শনিবার, ১২ অক্টোবর ২০২৪, ২৮ আশ্বিন ১৪৩১

কেরানীগঞ্জে মাদকের ছড়াছড়ি বেড়েছে চুরি-ছিনতাই

মাসুম পারভেজ, কেরানীগঞ্জ (ঢাকা)
  ৩০ মে ২০২৪, ০০:০০
কেরানীগঞ্জে মাদকের ছড়াছড়ি বেড়েছে চুরি-ছিনতাই

মাদকের বিরুদ্ধে সরকারের জিরো টলারেন্স থাকার পরেও ঢাকার কোলঘেঁষা কেরানীগঞ্জে হাত বাড়ালেই মিলছে সর্বনাশা সব মাদক। এলাকায় যুবসমাজের বড় একটি অংশ মাদকে আসক্ত হয়ে পড়েছে। শুধু মাদকের টাকা জোগাড় করতে নেশায় আসক্ত এসব যুবক জড়িয়ে পড়ছে চুরিসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকান্ডে। সম্প্রতি চুরি, ছিনতাই, হামলাসহ নানা ধরনের অপরাধ বেড়ে যাওয়ার মূলে রয়েছে মাদক ব্যবসা ও সেবন। এলাকায় প্রায়ই ঘটছে দিনদুপুরে চুরির ঘটনা। দিন দিন অবস্থা ক্রমেই খারাপের দিকে যাচ্ছে।

উপজেলাটির দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানার কদমতলি গোলচত্বর ও চুনকুটিয়া চৌরাস্তা এলাকার বিভিন্ন অলিগলির মোড়ে নিত্যদিন সন্ধ্যার পর ঘটে চুরি-ছিনতাইয়ের ঘটনা। বাদ যাচ্ছে না ঢাকা-মাওয়া সড়ক-মহাসড়কও। গভীর রাতে সড়কে চলাচলরত পথচারীদের ধারালো অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে কেড়ে নেওয়া হচ্ছে সর্বস্ব। স্কুল-কলেজগামী শিক্ষার্থী ছাড়াও সমাজের উঠতি বয়সের অনেক তরুণ নেশার টাকা জোগাড় করতে না পেরে আত্মহত্যার মতো কঠিন পথ পর্যন্ত বেছে নিচ্ছে। এসব নিয়ে ভীষণ দুশ্চিন্তায় আছেন অভিভাবকরা। অনেকেই নেশায় আসক্ত সন্তানদের সুপথে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হচ্ছেন।

সরেজমিনে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সন্ধ্যা নামলেই মাদকের আড্ডা বসে উপজেলার শুভাঢ্যা, জিনজিরা, আগানগর, বাস্তা ও শাক্তা ইউনিয়নসহ ১২টি ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকায়। এসব এলাকায় একাধিক মাদক কারবারি প্রকাশ্যে মাদক ব্যবসা করছেন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা মাদকদ্রব্য বিক্রির স্পটগুলোতে মাঝেমধ্যে অভিযান চালিয়ে মাদক কারবারিদের আটক করলেও সাক্ষীর অভাবে আইনের ফাঁকফোকর গলিয়ে বেরিয়ে যায় তারা। এরপর আবারও জড়িয়ে পড়ে মাদক ব্যবসায়। এদিকে উঠতি বয়সি কিশোররা বিভিন্ন অপরাধে যুক্ত হচ্ছে। এতে কিশোর গ্যাং নামে আত্মপ্রকাশ ঘটছে অপরাধী চক্রের। কিছু অসাধু ও ক্ষমতাধর ব্যক্তিও সক্রিয়ভাবে মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। এ কারণে তারা থেকে যান ধরাছোঁয়ার বাইরে। এসব মাদক কারবারি ও সেবনকারী রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় থেকে প্রকাশ্যে মাদক ব্যবসা ও সেবন করে যাচ্ছে। কেরানীগঞ্জ এলাকাটি পরিণত হয়েছে সন্ত্রাসী ও ছিনতাইকারীদের বিচরণ ভূমিতে। ঢাকা-মাওয়া মহাসড়কেও একাধিক ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছে। একাধিক তরুণ ঘুরে ঘুরে বিক্রি করছে ফেনসিডিল, ইয়াবা ও গাঁজাসহ বিভিন্ন মাদকদ্রব্য। একটু সন্ধ্যা বা রাত নামলেই কেরানীগঞ্জের বিশ্বরোড এলাকার সড়কের আশপাশে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে সাধারণ মানুষের সর্বস্ব লুটে নিচ্ছে তারা। সম্প্রতি কেরানীগঞ্জের বামনশুর সড়কে বৃদ্ধ আব্দুল হামিদকে (৬৫) কৌশলে নেশাজাতীয় দ্রব্য মিশ্রিত জুস খাইয়ে অচেতন করে ছিনতাইকারীরা অটোরিকশা নিয়ে পালিয়ে যায়। পরে স্থানীয় মাধ্যমে আব্দুল হামিদ উদ্ধার হলেও চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান তিনি।

সূত্র মতে, দক্ষিণ কেরানীগঞ্জে চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসা ও সন্ত্রাসী কর্মকান্ড চালাতে ব্যবসায়ী ও যুবকসহ নানা শ্রেণিপেশার মানুষকে তুলে এনে তথাকথিত টর্চার সেল বানিয়ে নির্যাতন করা হতো। ৯, ১২ ও ১৩ মার্চ সন্ধ্যায় দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের আব্দুলস্নাহপুর, হাসনাবাদ ও রাজেন্দপুর এলাকার তিন চালককে চেতনানাশক মেশানো রুমাল দিয়ে অজ্ঞান করে তাদের অটোরিকশা ছিনতাই ও নগদ টাকা নিয়ে পালিয়ে যায় একটি চক্র।

এ বিষয়ে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) কর্মকর্তা মামুন অর রশিদ বলেন, ঘটনার পর ২৪ মার্চ দুপুরে ১০টি চোরাই অটোরিকশা ও ছিনতাই কাজে ব্যবহৃত একটি হাইস গাড়িসহ অজ্ঞান পার্টির ১৭ সদস্যকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। গ্রেপ্তারকৃতরা অটোরিকশা চোর চক্রের একটি সংঘবদ্ধ দল। তারা কেরানীগঞ্জের বিভিন্ন সড়কে অটোরিকশা চালকদের রুমাল দিয়ে অজ্ঞান করে অটোরিকশা ছিনতাই করত।

এছাড়া মাদক কারবার সম্পর্কে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে তথ্য দেওয়ার কারণে গত বছরের ৩০ জুলাই দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ এলাকার সন্ত্রাসী ও মাদক কারবারির হাতে নৃশংসভাবে খুন হন কাপড়ের ব্যবসায়ী সাইফুল ইসলাম।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক শামসুল আলম ও দিদার হোসেন (ছদ্মনাম) অভিযোগ করেন, রোজ সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত মাদকসেবী এবং মাদক ব্যবসায়ীরা উপজেলার ইকুরিয়া জেলেপাড়া ও টিলাপাড়া এলাকায় এসে জড়ো হন। টিনশেডের বাড়িতে মাদক সেবনের আড্ডা বসে। অন্য বাড়ি থেকে মাদক বিক্রি করা হয়। অনেক দূর থেকেও মোটর সাইকেলে করে মাদকসেবীরা এখানে মাদক কিনতে আসেন। সেবন করেন অন্যত্র। মাঝেমধ্যে পুলিশ টহল দিতে আসে বটে, তবে আশপাশে মাদক বিক্রেতাদের লোক থাকেন। পুলিশ দেখলেই তারা মুঠোফোনে বিক্রেতাদের সাবধান করে দেন। সবাই কিছুক্ষণের জন্য গা-ঢাকা দেন। পুলিশ চলে গেলে অবস্থা আবার আগের মতোই হয়।

তারা আরও জানান, দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানার হাসনাবাদ হাউজিং প্রকল্প, ইকুরিয়া পশ্চিম, মুসলিমনগর, বেয়ারা, খেজুরবাগ সাতপাখি এলাকায় মাদক বিক্রির সবচেয়ে বড় ঘাঁটি রয়েছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরেকজন জানান, কেরানীগঞ্জ মডেল থানায় মাদক বিক্রি বেশি হয় জিনজিরা এলাকায়। এখানে বড় ঘাঁটি রয়েছে রহমতপুর টাওয়ার ঘাট, হাফেজ সাহেব ঘাট, রসুলপুর পাকা ঘাট, মান্দাইল খালেরঘাট, সেন্টু, বেড়িবাঁধ এলাকায়। এছাড়া তারানগর, বেউতা, কলমারচর, বটতলী ও শাক্তা ইউনিয়নের জিয়ানগর, নবাবচর এলাকায় সারাদিনে প্রকাশ্যে মাদক বেচাকেনা হয়।

স্থানীয়রা বলেন, পুলিশের তালিকাভুক্ত মাদক ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে জরুরিভিত্তিতে কঠোর ব্যবস্থা না নিলে যুবসমাজ ধ্বংস হয়ে যাবে। মাদক সিন্ডিকেট শিকড় থেকে উপড়ে ফেলতে হবে। তা না হলে সমাজে এই মাদকের ভয়াল থাবা থেকে কেউই নিরাপদ নয়।

কেরানীগঞ্জ মডেল থানা অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মোস্তফা কামাল বলেন, 'মাদকের বিষয়ে কোনো ছাড় নেই। মাদকের বিরুদ্ধে প্রতিদিন পুলিশের একাধিক দল বিভিন্ন এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে। মাদক কারবারি যেই হোক, তাকে আইনের আওতায় নিয়ে আসা হবে।'

সার্বিক বিষয়ে ঢাকা জেলা পুলিশ সুপার মো. আসাদুজ্জামান বলেন, 'মাদক নির্মূলে আমার থানার প্রতিটি অফিসার কাজ করে যাচ্ছেন। কোনোভাবেই মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িতদের ছাড় দেওয়া হবে না। উপজেলায় অপরাধ দমনে পুলিশকে সহযোগিতার জন্য সমাজের সর্বস্তরের মানুষকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।'

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে