মহম্মদপুরে ইজিপিপি প্রকল্পে নানা অনিয়ম

প্রকাশ | ৩০ মে ২০২৪, ০০:০০

এস আর এ হান্নান, মহম্মদপুর (মাগুরা)
কর্মস্থলে সঠিক সংখ্যক শ্রমিক অনুপস্থিত অপ্রয়োজনীয় রাস্তায় প্রকল্প গ্রহণ কম মাটি ফেলে কাজ সমাপ্ত করা তথ্য দিতে গড়িমসি প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার প্রকল্প সংক্রান্ত তথ্য সংবলিত সাইনবোর্ডও দেখা যায়নি
মাগুরার মহম্মদপুর উপজেলায় ২০২৩-২৪ অর্থবছরে অতিদরিদ্রদের জন্য কর্মসংস্থান কর্মসূচির (ইজিপিপি) আওতায় দ্বিতীয় পর্যায়ের ৫১টি প্রকল্পের কাজে নানা অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। কাজের জন্য যে সংখ্যক শ্রমিক নিয়োগের কথা কাগজ-কলমে উলেস্নখ করা হয়েছে, মাঠে সেই সংখ্যক শ্রমিককে শ্রম দিতে দেখা যায়নি। আবার যে রাস্তায় প্রকল্প গ্রহণের প্রয়োজন নেই, সে রকম রাস্তাতেও প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, একই রাস্তায় প্রতিবছর অপ্রয়োজনীয় সংস্কারের নামে অর্থ অপচয়। যেসব রাস্তায় মাটি ভরাটের প্রয়োজন, এতেও কম মাটি ফেলে কোনোরকম চেছে সমান করে কাজ সমাপ্ত করা হয়েছে। এ ছাড়া সরেজমিন গিয়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন-সংক্রান্ত তথ্য সংবলিত কোনো সাইনবোর্ডও দেখা যায়নি। এসব বিষয়ে জানতে এই প্রতিনিধি উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) মমিনুল ইসলামের কাছে গেলে, তিনি তথ্য দিতে গড়িমসি করছেন। ফলে সরকারের বিপুল পরিমাণ অর্থের সুফল থেকে উপজেলার মানুষ বঞ্চিত হতে পারেন বলে শঙ্কা করছেন সচেতন মহল। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ইজিপিপি'র আওতায় দ্বিতীয় পর্যায়ের ৫১টি প্রকল্পের কাজ কাগজ-কলমে শুরু হয়েছে গত ১৫ এপ্রিল থেকে। মূলত কাজ শুরু হয় আরও দুই থেকে তিন দিন পর। প্রকল্পে মোট শ্রমিক সংখ্যা দুই হাজার ৬৬১ জন। মাথাপিছু দৈনিক ৪০০ টাকা মজুরি হিসাবে দুই হাজার ৬৬১ জন শ্রমিকের ৩৩ দিনে টাকার অংক দাঁড়ায় সাড়ে তিন কোটিরও বেশি। এর মধ্যে বাবুখালী ইউনিয়নে ছয়টি প্রকল্পে ৩৬০ জন শ্রমিক, বিনোদপুরে ছয়টি প্রকল্পে ৩৬৫, দীঘায় আটটি প্রকল্পে ২৫৯, রাজাপুরে চারটি প্রকল্পে ২৫১, বালিদিয়ায় আটটি প্রকল্পে ৩৫৬, মহম্মদপুর সদরে পাঁচটি প্রকল্পে ৩৭১, পলাশবাড়ীয়ায় আটটি প্রকল্পে ৩৬৯ জন শ্রমিক এবং নহাটা ইউনিয়নে ছয়টি প্রকল্পে ৩৮৪ জন শ্রমিক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। গৃহীত প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য ৫১ জন ইউপি সদস্য ও সংরক্ষিত মহিলা সদস্যকে প্রকল্পের চেয়ারম্যান (পিআইসি বা প্রকল্পের সভাপতি) করা হয়। প্রকল্পগুলোর সার্বিক তদারকির দায়িত্বভার স্ব স্ব ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা এবং উপজেলা নির্বাহী অফিসারের। গত ১৩, ১৪, ১৬, ১৮ এবং ১৯ মে সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, বিভিন্ন রাস্তায় মাটি ভরাটের জন্য সপ্তাহে ছয়দিন (শনি থেকে বৃহস্পতিবার) দৈনিক চারশ' টাকা মজুরিতে শ্রমিকদের সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৩টা পর্যন্ত মোট সাত ঘণ্টা কাজ করার কথা থাকলেও তা মানা হচ্ছে না। মেলে নানান অনিয়ম ও অসঙ্গতি। ১৩ মে সকাল ৯-৩৫ মিনিটের সময় মহম্মদপুর সদর ইউনিয়নের অন্তর্গত উপজেলা সদরের মোস্তাফিজুর রহমানের বাড়ি থেকে (বাওড়ের ধার) তেলিপুকুর তোতা মিয়ার বাড়ি পর্যন্ত মাটি দ্বারা রাস্তা সংস্কার প্রকল্পের কাজে ৬১ জন (নারী ও পুরুষ) শ্রমিকের কাজ করার কথা। কিন্তু সেখানে পাওয়া গেল মাত্র ২৪ জন। ৩৭ জন শ্রমিক ছিলেন অনুপস্থিত। এই প্রকল্পে দুপুর ১২-১৫ মিনিটের গিয়ে একই চিত্র চোখে পড়ল। বিকাল ৩টা পর্যন্ত কাজ করার কথা থাকলেও সোয়া ১টার সময় গিয়ে কাউকেই পাওয়া যায়নি। প্রায় প্রতিবছরই এই রাস্তাটিতে প্রকল্প নেওয়া হয়। তবে স্থানীয়রা জানান, রাস্তাটিতে মাটি দেওয়ার প্রয়োজন নেই বললেই চলে। পুরো রাস্তায় মাটি দেওয়াও হচ্ছে না। এখানে ৬৭ হাজার ৩২০ ঘনফুট মাটি দেওয়ার কথা। মহম্মদপুর সদর ইউপি চেয়ারম্যান ইকবাল আক্তার কাফুর উজ্জ্বল বলেন, 'আমরা অনুপস্থিত শ্রমিকদের তালিকা তৈরি করেছি। তাদের বাদ দিয়ে যারা উপস্থিত থাকছে, কাজে আসছে, তাদের তালিকা তৈরি করে বিলের জন্য সংশ্লিষ্ট বিভাগে জমা দেব।' ১৪ মে সকাল সোয়া ১০টায় পলাশবাড়ীয়া ইউনিয়নের বলভদ্রপুর গ্রামের আদায় বিশ্বাসের বাড়ি থেকে শংকর মাস্টারের বাড়ি পর্যন্ত রাস্তা সংস্কারে ৭৯ জন শ্রমিকের কাজ করার কথা থাকলেও সেখানে গিয়ে একজন শ্রমিকের হদিসও পাওয়া যায়নি। স্থানীয় আব্দুর রহিম জানান, 'কয়েকদিন ১৭-১৮ জন শ্রমিক কোদাল দিয়ে চেঁচে-ছুলে কয়েক জায়গায় ড্রেসিং করেছে। এই রাস্তাটির কোথাও মাটি দেওয়া হয়নি। একই দিন দুপুর সোয়া ১২টায় ওই প্রকল্পে গিয়ে শ্রমিকশুন্যই পাওয়া যায়। এখানে ৭৮ হাজার ২১০ ঘনফুট মাটি দেওয়ার কথা।' পলাশবাড়ীয়া ইউপি চেয়ারম্যান সৈয়দ সিকান্দার আলী বলেন 'বর্ষাকালে মাটি দিলে কাদা হয়ে চলাচলের অনুপযোগী হয়ে যায়। সে কারণে চেঁচে-ছুলে ভালো করা হয়।' ১৬ মে সকাল ১০-২৮ মিনিটের সময় দীঘা ইউনিয়নের সিন্দাইন সাইফারের বাড়ি থেকে দোয়াল পর্যন্ত রাস্তা সংস্কার কাজ দেখতে গিয়ে সেখানে ৯জনকে দেখা যায়। এখানে ২৫ জন শ্রমিকের কাজ করা কথা থাকলেও ১৬ জন অনুপস্থিত ছিলেন। এখানে ২৪ হাজার ৭৫০ ঘনফুট মাটি দেওয়ার কথা। একই ইউনিয়নের নাগড়িপাড়া হুমায়নের বাড়ি থেকে কুমরুল মনোয়ারের বাড়ি পর্যন্ত রাস্তা সংস্কার প্রকল্প দেখানো হয়েছে। স্থানীয় আনিচ মেম্বারের বাড়ি পর্যন্ত কাঁচা রাস্তা রয়েছে। এরপর কার্পেটিং রাস্তা। এখানে ২৮ জন শ্রমিকের কাজের কথা থাকলেও কাউকেই পাওয়া যায়নি। স্থানীয় আব্দুল বারিক মোল্যার ছেলে হুমায়ন জানান, 'এই রাস্তায় বিপস্নব নামের এক ব্যক্তি মাটি দেয়। সেই রাস্তায় প্রকল্পের শ্রমিকরা কয়েকদিন এসে কোদাল দিয়ে চেঁচে-ছুলে চলে গেছে।' এদিন বেলা সাড়ে ১১টার সময় সেখানে গিয়ে একজন শ্রমিককেও পাওয়া যায়নি। এখানে ২৭ হাজার ৭২০ ঘনফুট মাটি দেওয়ার কথা। এই প্রকল্পের সভাপতি ইউপি সদস্য আনিচ শিকদার বলেন, 'স্থানীয় একজন রাস্তায় মাটি দিয়েছিল, প্রকল্পের শ্রমিকরা সেই মাটি সমতল করে দিয়েছে।' এই ইউনিয়নের ভাটরা বুলবুলের ফার্ম থেকে নায়েবের জমি পর্যন্ত রাস্তা সংস্কার প্রকল্পে দুপুর সোয়া ১২টার সময় গিয়ে কোনো শ্রমিকের দেখা মেলেনি। এই রাস্তার কিছু কিছু জায়গার ঘাস-দুর্বা শ্রমিকরা কোদাল দিয়ে চেছে দুই পাশে রেখে দিয়েছে। সেখানে ২৫ জন শ্রমিকের কাজ করার কথা থাকলেও কোনো শ্রমিকের উপস্থিতি পাওয়া যায়নি। পরে প্রকল্পের শ্রমিকদের সরদার আব্দুর রাজ্জাক ফকির সেখানে আসেন। তিনি জানান, 'এই রাস্তাটির ঘাস-দুর্বা চেছে পরিষ্কার করা হচ্ছে।' এখানে ২৪ হাজার ৭৫০ ঘনফুট মাটি দেওয়ার কথা। একই ইউনিয়নের ভাটরা ব্রিজ থেকে বিলঝলমল শুকুরের বাড়ি পর্যন্ত রাস্তা সংস্কার প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। এই প্রকল্পটি বিলঝলমল শুকুরের বাড়ি পর্যন্ত নয়; বরং সোনাপুর-নাগড়িপাড়া পর্যন্ত। দুপুর ১২-২৮ মিনিটে সেখানে গিয়ে ২৯ জন শ্রমিকের মধ্যে ১৮ জনকে কাজ করতে দেখা গেছে। ১১ জন ছিলেন অনুপস্থিত। তবে মাটি দেওয়া থেকে কোদাল দিয়ে চেছে রাস্তা সমান করার কাজ বেশি। এখানে ২৮ হাজার ৭১০ ঘনফুট মাটি দেওয়ার কথা। এদিন দুপুর ১২-১৮ মিনিটে দীঘা ইউনিয়নের আউনাড়া আহম্মেদেরে বাড়ি থেকে বাদশার বাড়ি পর্যন্ত রাস্তা সংস্কার প্রকল্পে গিয়ে একজন শ্রমিককেও পাওয়া যায়নি। এখানে ৫০ জন শ্রমিকের কাজ করার কথা। আহম্মেদের বাড়ি থেকে বাদশার বাড়ি পর্যন্ত এই রাস্তায় একটি বসতি পরিবারও নেই। বাদশার বাড়ি কার্পেটিং রাস্তার সঙ্গে মেশা। এই রাস্তাটিতে যে পরিমাণ মাটি দেওয়া হয়েছে, তা ৫০ জন শ্রমিকের দুই দিনের কাজও নয়। এখানে ৪৯ হাজার ৫০০ ঘনফুট মাটি দেওয়ার কথা। এ বিষয়ে বক্তব্য চাইলে দীঘা ইউপির চেয়ারম্যান খোকন মিয়া বলেন, 'এটা নিয়ে পরে আপনার সঙ্গে কথা বলব।' ১৮ মে বেলা ১১-৫৫ মিনিটের সময় বিনোদপুর ইউনিয়নের ঘলিস্নয়া কবরস্থানে মাটি ভরাট প্রকল্পে গিয়ে একজন শ্রমিককে পাওয়া যায়নি। এখানে ৫১ জন শ্রমিকের কাজ করার কথা। কবরস্থান ঘুরে কোথাও এক ঝুড়ি মাটি দেওয়ার চিহ্ন চোখে পড়েনি। এখানে ৫০ হাজার ৪৯০ ঘনফুট মাটি দেওয়ার কথা। বিনোদপুর ইউপি চেয়ারম্যান শিকদার মিজানুর রহমান বলেন, 'এ বিষয়ে প্রকল্পের সভাপতির সঙ্গে কথা বলেন।' পরে প্রকল্পের সভাপতি ইউপি সদস্য জাহাঙ্গীর আলমের সঙ্গে কথা বললে তিনি জানান, ঈদগাঁয় মাটি দেওয়া হয়েছে। প্রকল্পের তথ্যমতে 'ঘুলিস্নয়া কবরস্থানে মাটি ভরাট' প্রসঙ্গে তিনি বলেন, 'প্রকল্পের নাম ভুল হয়েছে।' ১৮ মে বেলা ১১-৫৫ মিনিটের সময় নহাটা ইউনিয়নের নিভৃত-দুর্গম এলাকা নবনগর উত্তমের বাড়ি থেকে খোকনের বাড়ি পর্যন্ত রাস্তা সংস্কার কাজ দেখতে গিয়ে কোনো শ্রমিককেই পাওয়া যায়নি। এখানে ৫৮ জন শ্রমিকের কাজ করার কথা। এই রাস্তার কয়েক স্থানে কিছু মাটি দেওয়া হয়েছে। এখানে ৫৭ হাজার ৪২০ ঘনফুট মাটি দেওয়ার কথা। নহাটা ইউপির চেয়ারম্যান তৈয়েবুর রহমান তুরাব জানেন না কবে শেষ হবে প্রকল্পের কাজ। তিনি জানেন, কাজ শেষ হয়ে গেছে। তিনি খোঁজ খবর নিয়ে জানাবেন বলে জানান। প্রকল্পের তথ্য জানতে গড়িমসি করছেন উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) মমিনুল ইসলাম। ইউএনও'র সঙ্গে আলোচনা করে তথ্য দেওয়া হবে বলে তিনি জানালেও গত ২৪ এপ্রিল থেকে গত ১২ মে পর্যন্ত দীর্ঘ ১৮ দিনেও তিনি কোনো তথ্য দেননি। উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) মমিনুল ইসলাম বলেন, 'আপনি আগে চেয়ারম্যানদের বক্তব্য নেন। ইউএনও স্যারের সঙ্গে কথা না বলে এ বিষয়ে আমি কোনো বক্তব্য দিতে পারব না।' এ বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির সভাপতি পলাশ মন্ডল বলেন, 'দায়িত্বপ্রাপ্ত ট্যাগ অফিসার ও প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার চলমান কর্মসূচি দেখভাল বা তদারকির কথা। আপনার মাধ্যমে বিষয়টি জানলাম। তদন্তপূর্বক প্রয়োজনীয় ব্যাবস্থা নেওয়া হবে।'