরবানির পশুর পর্যাপ্ত সরবরাহ থাকলেও একটি অসাধু চক্র অবৈধভাবে সীমান্ত পথ দিয়ে গরু নিয়ে আসছেন। এতে খামারিদের মাথায় হাত পড়েছে। গত কয়েকদিন ধরে মিয়ানমার থেকে কক্সবাজার হয়ে দেশে গরু ঢুকছে। ভারত থেকে সিলেট, কুমিলস্না দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চল দিয়ে গরু আসছে। ধারণা করা হচ্ছে ইতোমধ্যে ২০ লাখের বেশি কোরবানির পশু দেশে প্রবেশ করেছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে, স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে যোগসাজশে গরু ঢুকছে দেশে। চোরাইপথে আসা এসব পশু বিক্রি হচ্ছে অনেকটা প্রকাশ্যে, রীতিমতো সীমান্ত এলাকায় হাট বসিয়ে। চোরাইপথে আনা এসব গরু রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছে।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ডেইরি ফার্মারস অ্যাসোসিয়েশনের (বিডিএফএ) সভাপতি মোহাম্মদ ইমরান হোসেন বলেন, কোরবানি উপলক্ষে ভারত ও মিয়ানমার থেকে গরু আসবে না- সরকারের এমন ঘোষণায় আশায় বুক বেঁধেছিলেন দেশের খামারিরা। এখন সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে গরু ঢোকায় লোকসানের শঙ্কায় খামারিরা। কক্সবাজারের উখিয়া সীমান্ত দিয়ে মিয়ানমারের গরু ও দেশের অন্যান্য সীমান্ত পথে নেপাল ও ভারতের গরু-ছাগল প্রবেশ করছে। সীমান্তপথে গরু আসা বন্ধ না করলে দেশের খামারিদের ঋণের টাকা পরিশোধ করতে না পেরে আত্মহত্যা করতে হবে। দেশের খামারিদের বাঁচাতে কঠিন নজরদারি বাড়িয়ে গরু-ছাগল আসা বন্ধ করা জরুরি।

তিনি আরও বলেন, কয়েক বছর ধরে গবাদিপশু আমদানি বন্ধ, তারপরও কোরবানির ঈদে প্রতি বছর উদ্বৃত্ত থাকে ২০ লাখের বেশি পশু। এবারও চাহিদার চেয়ে ২৩ লাখ বেশি পশু প্রস্তুত আছে।

২০১৫ সালের ১ এপ্রিল ভারতের তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংয়ের এক নির্দেশনার পর ভারত থেকে বাংলাদেশে কোরবানির গরু আসা বন্ধ হয়ে যায়। নিষেধাজ্ঞার বছর দুয়েক আগে প্রকাশিত এক গবেষণায় দেখা যায়, ভারত থেকে বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রায় দেড় কোটি গরু চোরাই পথে আসত। যার বাজার মূল্য প্রায় ৫০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি। ভারতের নিষেধাজ্ঞার পর প্রধানমন্ত্রী গরু- ছাগলে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে মাত্র আড়াই শতাংশ সুদে গরু-ছাগল লালন-পালনে খামারিদের ঋণ প্রদান শুরু করেন। এরপর দুই বছরে বাংলাদেশ গরু-ছাগলে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে ওঠে। সারা বছর মাংসের জোগান ও কোরবানির চাহিদা মেটানোর পর বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে গরু-ছাগলের মাংস। গত এক বছরে গরুর উৎপাদন বেড়েছে এক লাখ ৭৩ হাজার। আর ছাগলের উৎপাদন বেড়েছে এক লাখ ৯৪ হাজার।

ঋণ সুবিধা পেয়ে সারাদেশে অসংখ্য শিক্ষিত বেকার তরুণ গরু-ছাগলের খামার গড়ে তোলেন। গবাদিপশু উৎপাদনে নীরব বিপস্নব ঘটে দেশে। বর্তমানে প্রতি বছর ২৫ শতাংশ হারে গবাদিপশুর খামার বাড়ছে। ছোট-বড় মিলিয়ে এখন খামারের সংখ্যা প্রায় ২০ লাখের বেশি। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) তথ্য অনুযায়ী, গবাদিপশু উৎপাদনে বিশ্বে দ্বাদশ স্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। এককভাবে ছাগল উৎপাদনে বিশ্বে চতুর্থ। ছাগলের দুধ উৎপাদনে বিশ্বে বাংলাদেশ দ্বিতীয়। ছাগলকে গরিবের গাভী বলা হয়। বস্ন্যাক বেঙ্গল ছাগল বিশ্বের অন্যতম সেরা জাত। এ ছাড়া বাংলাদেশ ও ভারতের যমুনাপারি ছাগলকেও বিশ্বের অন্যতম বিশেষ জাত হিসেবে উলেস্নখ করা হয়েছে।

ঢাকায় এবার দুটি স্থায়ী হাটসহ মোট ২২টি কোরবানির হাট বসবে। ঢাকা উত্তর সিটিতে গাবতলী স্থায়ী হাট ছাড়াও ৯টি অস্থায়ী হাট বসবে। ঢাকা দক্ষিণ সিটিতে স্থায়ী হাট সারুলিয়া ছাড়াও ১১টি অস্থায়ী হাট বসবে। নির্দিষ্ট জায়গা ছাড়া সড়ক বন্ধ করে কোনো হাট বসতে দেওয়া হবে না বলে সাফ জানিয়েছে নগর কর্তৃপক্ষ। এ ছাড়া সারাদেশে তিন হাজার গবাদি পশুর হাট বসবে।

প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, ২০১৬ সালে ৯৮ লাখ ১৩ হাজার পশু কোরবানি হয়। ২০১৭ সালে ১ কোটি ৪ লাখ এবং ২০১৮ সালে ১ কোটি ৬ লাখ। এভাবে ক্রমাগত পশু কোরবানির সংখ্যা বাড়তে থাকে। ২০১৯ সালে ১ কোটি ৬ লাখ ১৪ হাজার পশু কোরবানি হয়। ২০২০ সালের মার্চ থেকে কোভিড-১৯ সংক্রমণ মানুষের জীবনযাপনে বিরূপ প্রভাব ফেলায় পশু কোরবানির সংখ্যা কমে হয় ৯৪ লাখ ৫০ হাজার ২৬৩টি। ২০২১ সালে পশু কোরবানির সংখ্যা আরও হ্রাস পেয়ে হয় ৯০ লাখ ৯৩ হাজার ২৪২টি। কোরবানিযোগ্য অবিক্রীত পশুর সংখ্যা ছিল ২৮ লাখ ২৩ হাজার ৫২৩। ২০২২ সালে কোরবানি হয় ৯৯ লাখ ২১ হাজার ৯৪১টি। ২০২৩ সালে কোরবানি হয় ১ কোটি ৪১ হাজার ৮১২টি।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে