শুক্রবার, ১১ অক্টোবর ২০২৪, ২৭ আশ্বিন ১৪৩১
বাকলিয়ার চরে বর্জ্য শোধনাগার

কর্ণফুলীর দুই তীরের জনজীবনে আনতে পারে ভয়ংকর বিপদ

প্রকল্প বাস্তবায়নে চলছে মাটি পরীক্ষার কাজ, বিরূপ প্রভাব পড়বে দেশের অর্থনীতির ওপর, প্রতিবাদে আজ চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন ঘেরাও, পরিবেশবান্ধব ইকোটু্যরিস্ট স্পট গড়ার পরামর্শ
খোরশেদুল আলম শামীম, চট্টগ্রাম
  ২৭ মে ২০২৪, ০০:০০
কর্ণফুলীর দুই তীরের জনজীবনে আনতে পারে ভয়ংকর বিপদ

চট্টগ্রামের বাকলিয়ায় কর্ণফুলী নদীতে জেগে ওঠা চরে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের বর্জ্য শোধনাগার স্থাপনের পরিকল্পনায় সচেতন মহলে চরম উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা ও ক্ষোভ বিরাজ করছে। তারা বলছেন- চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (চসিক) এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করলে দূষণ-দখলে রুগ্‌ণ কর্ণফুলী বাঁচানো দুষ্কর হয়ে পড়বে। শুধু যে পরিবেশ ধ্বংস হবে, তা নয়- এর বিরূপ প্রভাব পড়বে দেশের অর্থনীতির ওপরও। বিশেষ করে কর্ণফুলীর দুই তীরে বিস্তীর্ণ জনপদের জনজীবনে বয়ে আনবে ভয়ংকর বিপদ।

এজন্য প্রকল্প বন্ধ চেয়ে আজ সোমবার চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন ঘেরাও কর্মসূচি করবেন পরিবেশবিদরা। পাশাপাশি উচ্চ আদালতে নির্দেশ অমান্য করাসহ সংশ্লিষ্ট আইনে প্রতিকার প্রার্থনা করে লিগ্যাল নোটিশ প্রদান ও হাইকোর্টে রিট মামলা দায়ের করার ঘোষণা দিয়েছে পরিবেশ সংশ্লিষ্ট সংগঠনগুলো।

কর্ণফুলী শাহ আমানত সেতু থেকে প্রায় দেড় কিলোমিটার উজানে কর্ণফুলী নদীর মাঝখানের একটি চর। ১৯৩০ সালে তৎকালীন ব্রিটিশ আমলে কালুরঘাট সেতু নির্মাণের কারণে ধীরে ধীরে নদীর মাঝখানে এই চর জেগে ওঠে। সম্প্রতি চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ চরটির পশ্চিম-দক্ষিণ পাশে কিছুটা খনন করেছে। এটির মোট আয়তন প্রায় ১০৫ একর বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন। তবে বর্তমানে চরটি সরকারি এক নম্বর খাস খতিয়ানে নদী শ্রেণির জমি হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। এই চরটিতে বর্জ্য শোধনাগার করার জন্য ২০২৩ সালের অক্টোবরে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের অনুকূলে খাসজমি দীর্ঘমেয়াদি বন্দোবস্ত প্রদানের একটি আবেদন ভূমি মন্ত্রণালয়ে করা হয়। বর্তমানে চরটিতে বর্জ্য শোধনাগার প্রকল্প স্থাপনের জন্য মাটি পরীক্ষার কাজ চলমান রয়েছে।

জানা গেছে, কর্ণফুলী নদীর প্রাণপ্রকৃতি, উদ্ভিদ বৈচিত্র্য ও দূষণ নিয়ে বন্দরনগর ভিত্তিক পরিবেশ সংস্থা ইফেক্টিভ ক্রিয়েশন অন হিউম্যান ওপিনিয়ন (ইসিএইচও) ২০২২ সালে এক গবেষণা চালায়। তাতে দেখা যায়- কর্ণফুলী নদীর তীরবর্তী ৮১ প্রজাতির উদ্ভিদ বিলুপ্তির ঝুঁকিতে রয়েছে। দূষণ রোধে কোনো ব্যবস্থা না নিলে আরও ৬১ প্রজাতির উদ্ভিদ বিপন্ন হয়ে পড়বে। ৫৩টি শিল্পসহ ৮৯টি উৎস থেকে কর্ণফুলী নদী দূষিত হচ্ছে। গবেষণায় কর্ণফুলী নদীর তীরে ৫২৮ প্রজাতির উদ্ভিদ পাওয়া গেছে। এমন প্রেক্ষাপটে জনগণের প্রতিবাদ মঞ্চের নেতারা ঝুঁকিতে থাকা ৮১ প্রজাতির দেশীয় উদ্ভিদ সংগ্রহ করে সেগুলোর চারা চরে লাগানোর দাবি জানান। তাতে কর্ণফুলী নদী প্রাণ ফিরে পাবে বলে তারা মনে করেন।

চট্টগ্রাম নদী ও খাল রক্ষা আন্দোলনের সভাপতি চৌধুরী ফরিদ ও সাধারণ সম্পাদক আলীউর বলেন, '২০১৯ সালের জানুয়ারিতে উচ্চ আদালতের রায়ে আমাদের দেশের নদীগুলোকেও জীবন্ত সত্তা, জুরিসটিক পারসন বা লিগ্যাল পারসন হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। মূলত এর মাধ্যমে মানুষের মতো নদীর মৌলিক অধিকার স্বীকৃত হয়েছে। হাইকোর্টের এই আদেশ অনুযায়ী নদীর মাঝখানে বর্জ্য শোধনাগার প্রকল্প করা অবৈধ এবং আদালতের আদেশের লঙ্ঘন করে। সুতরাং এই প্রকল্প হতে পারে না। আমাদের সংবিধানেও উলেস্নখ আছে, 'রাষ্ট্র বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নাগরিকদের জন্য পরিবেশ সংরক্ষণ ও উন্নয়ন করিবেন এবং প্রাকৃতিক সম্পদ, জীববৈচিত্র্য, জলাভূমি, বন ও বন্যপ্রাণীর সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা বিধান করিবেন।' কোটি মানুষের চট্টগ্রাম নগরের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা খুবই নাজুক। বর্জ্য শোধনাগারের প্রয়োজনীয়তার কথা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। কিন্তু যে জায়গায় এটি স্থাপনের পরিকল্পনা করা হচ্ছে সেটি মোটেও পরিবেশবান্ধব, জনবান্ধব এবং চট্টগ্রামবান্ধব হবে না। কর্ণফুলীর ওপর অনেক অত্যাচার হয়েছে, নিপীড়নে নিপীড়নে জর্জরিত একটি নদী। এই নদীর ওপর আর নিপীড়ন নয়।'

কর্ণফুলী নদী গবেষক বীর মুক্তিযোদ্ধা প্রফেসর ড. ইদ্রিস আলী বলেন, 'নদী ভরাট হয়ে জেগে ওঠা দ্বীপ এমনিতেই কর্ণফুলীকে দুই ভাগ করেছে। উন্নয়নের নাম দিয়ে এই চর বা দ্বীপে বিষাক্ত বর্জ্য শোধনাগার স্থাপনের পরিকল্পনা আত্মঘাতী। এটি কর্ণফুলীকে হত্যা করবে। চসিক মেয়রকে এই কাজ করার কুপরামর্শ যারা দিয়েছেন, তারা দেশের শত্রম্ন। বীর মুক্তিযোদ্ধারা আধুনিক প্রজন্মকে নিয়ে এই অন্যায় প্রতিহত করবে।'

কর্ণফুলী রক্ষায় জনগণের প্রতিবাদ মঞ্চের আহ্বায়ক বীর মুক্তিযোদ্ধা ডাক্তার মাহফুজুর রহমান বলেন, 'জনগণের দাবি সসম্মানে মেনে বর্জ্য শোধনাগার প্রকল্প স্থাপন বন্ধ করুন। প্রয়োজনে মুক্তিযোদ্ধা, যুবসমাজ, সাম্পান মাঝিরা লাঠি-বইঠা নিয়ে মেয়রের কার্যালয় ঘেরাও করা হবে। দেশকে ধ্বংস করে কার স্বার্থে কিসের এই প্রকল্প?'

প্রতিবাদে আজ চসিক ঘেরাও কর্মসূচি

বর্জ্য শোধনাগার প্রকল্প বন্ধের দাবিতে আজ সোমবার চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন ঘেরাও কর্মসূচি পালন করা হবে। পাশাপাশি উচ্চ আদালতে নির্দেশ অমান্য করাসহ সংশ্লিষ্ট আইনে প্রতিকার প্রার্থনা করে লিগ্যাল নোটিশ প্রদান ও হাইকোর্টে রিট মামলা দায়ের করার ঘোষণা দিয়েছে চট্টগ্রাম নদী ও খাল রক্ষা আন্দোলন, বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি বেলা, বাংলাদেশ পরিবেশ ফোরাম, চট্টগ্রাম ইতিহাস সংস্কৃতি গবেষণা কেন্দ্র, আরএসকে ফাউন্ডেশন, কর্ণফুলী নদী সাম্পান মাঝি কল্যাণ সমিতি ফেডারেশন, গ্রিন ফিঙ্গার্স ফাউন্ডেশন, তারকেশ্বর দস্তিদার স্মৃতি পরিষদ এবং চট্টগ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধারা। সবার সমন্বয়ে গড়ে তোলা হয়েছে 'কর্ণফুলী রক্ষায় জনগণের প্রতিবাদ মঞ্চ'। পরিবেশে ক্ষতিকারক এমন স্থাপনা নির্মাণ পরিকল্পনা বাতিলের জন্য যে কোনো কঠিন আন্দোলনে যেতে তারা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।

পরিবেশবান্ধব ইকোটু্যরিস্ট স্পট গড়ার পরামর্শ

এদিকে, আন্দোলনকারীরা বলছেন, পৃথিবীতে অনেক দেশে নদী বা সাগরের মাঝখানে জেগে ওঠা চরে নান্দনিক পর্যটন কেন্দ্র স্থাপিত হয়েছে। সেগুলো দেশি-বিদেশি পর্যটকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। কিন্তু চট্টগ্রাম মহানগরীতে বিনোদনের তেমন কোনো স্থান নাই। তাই চর বাকলিয়ায় পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি ব্যবহার করে এটি ইকোটু্যরিস্ট স্পট গড়ে তোলা যেতে পারে বলে পরামর্শ দিয়েছেন আন্দোলনকারীরা।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে