চোরাই চিনিতে ৪ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব হারাবে সরকার

প্রকাশ | ০৩ জুন ২০২৪, ০০:০০

রেজা মাহমুদ
ভারতের চিনি রপ্তানি বন্ধ ঘোষণায় দীর্ঘদিন ধরে চড়া দেশের বাজার। দফায় দফায় দাম বেড়ে গত রমজানে খুচরা বাজারে দেড়শ ছাড়ায় চিনির কেজি। বাজারের এমন পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে কম দামে অবৈধ পথে ভারত থেকে বিপুল পরিমাণ চিনি দেশে আনছে অসাধুচক্র। এতে সরকার বিপুল পরিমাণ রাজস্ব বঞ্চিত হচ্ছে, কিন্তু ভোক্তাকে চিনি কিনতে হচ্ছে আগের চড়া দামেই। সংশ্লিষ্ট সূত্রের তথ্যানুযায়ী বর্তমানে দেশের বিক্রিত চিনির প্রায় ৪০ শতাংশের বেশি আসছে অবৈধ পথে। ফলে বছরে প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব বঞ্চিত হচ্ছে সরকার। ভারতীয় বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে বিশেষ করে সিলেট অঞ্চল দিয়ে এসব চিনি প্রবেশ করছে। আমদানিকারকদের দাবি যে হারে চোরাই চিনি দেশে ঢুকছে তাতে বছরে ৫ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব হারাতে পারে সরকার। এদিকে ভারতীয় চোরাই চিনির প্রতি কেজির মূল্য পড়ছে ৫০ থেকে ৫৫ টাকা রুপি। যেখানে দেশের বাজারে প্রতি কেজি চিনির পাইকারি মূল্য ১৩৫ থেকে ১৪০ টাকা এবং খুচরায় বিক্রি হচ্ছে দেড়শ টাকা দরে। কম দামে এসব নিম্নমানের চিনি বেশি দামে বিক্রি করে হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে একদল অসাধুচক্র। যদিও সীমান্তে চোরাই চিনি চালান জব্দে নানা পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। তবে তা পর্যাপ্ত না হওয়ায় পুরোপুরি বন্ধ হচ্ছে না। এদিকে দেশের চিনির চাহিদার প্রায় শতভাগ পূরণ হয়ে থাকে আমদানির মাধ্যমে। যার মধ্যে ৫টি কোম্পানি ৯৯ শতাংশ চিনির সরবরাহ করে থাকে। বিভিন্ন দেশ থেকে চিনির কাঁচামাল আমদানি করে প্রক্রিয়াজাত করে বাজারে সরবরাহ করে থাকে। এখান থেকে সরকার বছরে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আয় করে থাকে। কিন্তু ভারতীয় চোরাই চিনির প্রকোপে এসব প্রতিষ্ঠানের বেশিরভাগ চিনি এখন গোডাউনে অবিক্রীত পড়ে রয়েছে। ফলে বিশাল বিনিয়োগ করে লোকসান গুনতে হচ্ছে প্রতিষ্ঠানগুলোকে। বছরে দেশে ২২ লাখ মেট্রিক টন চিনির চাহিদার বিপরীতে বড় ৫টি আমদানিকারক শিল্প প্রতিষ্ঠানের উৎপাদন সক্ষমতা ৩০ লাখ মেট্রিক টন পর্যন্ত। এসব প্রতিষ্ঠানে সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে কর্মসংস্থান রয়েছে প্রায় কয়েক লাখ মানুষের। কিন্তু চোরাই চিনির প্রভাবে তাদের গড়ে প্রায় ৫ লাখ মেট্রিক টন চিনি অবিক্রীত রয়ে গেছে। অন্যদিকে নিম্নমানের চিনির কারণে মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে রয়েছে ভোক্তারা। এ ছাড়া এসব অবৈধ চিনি বিক্রি হচ্ছে দেশীয় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বস্তায়। যা প্রতিষ্ঠানগুলোর সুনাম ক্ষুণ্ন করছে বলেও জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। এ ছাড়া ডলারের চড়ামূল্যে প্রায় শতভাগ মার্জিনে চিনি আমদানি করে বিশাল লোকসান গুনতে হচ্ছে দেশীয় কোম্পানিগুলোকে। দেশের চিনির অন্যতম আমদানিকারক মেঘনা গ্রম্নপের উপ-মহাব্যবস্থাপনা পরিচালক তাসলিম শাহরিয়ার যায়যায়দিনকে বলেন, বছরের শুরু থেকেই দেশে চোরাই চিনি ঢুকছে, তবে গত দু-মাসে এর হার এতই বেড়েছে যে এখন বাজারে আমদানি চিনির থেকে চোরাই চিনি বেশি। এতে বিপুল পরিমাণ লোকসান গুণতে হচ্ছে তাদের। এ মুহূর্তে তাদের গোডাউনে প্রায় ৬ লাখ মেট্রিকটন চিনি অবিক্রীত রয়েছে। এমনকি দৈনিক চিনি সরবরাহ কমেছে প্রায় ৬০ শতাংশ। এ পরিস্থিতিতে আমদানি কামাতে বাধ্য হচ্ছেন তারা। এ ছাড়া ১২৮ টাকা দরে প্রতিকেজি আমদানি করে বিক্রি করছেন ১২০ টাকা দরে। যদিও ভারতীয় চিনিতে বাজার সয়লাব হওয়ার পেছনে দেশের চিনির মিল মালিকদের অস্বাভাবিক মুনাফা করার প্রবণতাকে পরোক্ষভাবে দায়ী করছেন খুচরা ব্যবসায়ীরা। তারা বলছেন, করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো দফায় দফায় দাম নির্ধারণ করেও সেই দামে চিনি বিক্রি করেনি। এই অবস্থায় সীমান্তে শিথিলতার সুযোগে বিপুল পরিমাণ ভারতীয় চিনি নিয়ে আসছে চোরাকারবারিরা। তাদের মতে, বাজারে বিক্রি হওয়া ৬০ শতাংশ চিনিই ভারতের। চলতি মাসে নারায়ণগঞ্জের তারাব পৌরসভা থেকে ৬২৪ বস্তা ভারতীয় চিনি জব্দ করে জেলা প্রশাসনের ভ্রাম্যমাণ আদালত। উদ্ধার করা এসব চিনির ১৪৪ বস্তা ছিল মেঘনা গ্রম্নপের ফ্রেশ ব্র্যান্ডের মোড়কে। বাকি ৪৮০ বস্তা ছিল ভারতীয় ব্র্যান্ডের মোড়কে। এরপর ১৩ মে রাতে শেরপুরের নালিতাবাড়ী থেকে উদ্ধার করা হয় আরও ১ হাজার ২৯২ বস্তা ভারতীয় চিনি। এভাবে দু-একদিন পরপর সিলেট, ময়মনসিংহসহ দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে উদ্ধার করা হচ্ছে ভারতীয় চোরাই চিনি। অন্যদিকে চট্টগ্রামে পুলিশ এবংর্ যাবের পৃথক দুটি অভিযানে অন্তত এক হাজার মেট্রিক টন ভারতীয় চিনি জব্দ করা হয়। আটককৃতদের জিজ্ঞাসাবাদে বের হয়ে আসে ভারতীয় চিনি পাচারের চাঞ্চল্যকর তথ্য। তাদের দাবি, মেহেরপুর-ঝিনাইদহ এবং কুমিলস্না-আখাউড়াসহ সিলেটের বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে প্রতিদিন ৫ হাজার মেট্রিক টনের বেশি চিনি বাংলাদেশ ঢুকছে। জানা গেছে, চোরাই পথে চিনির বড় একটি অংশ আসছে সুনামগঞ্জের তাহিরপুরসহ সিলেটের বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে। চোরাকারবারিদের আনা ভারতীয় চিনি দেশীয় ব্র্যান্ডের মোড়কে বাজার দখলে নেওয়ায় ব্যবসা হারাচ্ছেন ভোগ্যপণ্যের প্রকৃত ব্যবসায়ীরা। চিনির আমদানিকারক ও পরিশোধনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোও এ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। শুধু তা-ই নয়, চিনির আমদানিও কমিয়ে দিয়েছেন তারা। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, ২০২২-২৩ অর্থবছরের ডিসেম্বর-ফেব্রম্নয়ারি সময়ে দেশে অপরিশোধিত চিনি আমদানি হয়েছিল ৩ লাখ ৮৭ হাজার ৮৬৫ টন। অথচ ২০২৩-২৪ অর্থবছরের একই সময় আমদানি হয় ২ লাখ ৩৫ হাজার ৭৯৯ টন। সে হিসাবে চলতি অর্থবছরের উলিস্নখিত ৩ মাসে ১ লাখ ৫২ হাজার ৬৫ টন কম আমদানি হয়। বিক্রেতারা বলছেন, চিনি চোরাই পথে আনলেও তা বোঝার উপায় নেই। কারণ ভারত থেকে আনা চিনি দেশীয় প্রতিষ্ঠানের বস্তায় কিনতে হয়। তখন কোনটা চোরাই তা বুঝার উপায় থাকে না। তবে খুচরা বিক্রেতারা অনেকেই কম দামে চিনি কিনলেও তা চড়া লাভেই বাজার দরে বিক্রি করেন। অভিযোগ রয়েছে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী চোরাই পথে চিনি এনে আবার বড় বড় ব্যবসায়ীরা কাছে বিক্রি করে থাকে। যা বাজার পরিস্থিতি আরও জটিল করে তুলছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ সুগার রিফাইনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোস্তফা কামাল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে দেওয়া এক চিঠিতে চোরাই পথে ভারতীয় চিনি আসা বন্ধের আবেদন জানিয়েছেন। চিঠিতে সারাদেশে তৎপর ৩৬ জন চোরাকারবারির তালিকাও দিয়েছেন তিনি। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, 'আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ সংশ্লিষ্টরা চিনি চোরাচালান বন্ধে কাজ করছেন। তাদের আবেদনের পরে অনেক জায়গায় ভারতীয় চিনি ধরা হচ্ছে। বর্ডারেও অনেক ধরা হয়েছে। পরিস্থিতির অনেক উন্নতি হয়েছে। আমরা কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করেছি।'