পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে গুতেরেস

বাংলাদেশ জাতিসংঘের গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার

প্রকাশ | ০১ জুন ২০২৪, ০০:০০

যাযাদি ডেস্ক
বৃহস্পতিবার জাতিসংঘ সদর দপ্তরে সংস্থাটির মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন যুক্তরাষ্ট্র সফররত পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ -সংগৃহীত
বাংলাদেশকে জাতিসংঘের গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার বর্ণনা করে সংস্থাটির মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বলেছেন, 'বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা, টেকসই উন্নয়ন, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলাসহ জাতিসংঘের অনেক কর্মযজ্ঞে উলেস্নখযোগ্য অবদান রেখে চলেছে এবং সেই কারণে আমরা বাংলাদেশকে জাতিসংঘের গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হিসেবে বিবেচনা করি।' নিউইয়র্কে স্থানীয় সময় বৃহস্পতিবার বিকালে জাতিসংঘ সদর দপ্তরে সরকারি দায়িত্বে যুক্তরাষ্ট্র সফররত পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদের সঙ্গে বৈঠকে তিনি এ কথা বলেন। শুক্রবার দুপুরে এক বিজ্ঞপ্তিতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ তথ্য জানায়। বৈঠকে জাতিসংঘ মহাসচিব রোহিঙ্গাদের প্রতি বাংলাদেশের উদারতার জন্য গভীর কৃতজ্ঞতা জানান। তিনি মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের বর্তমান পরিস্থিতি, বিশেষ করে সে দেশের সেনাবাহিনীতে তরুণ রোহিঙ্গাদের জোরপূর্বক নিয়োগ করার ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেন। মহাসচিব জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে বাংলাদেশের অভিযোজন ও প্রতিকূলতা মোকাবিলার সক্ষমতার প্রশংসা করেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ নিম্নআয়ের দেশের কাতার থেকে বাংলাদেশের উত্তরণের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় জাতিসংঘের সহযোগিতা চান। এ সময় আন্তোনিও গুতেরেস বিশ্বসংস্থার পূর্ণ সমর্থন ব্যক্ত করে বলেন, 'এ জন্য বাংলাদেশকে পুরস্কৃত করা উচিত, শাস্তিদান নয়।' হাছান মাহমুদ ফিলিস্তিনের গাজায় সংঘাতসহ চলমান বিশ্বের কঠিন চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলায় মহাসচিবকে তার নেতৃত্বের জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, রাফায় সংঘাত এড়াতে সেখানে জাতিসংঘ মহাসচিব যেভাবে নিজে উপস্থিত হয়েছিলেন, শান্তিপ্রিয় বিশ্ববাসী তার প্রশংসা করেছে। এ সময় রোহিঙ্গা সংকটের ওপর বিশ্বের আলোকপাত বজায় রাখা, মিয়ানমার থেকে বাস্তুচু্যত হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া প্রায় ১৩ লাখ রোহিঙ্গার মর্যাদার সঙ্গে নিরাপদ ও টেকসই প্রত্যাবাসন এবং রাখাইনে সংঘাতময় পরিস্থিতির উন্নতিকল্পে জাতিসংঘের জোরালো ভূমিকা অব্যাহত রাখার আহ্বান জানান পররাষ্ট্রমন্ত্রী। জাতিসংঘ মহাসচিব গত দশকে বাংলাদেশের অসামান্য অগ্রগতির প্রশংসা করেন বৈঠকে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী মহাসচিবকে জানান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদৃষ্টি ও দক্ষ নেতৃত্বের কারণেই বাংলাদেশ অনেক আগেই সামাজিক, অর্থনৈতিক, মানবিক সূচকসহ সব সূচকে পাকিস্তানকে ছাড়িয়ে গেছে এবং গত কয়েক বছরে অনেক সূচকে ভারতকেও ছাড়িয়েছে। আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিলের পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২০২১ সালে মাথাপিছু আয়েও ভারতকে বাংলাদেশ ছাড়িয়েছে বলে উলেস্নখ করেন তিনি। বাংলাদেশের জাতিসংঘে যোগদানের অর্ধশত বছরপূর্তিতে আন্তোনিও গুতেরেসকে বাংলাদেশ সফরের আমন্ত্রণ জানান হাছান মাহমুদ। জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি রাষ্ট্রদূত মুহাম্মদ আবদুল মুহিত, পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সফরসঙ্গী ও মিশনের কর্মকর্তারা বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন। একই দিন বৈঠকের আগে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আন্তর্জাতিক শান্তিরক্ষী দিবস উদ্‌?যাপন উপলক্ষে জাতিসংঘ সদর দপ্তরে বাংলাদেশ ও অস্ট্রিয়ার যৌথ অভ্যর্থনা অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে যোগ দেন। এ সময় বক্তৃতায় জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে অন্যতম সর্বোচ্চ অবদান রাখা বাংলাদেশের অব্যাহত সমর্থন ও সহযোগিতার অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেন তিনি। পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, 'আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বৈদেশিক নীতি অনুযায়ী বাংলাদেশ সবসময় শান্তির প্রচেষ্টায় জাতিসংঘের অগ্রভাগে রয়েছে।' তিনি আরও বলেন, 'বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীরা জাতিসংঘ শান্তিরক্ষায় অত্যন্ত আন্তরিকতা, পেশাদারি ও নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন।' শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে এখন পর্যন্ত নিহত সবার পরিবার ও স্বজনের প্রতি গভীর সমবেদনা জানিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, বিশ্বময় সংঘাত ও সহিংসতার ক্রমাগত বৃদ্ধি শান্তির জন্য ক্রমবর্ধমান হুমকি এবং এ কারণে শান্তিরক্ষা কার্যক্রম জোরদার করার বিকল্প নেই। বক্তব্য শেষে হাছান মাহমুদ জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা কার্যক্রমের আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল জ্যঁ-পিয়েরে ল্যাক্রোইক্স ও অস্ট্রিয়ার চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স স্টেফান প্রিটেরহফারকে সঙ্গে নিয়ে আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য ২০২৩ সালে ৩৪টি দেশের ৬৪ জন আত্মদানকারী সামরিক, পুলিশ ও বেসামরিক শান্তিরক্ষীর নামফলকে গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। এ অনুষ্ঠানের আগে জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি মুহাম্মদ আবদুল মুহিত জাতিসংঘ মহাসচিবের কাছ থেকে ২০২৩ সালে শহীদ বাংলাদেশের দুই শান্তিরক্ষীর পক্ষে 'দ্যাগ হ্যামারশোল্ড মেডেল' গ্রহণ করেন। রোহিঙ্গা বিষয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ব্রিফিং: একইদিন বিকালে জাতিসংঘ সদর দপ্তরের ওআইসি সম্মেলনকক্ষে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ নিউইয়র্কে ইসলামি সহযোগিতা সংস্থাভুক্ত (ওআইসি) দেশগুলোর রাষ্ট্রদূতদের রোহিঙ্গা পরিস্থিতি সম্পর্কে অবহিত করেন। রোহিঙ্গাদের দুর্দশা নিরসনে আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টার অগ্রভাগে থাকার জন্য তিনি এ জোটের প্রশংসা করেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী রাখাইনে সংঘাত বৃদ্ধিতে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন ও বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের পূর্ণ নাগরিক অধিকারসহ তাদের মাতৃভূমি মিয়ানমারে নিরাপদ ও টেকসই প্রত্যাবাসনের প্রচেষ্টায় ওআইসি রাষ্ট্রদূতদের সংহতি অব্যাহত রাখার আহ্বান জানান। ওআইসিভুক্ত দেশ সৌদি আরব, গাম্বিয়া, পাকিস্তান, মালয়েশিয়া, তুরস্ক, ইরান, কাতার, সংযুক্ত আরব আমিরাত, আলজেরিয়া, মিসর, ইন্দোনেশিয়ার জাতিসংঘে স্থায়ী প্রতিনিধিরা সময়োপযোগী এ ব্রিফিংয়ের জন্য বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানান। তারা রোহিঙ্গাদের আশ্রয়দানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদারতার প্রশংসা ও রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে বাংলাদেশের দাবির প্রতি পূর্ণ সমর্থন ব্যক্ত করেন। 'সবাই আওয়ামী লীগ করতে চায়' এদিকে বৃহস্পতিবার নিউইয়র্কে আওয়ামী লীগের এক মতবিনিময় সভায় 'উল্টো-পাল্টা' লোকজন যেন না আসতে পারে, সেজন্য সবাইকে সজাগ থাকার আহ্বান জানিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ বলেন, 'এখন সবাই আওয়ামী লীগ করতে চায়। "উল্টো-পাল্টা মানুষ যাতে নৌকায় উঠতে না পারে, সেজন্য সবাইকে চোখ-কান খোলা রাখতে হবে।' জ্যাকসন হাইটস সংলগ্ন গুলশান টেরেসের মিলনায়তনে সভায় পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, 'উদ্ভট কথাবার্তা ছড়িয়ে গত নির্বাচনকেও বানচালে সক্ষম না হয়ে বিএনপি এবং জামায়াত এখন বিভিন্ন দেশে এজেন্ট নিয়োগ করেছে। ওই এজেন্টদের কাজ কী? সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিভ্রান্ত ছড়ানো। এখানকার সরকারের কাছে কিংবা আইন প্রণেতাদের কাছে নানা ধরনের বিভ্রান্তিমূলক খবর পাঠায় এবং এভাবে তাদেরকে (কংগ্রেসসহ স্টেট ডিপার্টমেন্ট) বিভ্রান্ত করার অপচেষ্টা চালায়। সেটার বিপরীতে আমাদের পক্ষ থেকে যদি সঠিক খবরটা পৌঁছানো না হয় তাহলে অনেক ক্ষেত্রেই অনেকে বিভ্রান্ত হয়। সুতরাং সেই কাজটি আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের করার জন্য অনুরোধ জানাচ্ছি।' তিনি আরও বলেন, 'গত নির্বাচনের পরে বিএনপিসহ তাদের মিত্ররা বসেছিল, বিশ্ব সম্প্রদায় এখন নতুন সরকারকে কী বলে, সে নিয়ে চাতক পাখির মতো তাকিয়ে ছিল। এ পর্যন্ত ৮০টি দেশের রাষ্ট্রপ্রধান, সরকারপ্রধান মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অভিনন্দন জানিয়েছে। ইউএন, ওআইসি, কমনওয়েলথ, বিশ্ব ব্যাংক, আইএমএফসহ ৩২টি আন্তর্জাতিক সংস্থা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে অভিনন্দন জানিয়েছে এবং এই যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি লিখে আমাদের মধ্যেকার সম্পর্ককে আরও উঁচুতে নিয়ে যাবার অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছেন। আমরাও সম্পর্ক আরও ঘনিষ্ঠ করতে কাজ করছি।' বিএনপির সমালোচনা করে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, 'বিএনপির ঠিকানা কই? ঠিকানা নয়া পল্টন, আর রাতে বিভিন্ন অ্যাম্বেসি। দেশের মানুষের সঙ্গে তাদের কোনো দেন-দরবার নেই। ক্ষমতার মালিক দেশের জনগণ, ক্ষমতার মালিক কোনো বিদেশি রাষ্ট্র নয়, কিংবা বিদেশি রাষ্ট্রদূতরা নয়।' সভায় বক্তব্য দেন যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগের নেতা বীর মুক্তিযোদ্ধা এম ফজলুর রহমান, নিজাম চৌধুরী প্রমুখ। নিউ ইংল্যান্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ইকবাল ইউসুফ, ওয়াশিংটন ডিসি আওয়ামী লীগের নেতা মাহমুদুন্নবী বাকি, কানেকটিকাট স্টেট আওয়ামী লীগের সেক্রেটারি হুমায়ূন চৌধুরীসহ বিভিন্ন স্টেট ও সিটির নেতারাও ছিলেন। ওয়াশিংটনে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মো. ইমরান, জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি ও রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ আব্দুল মুহিত, নিউইয়র্কে বাংলাদেশের কনসাল জেনারেল নাজমুল হুদা, ডেপুটি কনসাল জেনারেল এসএম নাজমুল হাসানও ছিলেন সভায়। সভার শুরুতে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুসহ মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের আত্মার মাগফেরাত এবং শেখ হাসিনার সুস্বাস্থ্য ও দীর্ঘায়ু কামনায় বিশেষ দোয়া করা হয়।